নিকট অতীত ভুলে থাকা by সুভাষ সাহা

এইচএম এরশাদ সাবেক রাষ্ট্রপতি। তাকে নন্দিত মনে করেন কেউ কেউ, আবার অনেকের কাছে বিতর্কিতও। মাঝে মধ্যেই তিনি বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। সম্প্রতি তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে এক বিস্ফোরক বক্তব্য দিয়ে পুনরায় নিজের ওপর আলো ফেলেছেন।


বিডিআর বিদ্রোহের সময় তিনি সেনাপ্রধান থাকলে বিপুলসংখ্যক সেনাকর্তা হত্যার মতো মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটত না বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তিনি তো দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এমনকি সেনাপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন কি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি?
এটা ঠিক যে, তার প্রেসিডেন্সিতে উন্নয়ন ও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মতো যুগান্তকারী বিষয়গুলো অনেকে এখনও ভুলে যাননি। বরং যেদিকেই তাকানো যায় সড়ক-মহাসড়ক এবং কয়েকশ' মিনিটাউন তার আমলের উন্নয়ন কীর্তিকে জানান দেয়। তার মতো ভালো-মন্দের মিশেল রাজনৈতিক চরিত্র শুধু যে আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বেই দেখা যায় তা নয়। এরশাদ সাহেবের মতো চরিত্র (তার 'স্বৈরাচার' অভিধা বাদ দিলে) উন্নত দুনিয়ায়ও দেখা যায়। ইতালির বারলুসকুনি এ ক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ হতে পারে।
ইদানীং তিনি অবশ্য নিজেকে জাতির ত্রাতার ভূমিকায় উপস্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে বিভিন্ন সময়ে পেণ্ডুলামের মতো রাজনৈতিক দোল খাওয়ায় তার অভ্যাসের কারণে তিনি বাঁয়ে না ডাইনে সেটা মানুষ ঠাওর করে উঠতে পারে না। সেই তিনি 'কোনোমতেই ইসলামের ঝাণ্ডা ত্যাগ করব না'_ এমন অঙ্গীকার সময়ে-অসময়ে করে চলেছেন। অবশ্য এটা তিনি বলতেই পারেন। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অন্তর্ভুক্তি তার সময়েই হয়েছে। তাই নিজেকে ইসলামের খেদমতগার প্রতিপন্ন করাটা এরশাদ সাহেবের জন্য বেমানান নয়। কিন্তু এরশাদ সাহেব যখন বলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের মতো মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটতে পারত না, তখন খটকা লাগে। তিনি তো ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমানের যখন সেনাপ্রধান তখন উপ-সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের কথিত সেনা বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শয়ে শয়ে সেনা কর্মকর্র্তা ও জওয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে তার কোনো দায়দায়িত্ব নেই? দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া যখন চট্টগ্রামে নিহত হন তখন তো এরশাদ সাহেব নিজেই সেনাপ্রধান ছিলেন। কই তিনি তো সে নির্মম হত্যাকাণ্ডকে রোধ করেননি বা করতে পারেননি! ওই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে যেসব সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তার বিচার নিয়েও অনেক প্রশ্ন। হতভাগ্য সেনা কর্মকর্তাদের অধিকাংশ আদৌ ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন কি-না, নাকি সাজানো মামলায় মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে_ তা একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে। যে সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ডকে রোধ করতে পারেননি, তার মুখে কি এ ধরনের মন্তব্য মানায়? আসলে দেশে যখন একটি রাজনৈতিক সংকট ঘনায়মান, তখন এরশাদ সাহেব এর সুযোগ নিয়ে নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা ও সব মুশকিল আসানকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। এতে শেষ বয়সে তার ভাগ্যের শিকা ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে এমনটা মনে করতে পারেন তিনি। অনেকে যেমন আর একটি এক-এগারোর মতো ঘটনার জন্য হাপিত্যেশ করে মরছেন, তেমন আর কি! যাই হোক, সাবেক সেনাপ্রধান হয়ে বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে তিনি শেষবেলায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা তারই গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধতে পারে। এত বড় একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশ, গণতান্ত্রিক রাজনীতি, এমনকি সেনাবাহিনীরও উপকারে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.