লিমা সম্মেলন থেকে কী পেল বিশ্ব by তারেক শামসুর রেহমান
নির্ধারিত সময়ের অনেক পর দীর্ঘ আলোচনা
শেষে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়া
সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ১৯৬টি দেশ নিজ নিজ দেশে
কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে উপনীত হয়েছে। আগামী বছরের
ডিসেম্বরে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এ সমঝোতার
আলোকেই। ২০২০ সালের মধ্যে চুক্তিটি কার্যকর হবে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত
কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় লেগেছে একটি সমঝোতায়
উপনীত হতে। এর আগের প্রতিটি কপ সম্মেলনে (কানকুন থেকে ডারবান) কার্বন
নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বটে; কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। সমস্যা
ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নিয়ে। এ দুটি রাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ কার্বন
নিঃসরণকারী দেশ। এ দুটি দেশ যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে রাজি না হতো, তাহলে
কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত গেল নভেম্বরে ওবামার চীন
সফরের সময় এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে
একটি সমঝোতার পথ প্রশস্ত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। এ নিয়ে প্রতিবছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত এসব সম্মেলনকে অভিহিত করা হচ্ছে কপ বা কমিটি অব দ্য পার্টিজ হিসেবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারছিলেন না শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ-এর রিপোর্টে বারবার একটি ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সাগর-মহাসাগরের পানি। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা তথা মানব প্রজাতি অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াচ্ছি। জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলছে, একুশ শতকের মধ্যভাগে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ রাখার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে পৃথিবী এ শতাব্দীতেই বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টারটিকার সব বরফ গলে যাবে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ২৩ ফুট। চিন্তা করা যায়, কী ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
বিশ্বের নেতারা যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। তারা জানেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর চাপে কোনো সরকারই বায়ুমণ্ডলে যে গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ হচ্ছে, তা কমাতে পারছে না। এসব শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো যেসব প্রতিনিধি ওখানে পাঠায়, তাতে তারা অংশ নেয়। লবিং করে। সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটায়।
এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শংকার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী ঘটা করে কপ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে নাসা আরও একটি আশংকার কথা জানিয়েছে। নাসা আশংকা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোয় ইতিমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও নীরব। প্রতিবছরই কপ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে অনেক আগে এবং ২০২০ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছিল। এ ফান্ডের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এ ফান্ড যাত্রা শুরু করছে। বিশ্বব্যাংক এ ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারক করছে। বাংলাদেশ ওই ফান্ড থেকে অর্থ পেয়েছে।
কপ-এর ডারবান সম্মেলনের পর (২০১১) যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো পরবর্তী আলোচনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এ নিয়ে এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রুপের এক এক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এ দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা বিশ্বের ১৯ ভাগ মাত্র। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণে মাত্র ১ ভাগ; তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ৪ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ। জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের।
প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এ দুটি দেশের কাছ থেকে কমিটমেন্ট আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তার মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। দেশটিকে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কারণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। ফলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি।
অর্থায়নের ব্যাপারটি নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলেছেন এর স্বচ্ছতা নিয়ে। বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা, তা মনিটরের ব্যবস্থা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট ২০১৪)। দুর্নীতি এখানে ভর করছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদবাস্তু, তারা সাহায্য পাচ্ছে না। লিমা সম্মেলনে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও কোনো সমাধান হয়নি। অথচ এ বিষয়টি উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা সাগরপাড়ের দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে। উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিকে এড়িয়ে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এমনকি ভারতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (পাঠক, রামপালে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা চিন্তা করতে পারেন)। বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে সোলার বিদ্যুৎ ও বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এ ক্ষেত্র দুটি বারবার উপেক্ষিত থেকে গেছে। গরিব দেশগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোর গড়িমসি চোখে লাগার মতো।
লিমা সম্মেলনে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রতিটি দেশ আগামী ৬ মাসের মধ্যে নিজের দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন ও উপস্থাপন করবে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রামপালে ভারতীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করছে বাংলাদেশ। এতে পরিবেশ দূষণ তো হবেই, একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও বাড়বে। ইটের ভাটায় কয়লা ব্যবহৃত হয়, যা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। এখন বাংলাদেশকে লিমা ঘোষণা বাস্তবায়ন করে একটি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। দেখার বিষয় বাংলাদেশ এখন কী করে।
নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন থাকলই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে কি-না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। এ নিয়ে প্রতিবছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত এসব সম্মেলনকে অভিহিত করা হচ্ছে কপ বা কমিটি অব দ্য পার্টিজ হিসেবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারছিলেন না শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ-এর রিপোর্টে বারবার একটি ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সাগর-মহাসাগরের পানি। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা তথা মানব প্রজাতি অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াচ্ছি। জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলছে, একুশ শতকের মধ্যভাগে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ রাখার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে পৃথিবী এ শতাব্দীতেই বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টারটিকার সব বরফ গলে যাবে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ২৩ ফুট। চিন্তা করা যায়, কী ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
বিশ্বের নেতারা যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। তারা জানেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর চাপে কোনো সরকারই বায়ুমণ্ডলে যে গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ হচ্ছে, তা কমাতে পারছে না। এসব শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো যেসব প্রতিনিধি ওখানে পাঠায়, তাতে তারা অংশ নেয়। লবিং করে। সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটায়।
এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শংকার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী ঘটা করে কপ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে নাসা আরও একটি আশংকার কথা জানিয়েছে। নাসা আশংকা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোয় ইতিমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও নীরব। প্রতিবছরই কপ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে অনেক আগে এবং ২০২০ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছিল। এ ফান্ডের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এ ফান্ড যাত্রা শুরু করছে। বিশ্বব্যাংক এ ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারক করছে। বাংলাদেশ ওই ফান্ড থেকে অর্থ পেয়েছে।
কপ-এর ডারবান সম্মেলনের পর (২০১১) যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো পরবর্তী আলোচনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এ নিয়ে এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রুপের এক এক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এ দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা বিশ্বের ১৯ ভাগ মাত্র। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণে মাত্র ১ ভাগ; তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ৪ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ। জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের।
প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এ দুটি দেশের কাছ থেকে কমিটমেন্ট আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তার মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। দেশটিকে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কারণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। ফলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি।
অর্থায়নের ব্যাপারটি নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলেছেন এর স্বচ্ছতা নিয়ে। বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা, তা মনিটরের ব্যবস্থা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট ২০১৪)। দুর্নীতি এখানে ভর করছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদবাস্তু, তারা সাহায্য পাচ্ছে না। লিমা সম্মেলনে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও কোনো সমাধান হয়নি। অথচ এ বিষয়টি উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা সাগরপাড়ের দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে। উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিকে এড়িয়ে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এমনকি ভারতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (পাঠক, রামপালে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা চিন্তা করতে পারেন)। বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে সোলার বিদ্যুৎ ও বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এ ক্ষেত্র দুটি বারবার উপেক্ষিত থেকে গেছে। গরিব দেশগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোর গড়িমসি চোখে লাগার মতো।
লিমা সম্মেলনে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রতিটি দেশ আগামী ৬ মাসের মধ্যে নিজের দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন ও উপস্থাপন করবে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রামপালে ভারতীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করছে বাংলাদেশ। এতে পরিবেশ দূষণ তো হবেই, একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও বাড়বে। ইটের ভাটায় কয়লা ব্যবহৃত হয়, যা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। এখন বাংলাদেশকে লিমা ঘোষণা বাস্তবায়ন করে একটি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। দেখার বিষয় বাংলাদেশ এখন কী করে।
নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন থাকলই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে কি-না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
No comments