বিজয়ের মাসে অন্য এক কিসিঞ্জার by মহসীন হাবিব
কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ছাড়া বিংশ ও
একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসে যার নাম সবচেয়ে সামনে অবস্থান করবে,
নিঃসন্দেহে তিনি হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের চোখে তিনি ঠিকই
ঘোড়সওয়ার, একজন আধুনিক ম্যাটারনিক। একসময় ছিলেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড
নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পরে নিক্সন ও ফোর্ড সরকারের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ধূর্ততা, বিচক্ষণতা, নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক
প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার কারণে তিনি আজও ওভাল অফিসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
রিপাবলিকান দলের সমর্থক হলেও ডেমোক্রেটরাও পররাষ্ট্র বিষয়ে কিসিঞ্জারের
শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। সাবেক ফার্¯¡লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ
বহু ডেমোক্রেট তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারণ আমেরিকার নেতারা মনে করেন, মার্কিন
স্বার্থরক্ষা কীভাবে করতে হয় তা কিসিঞ্জার জানেন। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড
নিক্সনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম তাকে ‘আসল প্রেসিডেন্ট’ বলে আখ্যায়িত
করেছিল। একজন সাংবাদিক একবার কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, Why are
Americans so fascinated by a young man from Furth in the German region
of Franconia, who fled the Nazi at the age of 15? কিসিঞ্জার গর্বের সঙ্গে
উত্তর দিয়েছিলেন, I have always acted alone. Americans like that
immensely. Americans like the cowboy who leads the wagon train by riding
ahead alone on his horse. (হেনরি কিসিঞ্জারের জন্ম হয়েছিল জার্মানির
ফ্যুর্থ শহরে ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে ইহুদি
নির্যাতন শুরু হলে ১৯৩৮ সালে ১৫ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে প্রথম
ব্রিটেন ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়।)
কিসিঞ্জার আমেরিকার শীর্ষ নেতাদের কাছে যেমন অপরিহার্য নাম, তেমনি তার ব্যাপারে এ ‘কাউবয়’ ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাপী রয়েছে অভিযোগ। ১৯৬৯ সালে কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সন প্রশাসনের মুখ্য চরিত্র। সেই সময় কম্বোডিয়ায় বি-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে কার্পেট বোম্বিং করার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী এখনও কিসিঞ্জারকে দায়ী করা হয়। সেই বোমা হামলার মধ্য দিয়ে কম্বোডিয়াকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে চার বছরব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ৫ লাখ টন বোমা নিক্ষেপ করে। আর সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল পাঁচ লক্ষাধিক কম্বোডিয়ান ও ভিয়েতনামি মানুষ (যদিও ২০ বছরের যুদ্ধে ২০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে)। কিছুকাল আগে কিসিঞ্জার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সেই বোমার বেশিরভাগই ফেলা হয়েছিল জনবিরল এলাকায়।’ তার এ বক্তব্যে অনেকে মুখটিপে হেসেছিলেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, চিলির নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক নেতা আলেন্দেকে হত্যা করে স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্টো পিনোশেকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে সম্পূর্ণরূপে কলকাঠি নেড়েছেন কিসিঞ্জার। অবশ্য সেটা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন দলিল থেকেও পাওয়া গেছে। বরাবরই কিসিঞ্জার দৃঢ়তার সঙ্গে তা অস্বীকার করেছেন। ২০০০ সালে সিআইএ স্বীকার করেছে, আলেন্দেকে উৎখাতের জন্য চিলির সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন চিলির সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল রেনে স্নাইডারকে অপহরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ জেনারেল রেনে দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে কোনোক্রমেই রাজি ছিলেন না। অপহরণ পরিকল্পনা প্রথম ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু ঠিক দুদিন পর, যেদিন আলেন্দে নির্বাচিত হন, সেদিন রেনে আবার অপহরণের মুখে নিহত হন। প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক ও বিতার্কিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স চিলিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়ে একটি আস্ত বই লিখেছেন যার নাম, ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’। (বইটিতে বাংলাদেশ নিয়ে একটি চ্যাপ্টার আছে ‘বাংলাদেশ : ওয়ান জেনোসাইড, ওয়ান ক্যু অ্যান্ড ওয়ান অ্যাসাসিনেশন’) হিচেন্স বহু প্রামাণিক দলিল উল্লেখের মধ্য দিয়ে তার এই গ্রন্থে জানতে চেয়েছেন, পিনোশে’র বিচার হলে কিসিঞ্জারের বিচার হবে না কেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ২০১০ সালে এবং ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের সাংবাদিক বি জেড খসরুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে দুটি গ্রন্থ লিখেছেন। বই দুটির নাম Myth And Fact: Bangladesh Liberation War (2010) এবং The Bangladesh Military Coup and the CIA Link (2014). প্রচুর তথ্যসমৃদ্ধ এ বই দুটি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে বাংলাদেশ বিষয়ে কিসিঞ্জারের ভূমিকা অনেকটা স্পষ্ট হতে পারে। যাই হোক, অতি সম্প্রতি ৯১ বছর বয়সী আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির এই অপরিহার্য মানুষটি তার অভিজ্ঞতার আলোকে আরও একটি গ্রন্থ লিখে রাজনৈতিক মহলে নাড়া দিয়েছেন। তার লেখা ১৭তম বইটির নাম World Order. বইটি প্রকাশের পর যথারীতি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। বলে রাখা ভালো, অত্যন্ত মেধাবী কিসিঞ্জার সাক্ষাৎকারে এমন সব শব্দ ব্যবহার করেন যার দু-তিন ধরনের অর্থ হতে পারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এমন সব মন্তব্য ও শব্দ ব্যবহার করতেন যা থেকে পরিষ্কার ধারণায় পৌঁছানো মুশকিল। ২০০২ সালে লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। তখন হলের বাইরে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে। বিক্ষোভকারীরা কিসিঞ্জারের গ্রেফতার দাবি করে। ওই অনুষ্ঠানে কিসিঞ্জার ভাষণ দিতে গিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বলতে পারবে না যে তিনি যে প্রশাসনে কাজ করেছেন সেই প্রশাসন কোনো ভুল করেনি। সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে সাধারণত ৫১-৪৯ মতামতের ভিত্তিতে। সুতরাং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ঘটনার তিরিশ বছর পর এখন আদালতই উপযুক্ত জায়গা এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার।’
তবে নতুন গ্রন্থ প্রকাশের ওপর দেয়া সাক্ষাৎকারে এবার যেন কিসিঞ্জারের কণ্ঠে অন্য সুর শোনা গেল। ১৩ নভেম্বর তিনি জার্মানির একটি পত্রিকার সঙ্গে বলেছেন, ‘এখন আমি বুঝতে পেরেছি, ইতিহাসকে খুঁজে বের করতে হয়, এটি ঘোষণার বিষয় নয়। সে কথা আমি বইটিতেও লিখেছি। এক জীবনে এ বোধ আসে। একে আত্মসমালোচনা বলা যায় না। তার মানে আমি বলতে চেষ্টা করেছি, ইতিহাসকে তুমি ইচ্ছা করলেই নিজের মতো করে সাজাতে পার না। সে কারণেই আমি এ ধারণার বিরোধী যে, পরিণতি না জেনে কোথাও হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’ ৯১ বছর বয়সেও কিসিঞ্জার একজন দৃঢ়চিত্তের ও সুস্থ দেহের মানুষ। কিন্তু এ বোধ তাকে নাড়া দিয়েছে। তাই প্রশ্ন জেগেছে, কিসিঞ্জার কি কথার মারপ্যাঁচের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ক্ষমা চাইছেন?
কিসিঞ্জারকে নিয়ে এই ফিরিস্তির পেছনে একটি কারণ আছে। আমরা সবাই জানি, কেউ কোনো ভুল করলে সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তার দায়িত্ব। ৩০ বছর পার হয়ে গেল বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। দলটি সরকারের অংশ হয়েছে, সিনিয়র সদস্যরা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার ১৯৭১ সালে মানবতা অপরাধের দায়ে দলের সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। বহুবার, বহু পক্ষ থেকে জামায়াতকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বরাবরই জামায়াত তাদের পূর্ব অবস্থানে বহাল থেকেছে। এটি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে, জামায়াত ৭১-এর ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত নয়। চার যুগ আগে যৌবনে ভুল করলে যে কোনো সভ্য মানুষ অনুতপ্ত হয়। অন্তরে জেগে ওঠে, ‘এ পাপের যে অভিসম্পাত/হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর/তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো।’ কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে এ বোধ এখনও বুঝি জেগে ওঠেনি। এটি জামায়াতের অব্যাহত অপরাধ বলে অনেকে মনে করেন।
মহসীন হাবিব : লেখক ও সাংবাদিক
কিসিঞ্জার আমেরিকার শীর্ষ নেতাদের কাছে যেমন অপরিহার্য নাম, তেমনি তার ব্যাপারে এ ‘কাউবয়’ ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাপী রয়েছে অভিযোগ। ১৯৬৯ সালে কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সন প্রশাসনের মুখ্য চরিত্র। সেই সময় কম্বোডিয়ায় বি-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে কার্পেট বোম্বিং করার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী এখনও কিসিঞ্জারকে দায়ী করা হয়। সেই বোমা হামলার মধ্য দিয়ে কম্বোডিয়াকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে চার বছরব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ৫ লাখ টন বোমা নিক্ষেপ করে। আর সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল পাঁচ লক্ষাধিক কম্বোডিয়ান ও ভিয়েতনামি মানুষ (যদিও ২০ বছরের যুদ্ধে ২০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে)। কিছুকাল আগে কিসিঞ্জার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সেই বোমার বেশিরভাগই ফেলা হয়েছিল জনবিরল এলাকায়।’ তার এ বক্তব্যে অনেকে মুখটিপে হেসেছিলেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, চিলির নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক নেতা আলেন্দেকে হত্যা করে স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্টো পিনোশেকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে সম্পূর্ণরূপে কলকাঠি নেড়েছেন কিসিঞ্জার। অবশ্য সেটা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন দলিল থেকেও পাওয়া গেছে। বরাবরই কিসিঞ্জার দৃঢ়তার সঙ্গে তা অস্বীকার করেছেন। ২০০০ সালে সিআইএ স্বীকার করেছে, আলেন্দেকে উৎখাতের জন্য চিলির সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন চিলির সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল রেনে স্নাইডারকে অপহরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ জেনারেল রেনে দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে কোনোক্রমেই রাজি ছিলেন না। অপহরণ পরিকল্পনা প্রথম ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু ঠিক দুদিন পর, যেদিন আলেন্দে নির্বাচিত হন, সেদিন রেনে আবার অপহরণের মুখে নিহত হন। প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক ও বিতার্কিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স চিলিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়ে একটি আস্ত বই লিখেছেন যার নাম, ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’। (বইটিতে বাংলাদেশ নিয়ে একটি চ্যাপ্টার আছে ‘বাংলাদেশ : ওয়ান জেনোসাইড, ওয়ান ক্যু অ্যান্ড ওয়ান অ্যাসাসিনেশন’) হিচেন্স বহু প্রামাণিক দলিল উল্লেখের মধ্য দিয়ে তার এই গ্রন্থে জানতে চেয়েছেন, পিনোশে’র বিচার হলে কিসিঞ্জারের বিচার হবে না কেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ২০১০ সালে এবং ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের সাংবাদিক বি জেড খসরুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে দুটি গ্রন্থ লিখেছেন। বই দুটির নাম Myth And Fact: Bangladesh Liberation War (2010) এবং The Bangladesh Military Coup and the CIA Link (2014). প্রচুর তথ্যসমৃদ্ধ এ বই দুটি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে বাংলাদেশ বিষয়ে কিসিঞ্জারের ভূমিকা অনেকটা স্পষ্ট হতে পারে। যাই হোক, অতি সম্প্রতি ৯১ বছর বয়সী আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির এই অপরিহার্য মানুষটি তার অভিজ্ঞতার আলোকে আরও একটি গ্রন্থ লিখে রাজনৈতিক মহলে নাড়া দিয়েছেন। তার লেখা ১৭তম বইটির নাম World Order. বইটি প্রকাশের পর যথারীতি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। বলে রাখা ভালো, অত্যন্ত মেধাবী কিসিঞ্জার সাক্ষাৎকারে এমন সব শব্দ ব্যবহার করেন যার দু-তিন ধরনের অর্থ হতে পারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এমন সব মন্তব্য ও শব্দ ব্যবহার করতেন যা থেকে পরিষ্কার ধারণায় পৌঁছানো মুশকিল। ২০০২ সালে লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। তখন হলের বাইরে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে। বিক্ষোভকারীরা কিসিঞ্জারের গ্রেফতার দাবি করে। ওই অনুষ্ঠানে কিসিঞ্জার ভাষণ দিতে গিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বলতে পারবে না যে তিনি যে প্রশাসনে কাজ করেছেন সেই প্রশাসন কোনো ভুল করেনি। সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে সাধারণত ৫১-৪৯ মতামতের ভিত্তিতে। সুতরাং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ঘটনার তিরিশ বছর পর এখন আদালতই উপযুক্ত জায়গা এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার।’
তবে নতুন গ্রন্থ প্রকাশের ওপর দেয়া সাক্ষাৎকারে এবার যেন কিসিঞ্জারের কণ্ঠে অন্য সুর শোনা গেল। ১৩ নভেম্বর তিনি জার্মানির একটি পত্রিকার সঙ্গে বলেছেন, ‘এখন আমি বুঝতে পেরেছি, ইতিহাসকে খুঁজে বের করতে হয়, এটি ঘোষণার বিষয় নয়। সে কথা আমি বইটিতেও লিখেছি। এক জীবনে এ বোধ আসে। একে আত্মসমালোচনা বলা যায় না। তার মানে আমি বলতে চেষ্টা করেছি, ইতিহাসকে তুমি ইচ্ছা করলেই নিজের মতো করে সাজাতে পার না। সে কারণেই আমি এ ধারণার বিরোধী যে, পরিণতি না জেনে কোথাও হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’ ৯১ বছর বয়সেও কিসিঞ্জার একজন দৃঢ়চিত্তের ও সুস্থ দেহের মানুষ। কিন্তু এ বোধ তাকে নাড়া দিয়েছে। তাই প্রশ্ন জেগেছে, কিসিঞ্জার কি কথার মারপ্যাঁচের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ক্ষমা চাইছেন?
কিসিঞ্জারকে নিয়ে এই ফিরিস্তির পেছনে একটি কারণ আছে। আমরা সবাই জানি, কেউ কোনো ভুল করলে সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তার দায়িত্ব। ৩০ বছর পার হয়ে গেল বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। দলটি সরকারের অংশ হয়েছে, সিনিয়র সদস্যরা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার ১৯৭১ সালে মানবতা অপরাধের দায়ে দলের সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। বহুবার, বহু পক্ষ থেকে জামায়াতকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বরাবরই জামায়াত তাদের পূর্ব অবস্থানে বহাল থেকেছে। এটি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে, জামায়াত ৭১-এর ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত নয়। চার যুগ আগে যৌবনে ভুল করলে যে কোনো সভ্য মানুষ অনুতপ্ত হয়। অন্তরে জেগে ওঠে, ‘এ পাপের যে অভিসম্পাত/হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর/তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো।’ কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে এ বোধ এখনও বুঝি জেগে ওঠেনি। এটি জামায়াতের অব্যাহত অপরাধ বলে অনেকে মনে করেন।
মহসীন হাবিব : লেখক ও সাংবাদিক
No comments