কর আহরণ ও প্রদানের সংস্কৃতি সমুন্নত হোক by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
নাগরিকের ওপর রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের আওতায়
কর আরোপ আর রাষ্ট্রকে সেই কর পরিশোধের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, আদায়
শব্দটা ততটা যুতসই নয়, যতটা তা ভূমি কর বা খাজনার ক্ষেত্রে খাটে। আয়করের
দর্শন হল, রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয় বা সম্পদ
অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটা নির্দিষ্ট অংশ সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায়
সমতা বিধান এবং আয়-উপার্জনের পরিবেশ সৃজন তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ
আয়-উপার্জনের পরিমাণ ভেদে একটা হিস্যা প্রাপ্য হিসেবে চাইতে পারে। ভূমি
করের ক্ষেত্রে আগে রাষ্ট্র ভূমি বরাদ্দ দেয় এবং তার ভিত্তিতে খাজনা দাবি
করে। এখানে লেনদেন প্রকাশ্য, সুতরাং দাবি বা আদায়ের যৌক্তিকতা সেভাবে আসে।
কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে লেনদেন অপ্রকাশ্য, রাষ্ট্র সৃজিত সুযোগ-সুবিধা সবাই
ভোগ করলেও সবাই আয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারে না। নিজের মেধা, বুদ্ধি,
পরিশ্রম প্রয়োগ করে সম্পদ অর্জন করতে হয়। অতএব, সেই আয়ের ওপর রাষ্ট্রের যে
দাবি, তা নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে প্রদেয়। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষে
তা ‘আদায়ের’ যৌক্তিকতা অনেকটা গৌণ।
আয়কর দেয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে, তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে, নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ, যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন- তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কেননা কেউ কর ফাঁকি দিলে তা উদ্ধারে ব্যর্থতার দায়ভার আহরণকারীর এজন্য যে, তাদের এ অপারগতায় সমাজে ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ অসম অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে; রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে সম্পদের অর্জন বণ্টনে বৈষম্য সৃজিত হতে পারে। এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। এ নিরিখেই সব করদাতার সঙ্গে ‘আদায়’জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃজন যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এজন্য যে, তা না হলে কর আরোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। করারোপ ও আহরণকারীর সঙ্গে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে। পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর জবরদস্তির, পক্ষপাতিত্বের, আঁতাতের মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের দেহে সিস্টেম লস বা ইনফর্মাল রেভিনিউরূপি ‘সুগারের’ মাত্রা বেড়ে অর্থনীতি ‘ডায়াবেটিসে’ আক্রান্ত হতে পারে, ‘সাইলেন্ট কিলার’ নামে পরিচিত যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক।
একটি স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের অর্থনীতি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অবগাহন করে আধুনিকমনস্ক হতে চাইলেও সে দেশের আয়কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনও যেন ঔপনিবেশিক আমলের পারস্পরিক অবিশ্বাসের, সংশয়-সন্দেহের, জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নিরুৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যমান আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার অর্থে ভাড়া করা দেশী-বিদেশী আয়কর বিশেষজ্ঞ দ্বারা বাংলাদেশের বিদ্যমান গোটা আয়কর আইনকে পুনর্লিখিত করে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রয়োগ আইন পাসের পর দেশের সব আইন বাংলা ভাষায় প্রণয়নের বিধান থাকলেও আয়কর আইনটি ইংরেজি ভাষায় দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। এতে ও দ্ব্যর্থবোধক প্রাকরণিক এবং পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার সমাহার ঘটানো হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক আবহ ও সংস্কৃতিতে যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ দেশের আয়কর আইনে এ দেশেরই চিরায়ত অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটবে, তবেই বাড়বে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং এর বাস্তবায়নযোগ্যতা।
এটা বেশ স্বস্তিদায়ক যে, সরকারের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চেয়ে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে, উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে, আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য শুধু নয়, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণ; ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে পরনির্ভরতার নিগঢ় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলন।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। গত চার অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর-রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এটা অবশ্য ঠিক যে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা, আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ৫০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে স্থিরিকৃত আয়কর অধিক পরিমাণে আহরণের একটা অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, এ চার অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫-এ উন্নীত হয়েছে, আর সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০-এর কাছাকাছি। আয়করকে দেশের উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি করতে হলে আরও জোরে চালাতে হবে পা। চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ।
বাংলাদেশে বিদ্যমান কর সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। দেশের আয়কর দেয়ার প্রেক্ষাপট দ্রুত উন্নত ও কার্যকর হওয়া দরকার। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত এখনও কম। এটি একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতিও নির্দেশ করে। জিডিপি এত হলে ট্যাক্স কম হয় কী করে? তার মানে, মানুষ ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছে না। আহরিত রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর আয়করের অবস্থান মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল তৃতীয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আহরিত মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬-৩৭ শতাংশ ছিল ভ্যাট, ৩৩-৩৪ শতাংশ কাস্টম ডিউটি (সম্পূরকসহ আমদানি শুল্ক) এবং ৩০-৩১ শতাংশ আয়করের অবদান। অথচ অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে, আয়কর হবে সর্বোচ্চ। অন্যগুলো থাকবে তার পরে। যে অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়, মানুষ এত সম্পদ ভোগ করতে পারে- তারা কেন আয়কর দেবে না? আয়কর তৃতীয় অবস্থানে থাকবে কেন? অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের এ ধরনের নাজুক কাঠামোর কারণে স্বাধীনতার পর ৪৩ বছরে দেশ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশী ঋণ এবং প্রায় ২৫.৫ বিলিয়ন ডলার অনুদান গ্রহণ করেছে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ পাহাড় সমান। বিদেশী ঋণের আসলের বর্ষিক কিস্তির পরিমাণ প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী ঋণের বার্ষিক সুদ পরিশোধে বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশই চলে যাচ্ছে। এরকম একটি অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে খাতওয়ারি অসমাঞ্জস্যতাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে আয়কর পরিস্থিতি উন্নয়নের বিকল্প নেই। আয়কর যথাযথভাবে দেয়া হলে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়বে, অসমাঞ্জস্যতাও দূর হবে। যে দেশের পাঁচ লক্ষাধিক লোক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারে, মাসে শত শত গাড়ি আমদানি হয়, সেখানে আয়কর থেকে এত কম রাজস্ব আসতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক।
কর মেলায় মানুষের উপচেপড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেয়াকে দায়িত্ব মনে করেন। তাদের এই আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে। তাদের এ দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। তাদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না। কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো যত্নবান হওয়ার নজীর ছিল না। এখন এসব সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
আয়কর দেয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে, তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে, নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ, যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন- তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কেননা কেউ কর ফাঁকি দিলে তা উদ্ধারে ব্যর্থতার দায়ভার আহরণকারীর এজন্য যে, তাদের এ অপারগতায় সমাজে ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ অসম অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে; রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে সম্পদের অর্জন বণ্টনে বৈষম্য সৃজিত হতে পারে। এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। এ নিরিখেই সব করদাতার সঙ্গে ‘আদায়’জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃজন যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এজন্য যে, তা না হলে কর আরোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। করারোপ ও আহরণকারীর সঙ্গে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে। পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর জবরদস্তির, পক্ষপাতিত্বের, আঁতাতের মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের দেহে সিস্টেম লস বা ইনফর্মাল রেভিনিউরূপি ‘সুগারের’ মাত্রা বেড়ে অর্থনীতি ‘ডায়াবেটিসে’ আক্রান্ত হতে পারে, ‘সাইলেন্ট কিলার’ নামে পরিচিত যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক।
একটি স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের অর্থনীতি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অবগাহন করে আধুনিকমনস্ক হতে চাইলেও সে দেশের আয়কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনও যেন ঔপনিবেশিক আমলের পারস্পরিক অবিশ্বাসের, সংশয়-সন্দেহের, জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নিরুৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যমান আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার অর্থে ভাড়া করা দেশী-বিদেশী আয়কর বিশেষজ্ঞ দ্বারা বাংলাদেশের বিদ্যমান গোটা আয়কর আইনকে পুনর্লিখিত করে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রয়োগ আইন পাসের পর দেশের সব আইন বাংলা ভাষায় প্রণয়নের বিধান থাকলেও আয়কর আইনটি ইংরেজি ভাষায় দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। এতে ও দ্ব্যর্থবোধক প্রাকরণিক এবং পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার সমাহার ঘটানো হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক আবহ ও সংস্কৃতিতে যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ দেশের আয়কর আইনে এ দেশেরই চিরায়ত অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটবে, তবেই বাড়বে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং এর বাস্তবায়নযোগ্যতা।
এটা বেশ স্বস্তিদায়ক যে, সরকারের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চেয়ে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে, উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে, আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য শুধু নয়, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণ; ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে পরনির্ভরতার নিগঢ় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলন।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। গত চার অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর-রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এটা অবশ্য ঠিক যে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা, আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ৫০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে স্থিরিকৃত আয়কর অধিক পরিমাণে আহরণের একটা অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, এ চার অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫-এ উন্নীত হয়েছে, আর সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০-এর কাছাকাছি। আয়করকে দেশের উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি করতে হলে আরও জোরে চালাতে হবে পা। চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ।
বাংলাদেশে বিদ্যমান কর সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। দেশের আয়কর দেয়ার প্রেক্ষাপট দ্রুত উন্নত ও কার্যকর হওয়া দরকার। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত এখনও কম। এটি একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতিও নির্দেশ করে। জিডিপি এত হলে ট্যাক্স কম হয় কী করে? তার মানে, মানুষ ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছে না। আহরিত রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর আয়করের অবস্থান মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল তৃতীয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আহরিত মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬-৩৭ শতাংশ ছিল ভ্যাট, ৩৩-৩৪ শতাংশ কাস্টম ডিউটি (সম্পূরকসহ আমদানি শুল্ক) এবং ৩০-৩১ শতাংশ আয়করের অবদান। অথচ অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে, আয়কর হবে সর্বোচ্চ। অন্যগুলো থাকবে তার পরে। যে অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়, মানুষ এত সম্পদ ভোগ করতে পারে- তারা কেন আয়কর দেবে না? আয়কর তৃতীয় অবস্থানে থাকবে কেন? অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের এ ধরনের নাজুক কাঠামোর কারণে স্বাধীনতার পর ৪৩ বছরে দেশ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশী ঋণ এবং প্রায় ২৫.৫ বিলিয়ন ডলার অনুদান গ্রহণ করেছে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ পাহাড় সমান। বিদেশী ঋণের আসলের বর্ষিক কিস্তির পরিমাণ প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী ঋণের বার্ষিক সুদ পরিশোধে বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশই চলে যাচ্ছে। এরকম একটি অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে খাতওয়ারি অসমাঞ্জস্যতাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে আয়কর পরিস্থিতি উন্নয়নের বিকল্প নেই। আয়কর যথাযথভাবে দেয়া হলে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়বে, অসমাঞ্জস্যতাও দূর হবে। যে দেশের পাঁচ লক্ষাধিক লোক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারে, মাসে শত শত গাড়ি আমদানি হয়, সেখানে আয়কর থেকে এত কম রাজস্ব আসতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক।
কর মেলায় মানুষের উপচেপড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেয়াকে দায়িত্ব মনে করেন। তাদের এই আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে। তাদের এ দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। তাদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না। কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো যত্নবান হওয়ার নজীর ছিল না। এখন এসব সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments