‘গুলি করেই থামেনি, বুট দিয়ে হাতের আঙুল থেঁতলে দেয়ারও চেষ্টা করেছে’ by উৎপল রায়
কমলা
কিনে মাদরাসায় ফিরছিলেন ছিদ্দিক (২৪)। পথিমধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারী
থানার পুলিশ কনস্টেবল নোমান সিরাজী পেছন থেকে অতর্কিতে গুলি করেন তাকে। এ
সময় আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে দূর থেকে ছিদ্দিকের
পিঠে কোমরের ওপরে মেরুদণ্ডের মাঝখানে। এরপর কাছে এসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ডান
পায়ের উরুতে ও বাম পায়ের হাঁটুর নিচে পরপর দুটি গুলি করেন সিরাজী। এখানেই
থেমে থাকেনি ওই পুলিশ সদস্য। কিল ঘুষির পাশাপাশি চলে পায়ের বুট দিয়ে দুই
হাতের আঙুল থেঁতলে দেয়ার চেষ্টা। মুমূর্ষু ছিদ্দিককে প্রথমে চট্টগ্রাম
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় পাঠিয়ে দেয়া
হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। ১৬ই ডিসেম্বর রাত ৮টায় নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে
চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার পাশেই জনসমাগম এলাকায়। তবে চোখের সামনে নির্মম
এই ঘটনা ঘটলেও পুলিশের গুলির ভয়ে এসময় ছিদ্দিককে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ।
পঙ্গু হাসপাতালের দোতলার সিডি ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে গিয়ে দেখা যায়,
চিকিৎসাধীন ছিদ্দিককে আগরে রেখেছেন মা শাহানারা বেগম। একটু পরপর শাড়ির
আঁচলে চোখ মুচছেন তিনি। দুই পা ও পিঠে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিদ্দিকের উঠে
দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। প্রায় সম্পূর্ণ শরীর অবস। হাত-পা ঠিকমতো নাড়াতে
পারছেন না। চিকিৎসকরা বলছেন, ছিদ্দিক শঙ্কামুক্ত নন। এছাড়া পুরোপুরি সেরে
উঠতে কত সময় লাগতে পারে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এই মুহূর্তে তার উন্নত
চিকিৎসা দরকার। তাকে সুস্থ করে তুলতে তাদের চেষ্টার কোন কমতি নেই।
ছিদ্দিকের পুরো নাম মোহাব্বত ছিদ্দিক। বন্ধুমহলে আবু ছিদ্দিক নামে পরিচিত।
ছিদ্দিকের গ্রামের বাড়ি খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার বড় বয়রা গ্রামে। ৭
ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিদ্দিক স্থানীয়
মাদিনাতুল উলুম মাদরাসা থেকে ফেকা, হাদিস ও কোরআন বিষয়ে পড়শোনা সম্পন্ন
করেন। পরে ইসলামি শিক্ষায় আরও উচ্চতর পড়ালেখার জন্য হাটহাজারীর দারুল উলুম
মইনুল ইসলাম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উচ্চ রক্তচাপজনিত
সমস্যার কারণে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে মাদরাসার হোস্টেল থেকে বের হন
তিনি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রাত ৮টায় আবারও মাদরাসায় ফিরছিলেন
ছিদ্দিক। হাটহাজারী থানা থেকে একটু দূরে ফুটপাতের ফলের দোকান থেকে কমলা
কিনে একটু এগুতেই প্রায় ২০ গজ দূর থেকেই শুনতে পান ওই ‘শালাকে ধর’ বলে
আওয়াজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ তার পেছনে কোমরের একটু ওপরে মেরুদণ্ডের
মাঝখানে গুলি করে পুলিশের কনস্টেবল নোমান সিরাজী। রাস্তায় পড়ে যান ছিদ্দিক।
পরে কাছে এসে ডান পায়ের উরুতে অস্ত্র ঠেকিয়ে আরও একটি গুলি করে ওই
কনস্টেবল। পায়ের বুট দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয় বেশ কটি আঙুল। রক্তাক্ত ও আহত
ছিদ্দিক চিৎকার করে বলতে থাকেন পুলিশ ভাইরা আমাকে মারছেন কেন? আমি কি
করেছি? আমাকে মারছেন কেন? এ সময় ‘চুপ শালা’ বলে বাম পায়ের হাঁটুর নিচে আরও
একটি গুলি করেন সিরাজী। এরপর আর কিছুই মনে নেই ছিদ্দিকের। সংজ্ঞাহীন
অবস্থায় ফুটপাতেই পড়ে থাকেন। পরে হাটহাজারী থানার দু’জন পুলিশ সদস্য তাকে
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে
তিনি বলেন, আমার বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ঘটনার পর দুজন পুলিশ সদস্য আমাকে
নিয়ে যান চট্টগ্রাম মেডিক্যালের কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা
আমার মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চিকিৎসা করাতে অপরাগতা প্রকাশ করে পঙ্গু
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ১৬ই ডিসেম্বর রাতেই আমাকে এখানে নিয়ে
আসা হয়। হাসপাতালে ছিদ্দিকের স্বজনরা জানান, ১৭ই ডিসেম্বর পঙ্গু হাসপাতালের
অস্ত্রোপচার কক্ষে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ছিদ্দিকের দুই পা ও
মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। এসময় তাকে ৬ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। হাসপাতালের
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন গুলিতে ছিদ্দিকের মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুই পায়ে গুলির কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আরও রক্তের প্রয়োজন হবে। তবে
অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করে আনা হয়েছে। কেন পুলিশ তাকে গুলি করেছে বা
কনস্টেবল নোমান সিরাজীকে তিনি চিনেন কি-না এমন প্রশ্নে ছিদ্দিক জানান, তিনি
পুলিশদের চিনেন না। এছাড়া কারও সঙ্গেই তার কোন শত্রুতা নেই। এমনকি উঁচু
গলায় কারও সঙ্গে কথা বলেছেন এমন নজিরও নেই। খুলনা থেকে হাটহাজারী মাদরাসায়
তিনি পড়ালেখা করতে এসেছেন। এখানকার বাইরের কারও সঙ্গে তিনি মিশতেন না। অবসর
সময় সহপাঠীদের সঙ্গে মাদরাসায় কাটাতেন। পুলিশ কেন তাকে গুলি করলো,
নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করলো, তা তিনি জানেন না। ছিদ্দিকের মা
শাহানারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই শান্ত ও ভদ্র। ধর্মের দিকে
তার ঝোঁক বেশি। এজন্য পড়ালেখা ছাড়া বাকি সময় সে নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগিতে
কাটায়। পুলিশ কেন তাকে এভাবে গুলি করলো তা বুঝতে পারছি না। তবে যে কারণেই
গুলি করুক আমি এই ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
চাই।’ হাসপাতালে ছিদ্দিকের এক সহপাঠী জানান, ঘটনার সময় ছিদ্দিক ওই থানার
সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা। আচমকাই পুলিশ ছিদ্দিককে গুলি
করে। অবশ্য গুলি করার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল নোমান সিরাজী দাবি
করেছেন, ছিদ্দিকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জের ধরে রাগের বশে তিনি এ ঘটনা
ঘটিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী অনেকইে জানিয়েছেন এ ধরনের কিছুই হয়নি।
হঠাৎ করেই কনস্টেবল সিরাজী তার দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে আহত
ছিদ্দিকের পুরো চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছে চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসন। এ
কারণে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিদ্দিকের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য
চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার একজন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। তবে ওই পুলিশ
সদস্য তার নাম ও পদমর্যাদা প্রকাশ করতে অপারগতা জানিয়ে এই প্রতিবেদককে
বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে ছিদ্দিকের চিকিৎসার ব্যয়ভার চট্টগ্রাম পুলিশ
প্রশাসন বহন করছে। চট্টগ্রাম পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমি
এখানে দায়িত্ব পালন করছি। পঙ্গু হাসপাতালের দোতলায় সিডি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন
ছিদ্দিক বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠেন। কাঁপা কাঁপা
গলায় তিনি বলেন, ‘আমি কি অন্যায় করেছি? আমার কি দোষ? কেন পুলিশ আমাকে
নির্মমভাবে গুলি করলো? আমি এর বিচার চাই। পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি চাই।’ এদিকে চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, এ ঘটনায় পুলিশের
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে কনস্টেবল নোমান সিরাজীকে সাময়িক বরখাস্ত
করা হয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে
চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসন।
No comments