বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ প্রসঙ্গ by ড. তুহিন ওয়াদুদ

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষাজীবনে আমাদের প্রত্যেককে নামকরণের সার্থকতা শীর্ষক প্রশ্নোত্তর শিখতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণের সার্থকতা কতখানি সার্থক, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।


বর্তমানে নতুন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে সেখানে নামকরণের সার্থকতা খুব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। নামকরণ নিয়ে আমাদের দেশে প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সার্থকতা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটায়ই না আছে তাঁকে নিয়ে চর্চা করার সুযোগ, না আছে তাঁর আদর্শ নিয়ে চর্চা করার সুযোগ। তিনি আইন বিষয়ের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু উলি্লখিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। এমনকি ভাষা, রাজনীতি ও ইতিহাসচর্চারও সুযোগ সেখানে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, তা নিয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ উলি্লখিত বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। দেশে এখন সুস্থ ধারার রাজনীতির বড় অভাব। তাঁর নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থধারার রাজনীতি গড়ে তোলার একটি অনুশীলনের পথপরিক্রমা তৈরি হতে পারত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় রাজনৈতিক-জীবন কিংবা তাঁর যে আদর্শ_ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় এবং সবার ওপরে মানুষ সত্য, এ বোধের সম্মিলন, জ্ঞান-প্রজ্ঞার বিকাশ সাধন, এরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে হতো, তাহলে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণের সার্থকতা থাকত। তাঁর নামে ঢাকায় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, জন্মজেলা গোপালগঞ্জে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তার নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করে। রংপুর রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের জন্মজেলা হিসেবে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতেই পারে। শুধু রংপুর কেন, সারা দেশের যেকোনো জায়গায়ই হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভুল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে? এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন তাঁর নামের আগে কখনোই বেগম শব্দটি ব্যবহার করতেন না। বাংলার মুসলিম নারীমুক্তির পথনির্মাতা হিসেবে খুব সচেতনভাবেই তিনি বেগম শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু বেগম শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকাশনী যে রোকেয়াসমগ্র প্রকাশ করেছে, সেখানেও ভুল নামে প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো গবেষকও এই ভুল থেকে দূরে থাকেননি। যখন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হলো, তখন তৎকালীন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্য কেউ তা জানতেন না। এরূপ ভুল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জানলে নিশ্চয়ই ঠিক নামের কথা অনেকেই তুলতেন।
রংপুরে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের নামে স্কুল, সরকারি-বেসরকারি কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের নামে কলেজে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পাঠদান করানো হয়, কারমাইকেল কলেজে তাঁর নামে ছাত্রীনিবাস আছে, সারা দেশেই তাঁর নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রংপুরে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় না হলেও তিনি রংপুরে উপেক্ষিত ছিলেন না। তার পরও যেহেতু যাঁর নামে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলো, তা ভুল নামে কেন? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী জুলফিকার মতিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া দিবসের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, 'এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আসব না। আসা উচিত নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ ঠিক হয়নি, সেখানে আসতে ইচ্ছে করে না।' রংপুরের বাইরে কোথাও নিজের পরিচয় দিলে তাঁরা বলেন, ভুল নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদের উপস্থিতিতে ভুল নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছিল। তিনি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি না আমরা জানি না। তবে আজ হোক কাল হোক, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে তা শুদ্ধ নামে করতেই হবে। ভুল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। এরই মধ্যে রংপুরে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং একটি সাইনবোর্ডও চোখে পড়ছে। এখন যদি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয় সংকটে পড়বে। কিছুদিন আগে সরকার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করেছে। ফলে এখনো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতিকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। এখনো পরিচয় দেওয়ার সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বলার পর আবার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তিত নামটি পরিষ্কার করে বলতে হয়। সে ক্ষেত্রে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় দুটোই পরিচিতি বিভ্রাটে পড়বে। সেদিকটি বিবেচনা করলে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না দিয়ে যেন অন্য কোনো নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ যত সাধারণ বিষয়ই হোক না কেন, এর অসুবিধাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি অর্থপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হোক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সংশোধন করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক এবং রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একটি বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ রোধ করা হোক।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.