শুভ জন্মদিন মামুনুর রশীদ by আবু সাঈদ খান
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বদলে দিয়েছে। জাতিকে করেছে নতুন চেতনায় শাণিত। স্বাধীনতা-উত্তর পটভূমিতে আমাদের রাজনীতি-সংস্কৃতির নানা শাখার যে নবউত্থান শুরু হয়, তার মর্মমূলেও ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ সময় যুদ্ধফেরত একঝাঁক সাহসী তরুণের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল নাটকের মঞ্চ ।
নাটক তখন সর্বত্র আলোড়ন তুলেছিল_ কখনও হলঘরে, কখনও খোলা প্রাঙ্গণে, কখনও-বা রাজপথে। নাটক তখন নতুন সমাজ গড়ার হাতিয়ার। নাটক চর্চা এখানে নাট্য আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
নতুন চেতনায়, নতুন আঙ্গিকে সূচিত নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎদের একজন মামুনুর রশীদ। তিনি একাধারে সংগঠক, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, এখানে নোঙর, গিনিপিগ, জয়জয়ন্তী, সংক্রান্তি, রাঢ়াং, চে'র সাইকেল_ বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক উভয় ক্ষেত্রেই নাট্য আন্দোলনে অনন্য সংযোজন। নাটক লিখেই তিনি থেমে থাকেন না; নির্দেশনা থেকে প্রযোজনা_ সব কাজের কাজেই তার চূড়ান্ত পারদর্শিতা। অভিনয়ে তার জনপ্রিয়তার সাক্ষী অগণিত দর্শক-ভক্ত। তিনি চরিত্রের সঙ্গে বদলে যান; হাজির হতে পারেন নতুন রূপে। 'ওরা কদম আলী'র অভিনেতা বিস্ময়করভাবে নিজেকে বদলে নেন বিদ্যাসাগর কিংবা চে'র মতো ঐতিহাসিক চরিত্রেও।
টেলিভিশনের পর্দায় তার নিত্য উপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়_ টেলিভিশনের বাক্সে যারা আসন পান, তাদের খুব কমই ফিরে আসেন মঞ্চে কিংবা সংগ্রামের রাজপথে। তাদের অনেকেই পা বাড়ান না গ্রামের মেঠোপথে। কিন্তু এই আরণ্যককে টেলিভিশন আটকে রাখতে পারেনি। তিনি সেখান থেকে বারবার ছুটে আসেন সংগ্রামের মঞ্চে। নাটক তার কাছে বরাবরই সমাজ বদলের হাতিয়ার।
আমি মামুনুর রশীদের টেলিভিশনে উপস্থিতিকে ছোট করে দেখছি না। টেলিভিশন এমনকি চলচ্চিত্র অঙ্গনেও তাকে নিয়মিত দেখতে চাই। নিশ্চয়ই তিনি সেখানে যাবেন, তবে গা ভাসাতে নয়, পরিবর্তনের বাণী বহন করেই। স্বাধীনতা-উত্তরকালে মামুনুর রশীদ ও তার সতীর্থরা যখন নাট্য অঙ্গনে নতুন আলোড়ন তুলেছিলেন, তখনও তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। সে পটভূমিতে আমরা সমাজ পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে কখনও রাজপথের সংগ্রামে, কখনও আত্মগোপনে। ১৯৭৬ থেকে ক'বছর কারাগারের নির্জন কক্ষে বসবাসের সুযোগে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলোর খবর জেনেছি, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি নাট্য আন্দোলনে মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সেলিম আল দীন, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, ফেরদৌসী মজুমদার, ম হামিদ, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকের কথা।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আশির দশকের প্রথমে 'ওরা কদম আলী' দেখে প্রাণিত হলাম। কদম আলীর বোবাকান্না যেন আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তখন থেকে মামুনুর রশীদের প্রতি আদর্শিক টান অনুভব করি। এরপর একে একে তার অনেক নাটক দেখা হয়েছে, ব্যক্তিগত নৈকট্যও বেড়েছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম প্রায়ই মিলিত হয় এক মোহনায়। রাজনৈতিক কর্মী আর সংস্কৃতিকর্মীদের হাঁটতে হয় এক মিছিলে। এভাবে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মামুনুর রশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। মামুন ভাই নাটকের অঙ্গনে সদা সক্রিয়, আমার কর্মক্ষেত্র সংবাদপত্র। পরস্পরের প্রয়োজনে কথা হয়, তবে সব কথা ছাড়িয়ে প্রাধান্য পায় রাজনীতি ও মানুষের পরিবর্তন প্রসঙ্গ। বয়সে আমার চেয়ে বড় হলেও তার কথাবার্তায় বড়র ভারিক্কি নেই। সদা হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী এই লোকটিকে মনে হয় আবাল্য বন্ধু। নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠকের পরিচয়ের আড়ালে এক সংবেদনশীল মামুনুর রশীদকেই আমরা বেশি চিনি_ যিনি মানুষের দুঃখে কাঁদেন, পাশে এসে দাঁড়ান। এ মানবিক বোধের কারণেই সংস্কৃতিকর্মীদের তিনি অভিভাবক।
মার্কসবাদী চিন্তার ধারক মামুনুর রশীদের চোখে এখনও পরিবর্তনের স্বপ্ন, নতুন এক সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু প্রগতিশীল রাজনীতির অঙ্গনে যখন হতাশা আর নির্জীবতা নেমে এসেছে, তখন নাটক কি পারবে জাগরণী গান শোনাতে? এ প্রশ্ন তোলা থাকুক।
আজ বরং মধুর এক প্রসঙ্গের অবতারণা করে শেষ করতে চাই। ২৯ ফেব্রুয়ারি মামুনুর রশীদের ৬৫তম জন্মদিন। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন, মামুন ভাই।
নতুন চেতনায়, নতুন আঙ্গিকে সূচিত নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎদের একজন মামুনুর রশীদ। তিনি একাধারে সংগঠক, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, এখানে নোঙর, গিনিপিগ, জয়জয়ন্তী, সংক্রান্তি, রাঢ়াং, চে'র সাইকেল_ বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক উভয় ক্ষেত্রেই নাট্য আন্দোলনে অনন্য সংযোজন। নাটক লিখেই তিনি থেমে থাকেন না; নির্দেশনা থেকে প্রযোজনা_ সব কাজের কাজেই তার চূড়ান্ত পারদর্শিতা। অভিনয়ে তার জনপ্রিয়তার সাক্ষী অগণিত দর্শক-ভক্ত। তিনি চরিত্রের সঙ্গে বদলে যান; হাজির হতে পারেন নতুন রূপে। 'ওরা কদম আলী'র অভিনেতা বিস্ময়করভাবে নিজেকে বদলে নেন বিদ্যাসাগর কিংবা চে'র মতো ঐতিহাসিক চরিত্রেও।
টেলিভিশনের পর্দায় তার নিত্য উপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়_ টেলিভিশনের বাক্সে যারা আসন পান, তাদের খুব কমই ফিরে আসেন মঞ্চে কিংবা সংগ্রামের রাজপথে। তাদের অনেকেই পা বাড়ান না গ্রামের মেঠোপথে। কিন্তু এই আরণ্যককে টেলিভিশন আটকে রাখতে পারেনি। তিনি সেখান থেকে বারবার ছুটে আসেন সংগ্রামের মঞ্চে। নাটক তার কাছে বরাবরই সমাজ বদলের হাতিয়ার।
আমি মামুনুর রশীদের টেলিভিশনে উপস্থিতিকে ছোট করে দেখছি না। টেলিভিশন এমনকি চলচ্চিত্র অঙ্গনেও তাকে নিয়মিত দেখতে চাই। নিশ্চয়ই তিনি সেখানে যাবেন, তবে গা ভাসাতে নয়, পরিবর্তনের বাণী বহন করেই। স্বাধীনতা-উত্তরকালে মামুনুর রশীদ ও তার সতীর্থরা যখন নাট্য অঙ্গনে নতুন আলোড়ন তুলেছিলেন, তখনও তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। সে পটভূমিতে আমরা সমাজ পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে কখনও রাজপথের সংগ্রামে, কখনও আত্মগোপনে। ১৯৭৬ থেকে ক'বছর কারাগারের নির্জন কক্ষে বসবাসের সুযোগে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলোর খবর জেনেছি, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি নাট্য আন্দোলনে মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সেলিম আল দীন, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, ফেরদৌসী মজুমদার, ম হামিদ, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকের কথা।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আশির দশকের প্রথমে 'ওরা কদম আলী' দেখে প্রাণিত হলাম। কদম আলীর বোবাকান্না যেন আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তখন থেকে মামুনুর রশীদের প্রতি আদর্শিক টান অনুভব করি। এরপর একে একে তার অনেক নাটক দেখা হয়েছে, ব্যক্তিগত নৈকট্যও বেড়েছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম প্রায়ই মিলিত হয় এক মোহনায়। রাজনৈতিক কর্মী আর সংস্কৃতিকর্মীদের হাঁটতে হয় এক মিছিলে। এভাবে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মামুনুর রশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। মামুন ভাই নাটকের অঙ্গনে সদা সক্রিয়, আমার কর্মক্ষেত্র সংবাদপত্র। পরস্পরের প্রয়োজনে কথা হয়, তবে সব কথা ছাড়িয়ে প্রাধান্য পায় রাজনীতি ও মানুষের পরিবর্তন প্রসঙ্গ। বয়সে আমার চেয়ে বড় হলেও তার কথাবার্তায় বড়র ভারিক্কি নেই। সদা হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী এই লোকটিকে মনে হয় আবাল্য বন্ধু। নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠকের পরিচয়ের আড়ালে এক সংবেদনশীল মামুনুর রশীদকেই আমরা বেশি চিনি_ যিনি মানুষের দুঃখে কাঁদেন, পাশে এসে দাঁড়ান। এ মানবিক বোধের কারণেই সংস্কৃতিকর্মীদের তিনি অভিভাবক।
মার্কসবাদী চিন্তার ধারক মামুনুর রশীদের চোখে এখনও পরিবর্তনের স্বপ্ন, নতুন এক সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু প্রগতিশীল রাজনীতির অঙ্গনে যখন হতাশা আর নির্জীবতা নেমে এসেছে, তখন নাটক কি পারবে জাগরণী গান শোনাতে? এ প্রশ্ন তোলা থাকুক।
আজ বরং মধুর এক প্রসঙ্গের অবতারণা করে শেষ করতে চাই। ২৯ ফেব্রুয়ারি মামুনুর রশীদের ৬৫তম জন্মদিন। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন, মামুন ভাই।
No comments