ছাদ ভেঙে পড়বে না তো কি সোনাদানা পড়বে? আনিসুল হক
আমাদের
সহপাঠী তাহের আলী ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় রংপর জিলা স্কুলের বিশাল
মাঠের সবুজ ঘাসে বসে এক সুমহান উক্তি উচ্চারণ করেছিল—৩৭ বছর পরেও যার
সত্যতা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই, ‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী
ভুল হয়া যায়!’ স্কুল প্রাঙ্গণের বটগাছের নিচে বসে আমরা, কিশোর
শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখনই এই অকাল তত্ত্বজ্ঞানী এই উক্তি করে।
আমরা তাকে শুধাই, কেন তাহের আলী, কী ভুল তুমি করেছ?
তাহের আলী জানায়, রংপুর থেকে সে ঢাকা গিয়েছিল। বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিল। তাদের বাথরুমে একটা বালতিতে পানি ছিল। সেই পানি সে ঢেলেছিল কমোডে। তখন সে টের পেল, বালতিতে লুঙ্গি ভেজানো ছিল। পানির সঙ্গে লুঙ্গি কমোডে ঢুকে গিয়ে অর্ধেকটা আটকে আছে।
আহা, এই বিবরণ দিয়ে তাহের আলী বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।
আজ এত দিন পরেও, প্রতিনিয়ত, তাহের আলীর এই উক্তির সত্যতা প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কখন কী ভুল হয়ে যায়। আর ভুল হলেই ক্ষমাহীন শাস্তি। আমাদের এখন হাতুড়ির নিচে জীবন; এই চাপাতি, কি এই গুম–খুন, এই পেট্রলবোমা কি এই জন্মদিনের কেক নিয়ে ধেয়ে আসা ঘাতকের হাতিয়ার। চিত্ত যেথা ভয়যুক্ত নত যেথা শির...
না না। হাহাকার করার জন্য এই কলাম লিখছি না। তাহের আলীর আরেকটা কর্ম রংপুর জিলা স্কুলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকা উচিত ছিল, তবে আমার অকিঞ্চিৎকর গল্প ছাড়া তা কোথাও লেখা নেই।
রংপুর জিলা স্কুল ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমরা যখন ক্লাস করতাম, তখন সামনের চুন-সুরকির খিলানওয়ালা ঐতিহ্যবাহী ভবনটা পুরোনো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।
একদিন ক্লাস চলাকালেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে।
একজন ছাত্র বলল, স্যার, পানি পড়ে!
অঙ্কের স্যার মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, ছাদ থাকি পানি পড়বে না তো কি শরবত পড়বে?
লাখ কথার এক কথা! এর পরে কি আর কথা চলে?
একদিন বিকেলে আকাশ কালো হয়ে এসেছে। রাতে নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। তাহের আলী করল কী, সবগুলো বেঞ্চ উল্টে রাখল। পরের দিন ক্লাসরুমে থকথক করছে পানি। আর সব বেঞ্চ ওল্টানো। ক্লাস হবে কী করে?
বিজ্ঞানের মোনেম স্যার ক্লাসটিচার। বেত উঁচিয়ে বললেন, কে বেঞ্চ উল্টে রেখেছিস, বল।
তাহের আলী দাঁড়াল। আমি স্যার।
আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি পরবর্তী ঘটনার জন্য।
স্যার বললেন, ক্যান উল্টাইছিস বেঞ্চ?
তাহের আলী বলল, বিকেলে যখন দেখলাম আকাশে মেঘ, বুঝলাম বৃষ্টি হবে, বেঞ্চগুলোর ওপরটা ভিজে গেলে আমরা ক্লাস করব কীভাবে। তাই উল্টে রাখলাম, যাতে বেঞ্চগুলোর ওপরের দিক রক্ষা করা যায়।
শুনে স্যার বেত নামিয়ে হাসতে লাগলেন, উকিল তো ভালোয় ধরছিস, যা, তোকে ক্ষমা করি দিলাম।
আমাদের স্কুলের ওই ভবন পরে সংস্কার করা হয়। আরও নতুন ভবনও হয়েছে রংপুর জিলা স্কুলে।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের মিলনায়তনের বারান্দার ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে এক শিক্ষার্থী ও এক শিশু আহত হয়েছে শুনে মনটা দমে গেল।
আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!
আমাদের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থা বেশ করুণ। আসলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরের চেহারাও বেশ করুণ। দেখলেই বোঝা যায়, এ আমাদের দুয়োরানি! ময়লা হতশ্রী চেহারা। দরজা-জানালা ভাঙা। শেওলা ধরা দেয়াল। ধুলোয় ঢাকা মেঝে। ছাদ থেকে অশ্বত্থগাছ পাতা মেলে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
প্রথম কথা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম! প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভবন নেই, ক্লাসরুম নেই, ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই, মিলনায়তন নেই, ছাত্রাবাস নেই। যা আছে, প্রথমেই ঠিকাদার-প্রকৌশলী-চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজ চক্রের কারণে নির্মাণের সময়েই নিদারুণ অপুষ্টির শিকার। মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম বছর খানেক আগে। উপাচার্যের রুমে বসে মনে হলো, কখন যে ছাদ ভেঙে পড়বে। অথচ নতুন ভবন। মনে হয়, ঠিকাদার সিমেন্ট কেনার সময় পাননি, শুধু বালু দিয়েই কাজ চালিয়ে দিয়েছেন। লোহার রড দিয়েছেন কি না জানি না। দেবার দরকার কী! রড তো বাইরে থেকে দেখা যায় না।
যাক, ভবন তো নির্মিত হলো। কিন্তু সেসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছর বছর যে টাকা লাগবে, আসবে কোত্থেকে। ইলেকট্রিসিটির লাইন ঝুলে আছে, বাতি কোনোকালে ছিল, এখন শুধু আছে স্মৃতিচিহ্ন, বাথরুমে কোনো দিনও পানি ছিল না। কোনো দিনও পানির পাম্প লাগানো হয়নি। আহা, দারিদ্র্যের কী ভয়াবহ ছাপই না একেকটা ম্লানমুখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
শিক্ষার্থীদের তুলনায় ছাত্রাবাস অপ্রতুল। ছেলেমেয়েরা ডাবলিং করে, ট্রিপলিং করে, মেঝেতে শোয়, ডাইনিংরুমে শোয়, টিভিরুমে শোয়। যত মারামারি-হানাহানি তার বেশির ভাগেরই কারণ হলে হোস্টেলে সিট-সংকট।
আর আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। একেকটা হলের দিকে তাকান। চোখে পানি চলে আসতে বাধ্য। কত দিন যে চুনকাম করা হয় না। আর শুধু চুনকাম করলেই কি এই পলেস্তারা খসে পড়া থামবে? জগন্নাথ হলের একটা মিলনায়তনের ছাদ ধসে পড়েছিল, কতজন হতাহত হয়েছিল, চুনকামের সাধ্য কি সেই পতন রোধ করতে পারে?
অথচ দেশ এগোচ্ছে। আমরা সচ্ছল হচ্ছি। আমাদের বাজেট বড় হয়েছে। আমরা কোটি টাকা বরাদ্দ করতে পারি আতশবাজির জন্য। কোনো একজন ভাঙারি বিক্রেতার কীর্তিমান সন্তান সরকারি ব্যাংক থেকে দুই হাজার-তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিলেও আমাদের তেমন কষ্ট হয় না, এ যেন সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল সরানো মাত্র। তা-ই যদি হবে, তাহলে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই দরিদ্র হাল কেন?
ঢাকা শহরের আকাশরেখা বদলে গেল চোখের সামনেই। কত সুন্দর সুন্দর ভবন উঠছে। এখন বেসরকারি সংস্থা নিরাপত্তা দেয়, বাথরুম পরিষ্কার করে, মেঝে মুছে দেয় পাঁচ মিনিট পর পর। অথচ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা কাটে না। রাজ্যের ধুলা, রাজ্যের কালিঝুলি, রাজ্যের অন্ধকার আমাদের ক্যাম্পাসগুলো জুড়ে!
বাইরের চেহারার যখন এই ফকিরি দশা, প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার শঙ্কা, ভেতরের অবস্থা না জানি কী! কী গবেষণা হয়, কী লেখাপড়া হয়। রাজনীতি সব দূষিত করেছে, শিক্ষাঙ্গন কি আর মুক্ত থাকবে? আবার জাতীয় নেতা তৈরির প্রক্রিয়াও নেই, ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয় না।
তবু হয়তো প্রাণটা মরে যায়নি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। ভরসা তরুণ শিক্ষার্থীরাই। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অপরিসীম সম্ভাবনা নিয়ে তারা তৈরি হচ্ছে, বিপুল পৃথিবীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমস্ত সৃজনীটুকু নিয়ে।
বিলাসী গল্পে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল ও পায়ের নীচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সে দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি মুখ লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।’
আজও আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোর এই বেহাল অবস্থাই করে রেখেছি, কিন্তু এবার একেবারে নতুন করে ভাবার সময় আসেনি কি?
শিক্ষার্থীদের মাথার ওপরে যখন জর্জরে ছাদ ভেঙে পড়ে, তখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথার ওপরে আকাশ ভেঙে পড়া কি উচিত নয়?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
তাহের আলী জানায়, রংপুর থেকে সে ঢাকা গিয়েছিল। বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিল। তাদের বাথরুমে একটা বালতিতে পানি ছিল। সেই পানি সে ঢেলেছিল কমোডে। তখন সে টের পেল, বালতিতে লুঙ্গি ভেজানো ছিল। পানির সঙ্গে লুঙ্গি কমোডে ঢুকে গিয়ে অর্ধেকটা আটকে আছে।
আহা, এই বিবরণ দিয়ে তাহের আলী বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।
আজ এত দিন পরেও, প্রতিনিয়ত, তাহের আলীর এই উক্তির সত্যতা প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কখন কী ভুল হয়ে যায়। আর ভুল হলেই ক্ষমাহীন শাস্তি। আমাদের এখন হাতুড়ির নিচে জীবন; এই চাপাতি, কি এই গুম–খুন, এই পেট্রলবোমা কি এই জন্মদিনের কেক নিয়ে ধেয়ে আসা ঘাতকের হাতিয়ার। চিত্ত যেথা ভয়যুক্ত নত যেথা শির...
না না। হাহাকার করার জন্য এই কলাম লিখছি না। তাহের আলীর আরেকটা কর্ম রংপুর জিলা স্কুলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকা উচিত ছিল, তবে আমার অকিঞ্চিৎকর গল্প ছাড়া তা কোথাও লেখা নেই।
রংপুর জিলা স্কুল ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমরা যখন ক্লাস করতাম, তখন সামনের চুন-সুরকির খিলানওয়ালা ঐতিহ্যবাহী ভবনটা পুরোনো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।
একদিন ক্লাস চলাকালেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে।
একজন ছাত্র বলল, স্যার, পানি পড়ে!
অঙ্কের স্যার মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, ছাদ থাকি পানি পড়বে না তো কি শরবত পড়বে?
লাখ কথার এক কথা! এর পরে কি আর কথা চলে?
একদিন বিকেলে আকাশ কালো হয়ে এসেছে। রাতে নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। তাহের আলী করল কী, সবগুলো বেঞ্চ উল্টে রাখল। পরের দিন ক্লাসরুমে থকথক করছে পানি। আর সব বেঞ্চ ওল্টানো। ক্লাস হবে কী করে?
বিজ্ঞানের মোনেম স্যার ক্লাসটিচার। বেত উঁচিয়ে বললেন, কে বেঞ্চ উল্টে রেখেছিস, বল।
তাহের আলী দাঁড়াল। আমি স্যার।
আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি পরবর্তী ঘটনার জন্য।
স্যার বললেন, ক্যান উল্টাইছিস বেঞ্চ?
তাহের আলী বলল, বিকেলে যখন দেখলাম আকাশে মেঘ, বুঝলাম বৃষ্টি হবে, বেঞ্চগুলোর ওপরটা ভিজে গেলে আমরা ক্লাস করব কীভাবে। তাই উল্টে রাখলাম, যাতে বেঞ্চগুলোর ওপরের দিক রক্ষা করা যায়।
শুনে স্যার বেত নামিয়ে হাসতে লাগলেন, উকিল তো ভালোয় ধরছিস, যা, তোকে ক্ষমা করি দিলাম।
আমাদের স্কুলের ওই ভবন পরে সংস্কার করা হয়। আরও নতুন ভবনও হয়েছে রংপুর জিলা স্কুলে।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের মিলনায়তনের বারান্দার ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে এক শিক্ষার্থী ও এক শিশু আহত হয়েছে শুনে মনটা দমে গেল।
আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!
আমাদের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থা বেশ করুণ। আসলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরের চেহারাও বেশ করুণ। দেখলেই বোঝা যায়, এ আমাদের দুয়োরানি! ময়লা হতশ্রী চেহারা। দরজা-জানালা ভাঙা। শেওলা ধরা দেয়াল। ধুলোয় ঢাকা মেঝে। ছাদ থেকে অশ্বত্থগাছ পাতা মেলে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
প্রথম কথা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম! প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভবন নেই, ক্লাসরুম নেই, ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই, মিলনায়তন নেই, ছাত্রাবাস নেই। যা আছে, প্রথমেই ঠিকাদার-প্রকৌশলী-চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজ চক্রের কারণে নির্মাণের সময়েই নিদারুণ অপুষ্টির শিকার। মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম বছর খানেক আগে। উপাচার্যের রুমে বসে মনে হলো, কখন যে ছাদ ভেঙে পড়বে। অথচ নতুন ভবন। মনে হয়, ঠিকাদার সিমেন্ট কেনার সময় পাননি, শুধু বালু দিয়েই কাজ চালিয়ে দিয়েছেন। লোহার রড দিয়েছেন কি না জানি না। দেবার দরকার কী! রড তো বাইরে থেকে দেখা যায় না।
যাক, ভবন তো নির্মিত হলো। কিন্তু সেসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছর বছর যে টাকা লাগবে, আসবে কোত্থেকে। ইলেকট্রিসিটির লাইন ঝুলে আছে, বাতি কোনোকালে ছিল, এখন শুধু আছে স্মৃতিচিহ্ন, বাথরুমে কোনো দিনও পানি ছিল না। কোনো দিনও পানির পাম্প লাগানো হয়নি। আহা, দারিদ্র্যের কী ভয়াবহ ছাপই না একেকটা ম্লানমুখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
শিক্ষার্থীদের তুলনায় ছাত্রাবাস অপ্রতুল। ছেলেমেয়েরা ডাবলিং করে, ট্রিপলিং করে, মেঝেতে শোয়, ডাইনিংরুমে শোয়, টিভিরুমে শোয়। যত মারামারি-হানাহানি তার বেশির ভাগেরই কারণ হলে হোস্টেলে সিট-সংকট।
আর আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। একেকটা হলের দিকে তাকান। চোখে পানি চলে আসতে বাধ্য। কত দিন যে চুনকাম করা হয় না। আর শুধু চুনকাম করলেই কি এই পলেস্তারা খসে পড়া থামবে? জগন্নাথ হলের একটা মিলনায়তনের ছাদ ধসে পড়েছিল, কতজন হতাহত হয়েছিল, চুনকামের সাধ্য কি সেই পতন রোধ করতে পারে?
অথচ দেশ এগোচ্ছে। আমরা সচ্ছল হচ্ছি। আমাদের বাজেট বড় হয়েছে। আমরা কোটি টাকা বরাদ্দ করতে পারি আতশবাজির জন্য। কোনো একজন ভাঙারি বিক্রেতার কীর্তিমান সন্তান সরকারি ব্যাংক থেকে দুই হাজার-তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিলেও আমাদের তেমন কষ্ট হয় না, এ যেন সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল সরানো মাত্র। তা-ই যদি হবে, তাহলে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই দরিদ্র হাল কেন?
ঢাকা শহরের আকাশরেখা বদলে গেল চোখের সামনেই। কত সুন্দর সুন্দর ভবন উঠছে। এখন বেসরকারি সংস্থা নিরাপত্তা দেয়, বাথরুম পরিষ্কার করে, মেঝে মুছে দেয় পাঁচ মিনিট পর পর। অথচ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা কাটে না। রাজ্যের ধুলা, রাজ্যের কালিঝুলি, রাজ্যের অন্ধকার আমাদের ক্যাম্পাসগুলো জুড়ে!
বাইরের চেহারার যখন এই ফকিরি দশা, প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার শঙ্কা, ভেতরের অবস্থা না জানি কী! কী গবেষণা হয়, কী লেখাপড়া হয়। রাজনীতি সব দূষিত করেছে, শিক্ষাঙ্গন কি আর মুক্ত থাকবে? আবার জাতীয় নেতা তৈরির প্রক্রিয়াও নেই, ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয় না।
তবু হয়তো প্রাণটা মরে যায়নি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। ভরসা তরুণ শিক্ষার্থীরাই। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অপরিসীম সম্ভাবনা নিয়ে তারা তৈরি হচ্ছে, বিপুল পৃথিবীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমস্ত সৃজনীটুকু নিয়ে।
বিলাসী গল্পে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল ও পায়ের নীচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সে দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি মুখ লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।’
আজও আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোর এই বেহাল অবস্থাই করে রেখেছি, কিন্তু এবার একেবারে নতুন করে ভাবার সময় আসেনি কি?
শিক্ষার্থীদের মাথার ওপরে যখন জর্জরে ছাদ ভেঙে পড়ে, তখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথার ওপরে আকাশ ভেঙে পড়া কি উচিত নয়?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments