উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা by ড. শেখ সালাহ উদ্দিন আহমেদ
স্বাধীনতার
প্রায় ৪৪ বছর পরও বাংলা ভাষা উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালতের ভাষা হয়ে উঠতে
পারেনি। জাতির পিতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি চার দশক পরও। সর্বস্তরে
বাংলা ভাষা চালুর সদিচ্ছা নিয়ে ১৯৮৭ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলা ভাষা
প্রচলন আইন। কিন্তু তারপরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জাতীয় অঙ্গীকার
অপূরণীয় থেকে গেছে।
স্মর্তব্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সংবিধানের এ বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা হয়। উল্লিখিত আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।' ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।' এরপরও আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা তার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে।
হাইকোর্ট বিভাগের রুলের চতুর্থ অধ্যায়ের ১নং বিধিতে বলা হয়েছে, 'হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তগুলোর ভাষা হবে ইংরেজি।' এ রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির কারণে উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর অঙ্গীকার উপেক্ষিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন। তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, তা হবে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে গিয়ে সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে পরে সংশোধন করে নেয়া হবে। উচ্চ আদালত ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালুর ক্ষেত্রে পরিভাষা প্রণয়ন সমস্যা হলেও সে সীমাবদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর নৈতিক বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করা উচিত নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন, জাতি এমনটিই দেখতে চায়। সংবিধান ও আইনে স্পষ্ট করা হয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহূত হবে। যৌক্তিক কারণেই বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের সংবিধান। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা যায়, আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহূত হবে।
তবে পুরনো সূত্র উল্লেখ কিংবা সূত্র অনুসন্ধান করতে হলে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে নিম্ন আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার চোখে পড়লেও উচ্চ আদালতে এখনও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নজির হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার হয়তো আগামীতেও চলতে থাকবে। কিন্তু শুনানি কিংবা রায়ের মূল অংশ বাংলায় রচনা কষ্টসাধ্য হলেও ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আর 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭' এবং সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আদালতের বিষয়টিও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখন উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার ব্যাপারটি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
ব্রিটিশ আমলে ব্যবহূত প্রাচীন জটিল বাংলার পরিবর্তে সহজ, সাবলীল বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশে আইনের বইগুলোর বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। সঙ্গত কারণেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন আদালত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সংবিধান ও আইনের বাস্তবায়ন করতে সরকারিভাবে আইনের বই সহজ, স্বচ্ছন্দ বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। প্রয়োজনে অনুবাদের জন্য সরকার বিশেষ কোনো কমিশনও গঠন করতে পারে। রায় ও শুনানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বাংলার ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। আবেগের ক্ষেত্রটা ব্যাপক হলেও বাস্তবতাকেও আমাদের মেনে নিতে হবে। ইংরেজির বিকল্প হিসেবে বাংলার সুচারু ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত হয়, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
advahmed@outlook.com
স্মর্তব্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সংবিধানের এ বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা হয়। উল্লিখিত আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।' ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।' এরপরও আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা তার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে।
হাইকোর্ট বিভাগের রুলের চতুর্থ অধ্যায়ের ১নং বিধিতে বলা হয়েছে, 'হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তগুলোর ভাষা হবে ইংরেজি।' এ রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির কারণে উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর অঙ্গীকার উপেক্ষিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন। তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, তা হবে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে গিয়ে সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে পরে সংশোধন করে নেয়া হবে। উচ্চ আদালত ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালুর ক্ষেত্রে পরিভাষা প্রণয়ন সমস্যা হলেও সে সীমাবদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর নৈতিক বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করা উচিত নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন, জাতি এমনটিই দেখতে চায়। সংবিধান ও আইনে স্পষ্ট করা হয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহূত হবে। যৌক্তিক কারণেই বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের সংবিধান। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা যায়, আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহূত হবে।
তবে পুরনো সূত্র উল্লেখ কিংবা সূত্র অনুসন্ধান করতে হলে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে নিম্ন আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার চোখে পড়লেও উচ্চ আদালতে এখনও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নজির হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার হয়তো আগামীতেও চলতে থাকবে। কিন্তু শুনানি কিংবা রায়ের মূল অংশ বাংলায় রচনা কষ্টসাধ্য হলেও ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আর 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭' এবং সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আদালতের বিষয়টিও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখন উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার ব্যাপারটি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
ব্রিটিশ আমলে ব্যবহূত প্রাচীন জটিল বাংলার পরিবর্তে সহজ, সাবলীল বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশে আইনের বইগুলোর বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। সঙ্গত কারণেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন আদালত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সংবিধান ও আইনের বাস্তবায়ন করতে সরকারিভাবে আইনের বই সহজ, স্বচ্ছন্দ বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। প্রয়োজনে অনুবাদের জন্য সরকার বিশেষ কোনো কমিশনও গঠন করতে পারে। রায় ও শুনানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বাংলার ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। আবেগের ক্ষেত্রটা ব্যাপক হলেও বাস্তবতাকেও আমাদের মেনে নিতে হবে। ইংরেজির বিকল্প হিসেবে বাংলার সুচারু ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত হয়, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
advahmed@outlook.com
No comments