রবার্ট ফিস্ক-লাদেন নিহত : নানা প্রশ্ন
ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও কোন কারণে আফগানিস্তানে নৃশংস বিমান হামলা হলো? সেখানে হামলায় আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু লোক হতাহত হয়েছে। হাজার হাজার তালেবানের বিষয়টি আমরা সেভাবে খেয়াল করিনি।
কারণ তারা আল-কায়েদা সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ দেখাতে চায় না, যত না পশ্চিমা সৈন্যদের তাদের দেশ ছাড়ার ব্যাপারে উৎসাহী। হামিদ কারজাই এবং হিলারি ক্লিনটন মনে হয় খুবই আশাবাদী হয়েছেন যে বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তালেবানরা নেতিয়ে পড়বে এবং তারা পশ্চিমা শাসকদের তোষক ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের সঙ্গে হাত মিলাবে। আর দেশের রক্তভেজা এ ঘটনার পর তারা কিভাবে অনুভূতিহীন থেকে যাবে, তা-ও দেখার বিষয়। তালেবানদের একটি গোষ্ঠী আছে, যারা বিন লাদেনকে অনুসরণ করলেও তাঁকে ভালোবাসে না। এবং ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণায়ও তারা নেই। বিন লাদেনের চেয়ে পশ্চিম আফগানিস্তানে মোল্লা ওমর অনেক বেশি ভয়ংকর। কিন্তু আমরা ওমরকে হত্যা করিনি।
লাখ লাখ আরবের পক্ষে ইরান মন্তব্য করেছে বিন লাদেনের মৃত্যুর পর। তারা বলেছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন বাতিল ঘোষণা করা উচিত। দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা আশা করি, এই পরিবর্তনের কারণে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করি, এতে দ্বন্দ্ব, অস্থিতিশীলতা এবং নিরীহ জনগণের মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো বাদ হয়ে যাবে। এ অঞ্চলে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করবে। আরব বিশ্বের সংবাদমাধ্যমেও তা-ই বলা হয়েছে। এটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় বিজয় হয়ে থাকে, তাহলে তাদের এখনই সময় এসেছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার। তবে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করবে_এ রকম কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই মনে করে, কিছুই বদল হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিমালা গ্রহণ করেছে, তাতে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এটা সত্য, তিউনিসিয়া ও মিসরে যে বিপ্লব হয়ে গেছে, তাতে বড় সর্বপ্রাপ্তি ঘটে গেছে। লিবিয়ায় রক্ত ঝরছে। আর সিরিয়া-লেবাননে এর চেয়ে বেশি দুরবস্থা বিরাজ করছে।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ইস্তাম্বুলে গতকাল (৩ মে) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি সিরিয়ায় সাধারণ মানুষ হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। আর গাদ্দাফিকে বলেছেন লিবিয়া ত্যাগ করতে। তাঁর এই বক্তব্য ছিল অত্যন্ত জোরালো। ক্লিনটন এবং ওবামার গত সোমবারের ভাষণ উল্লেখযোগ্য, 'জাওয়াহিরি, নাকি সাইফ আল-আদেল আল-কায়েদার নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন_এমন চিন্তা করে আমরা খামোখা সময় নষ্ট করছি। আর এই যে আন্দোলন, সেখানে লাদেন নেতা ছিলেন ঠিকই, প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে বসসুলভ কোনো বিষয় ছিল না।'
কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পর মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাত হওয়ার ব্যাপারটি লক্ষণীয়। প্রশ্ন আসতে পারে এসব ঘটনা নিয়ে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ওবামা যদি মনে করে থাকেন, বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পৃথিবী সুখ এবং নিরাপদ জায়গা হিসেবে গণ্য হবে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম হতেই পারে। এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তাদের দূতাবাস ও স্থাপনাগুলোতে কোন কারণে নিরাপত্তাব্যবস্থা স্মরণাতীতকালের মধ্যে কঠোরতর করেছে? সেখানে তো স্পষ্ট করে বলেই দেওয়া হয়েছে, এই নিরাপত্তা জোরদার করার কারণ হচ্ছে, যাতে সেগুলো আক্রমণের শিকার না হয়।
সেই কম্পাউন্ডে কী ঘটেছিল, যখন লাদেনের প্রাণ চলে যায়? মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান যদি প্রশ্ন করে সুষ্ঠু তদন্ত সম্পাদনের জন্য, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পেন্টাগন সূত্রে প্রাপ্ত প্রাথমিক খবরে জানা গেছে, বিন লাদেনের দুই স্ত্রী সেই অভিযানে নিহত হয়েছেন। একজন নারী মানববর্ম তৈরি করেছিলেন লাদেনকে রক্ষা করার জন্য। তিনিও সেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জানা গেল, বিন লাদেনের স্ত্রীরা জীবিত আছেন, শুধু তৃতীয় সেই মহিলাই মারা গেছেন।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে। পাকিস্তান বিন লাদেনকে আক্রমণের সময় সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু ৩ মে আসিফ আলী জারদারি ভিন্ন কথা বললেন। তিনি বললেন, পাকিস্তান সেই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেনি। এক দিনের মধ্যে সব কিছু কেমন বদলে গেল। এর দুই ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা ঘোষণা করলেন, এই বিজয় আমাদের যৌথ অর্জন।
লাদেনকে গোপনীয়তা রক্ষা করে আরব সাগরে সমাহিত করার ব্যাপারটিও উল্লেখ করতে হবে। এটা কি আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে তাঁকে ধরার চেয়ে হত্যা করে ফেলতে হবে? যদি তা ইসলামী রীতি অনুযায়ী করা হয়ে থাকে, তাহলে দীর্ঘ সময় লাগার কথা। ইসলামী বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাতে হয়। এরপর তাকে সাদা কাপড়ের কাফন পরাতে হয়। কিন্তু লাদেনের লাশ যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসনে দাফনের প্রস্তুতিকর্মটি সম্পাদন করতে মোট সময় নিয়েছে ৫০ মিনিট, যা একজন আরবিভাষী নাবিক দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকৃত সত্য বলতে হলে_লাদেনের মৃত্যুর কারণে পৃথিবী নিরাপদ হয়ে গেছে, এমনটি বলার কোনো কারণ নেই। তবে আরেকটি কারণ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ঘটছে। সেখানে স্বাধীনতার যে বাতাস বইতে শুরু করেছে, তা-ই সেই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। পশ্চিমা দুনিয়া যদি এ অঞ্চলের জনগণকে বন্দুকের পরিবর্তে সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করে, তাহলে আল-কায়েদা সেখানে খুব একটা বড় ব্যাপার হবে না।
তবে আরব বিশ্বের জন্য একটা সুখবর আছে। গাদ্দাফি, আসাদ এবং সালেহ কিন্তু অন্য চিন্তা করতে শুরু করেছেন।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
লাখ লাখ আরবের পক্ষে ইরান মন্তব্য করেছে বিন লাদেনের মৃত্যুর পর। তারা বলেছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন বাতিল ঘোষণা করা উচিত। দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা আশা করি, এই পরিবর্তনের কারণে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করি, এতে দ্বন্দ্ব, অস্থিতিশীলতা এবং নিরীহ জনগণের মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো বাদ হয়ে যাবে। এ অঞ্চলে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করবে। আরব বিশ্বের সংবাদমাধ্যমেও তা-ই বলা হয়েছে। এটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় বিজয় হয়ে থাকে, তাহলে তাদের এখনই সময় এসেছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার। তবে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করবে_এ রকম কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই মনে করে, কিছুই বদল হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিমালা গ্রহণ করেছে, তাতে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এটা সত্য, তিউনিসিয়া ও মিসরে যে বিপ্লব হয়ে গেছে, তাতে বড় সর্বপ্রাপ্তি ঘটে গেছে। লিবিয়ায় রক্ত ঝরছে। আর সিরিয়া-লেবাননে এর চেয়ে বেশি দুরবস্থা বিরাজ করছে।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ইস্তাম্বুলে গতকাল (৩ মে) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি সিরিয়ায় সাধারণ মানুষ হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। আর গাদ্দাফিকে বলেছেন লিবিয়া ত্যাগ করতে। তাঁর এই বক্তব্য ছিল অত্যন্ত জোরালো। ক্লিনটন এবং ওবামার গত সোমবারের ভাষণ উল্লেখযোগ্য, 'জাওয়াহিরি, নাকি সাইফ আল-আদেল আল-কায়েদার নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন_এমন চিন্তা করে আমরা খামোখা সময় নষ্ট করছি। আর এই যে আন্দোলন, সেখানে লাদেন নেতা ছিলেন ঠিকই, প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে বসসুলভ কোনো বিষয় ছিল না।'
কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পর মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাত হওয়ার ব্যাপারটি লক্ষণীয়। প্রশ্ন আসতে পারে এসব ঘটনা নিয়ে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ওবামা যদি মনে করে থাকেন, বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পৃথিবী সুখ এবং নিরাপদ জায়গা হিসেবে গণ্য হবে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম হতেই পারে। এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তাদের দূতাবাস ও স্থাপনাগুলোতে কোন কারণে নিরাপত্তাব্যবস্থা স্মরণাতীতকালের মধ্যে কঠোরতর করেছে? সেখানে তো স্পষ্ট করে বলেই দেওয়া হয়েছে, এই নিরাপত্তা জোরদার করার কারণ হচ্ছে, যাতে সেগুলো আক্রমণের শিকার না হয়।
সেই কম্পাউন্ডে কী ঘটেছিল, যখন লাদেনের প্রাণ চলে যায়? মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান যদি প্রশ্ন করে সুষ্ঠু তদন্ত সম্পাদনের জন্য, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পেন্টাগন সূত্রে প্রাপ্ত প্রাথমিক খবরে জানা গেছে, বিন লাদেনের দুই স্ত্রী সেই অভিযানে নিহত হয়েছেন। একজন নারী মানববর্ম তৈরি করেছিলেন লাদেনকে রক্ষা করার জন্য। তিনিও সেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জানা গেল, বিন লাদেনের স্ত্রীরা জীবিত আছেন, শুধু তৃতীয় সেই মহিলাই মারা গেছেন।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে। পাকিস্তান বিন লাদেনকে আক্রমণের সময় সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু ৩ মে আসিফ আলী জারদারি ভিন্ন কথা বললেন। তিনি বললেন, পাকিস্তান সেই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেনি। এক দিনের মধ্যে সব কিছু কেমন বদলে গেল। এর দুই ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা ঘোষণা করলেন, এই বিজয় আমাদের যৌথ অর্জন।
লাদেনকে গোপনীয়তা রক্ষা করে আরব সাগরে সমাহিত করার ব্যাপারটিও উল্লেখ করতে হবে। এটা কি আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে তাঁকে ধরার চেয়ে হত্যা করে ফেলতে হবে? যদি তা ইসলামী রীতি অনুযায়ী করা হয়ে থাকে, তাহলে দীর্ঘ সময় লাগার কথা। ইসলামী বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাতে হয়। এরপর তাকে সাদা কাপড়ের কাফন পরাতে হয়। কিন্তু লাদেনের লাশ যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসনে দাফনের প্রস্তুতিকর্মটি সম্পাদন করতে মোট সময় নিয়েছে ৫০ মিনিট, যা একজন আরবিভাষী নাবিক দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকৃত সত্য বলতে হলে_লাদেনের মৃত্যুর কারণে পৃথিবী নিরাপদ হয়ে গেছে, এমনটি বলার কোনো কারণ নেই। তবে আরেকটি কারণ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ঘটছে। সেখানে স্বাধীনতার যে বাতাস বইতে শুরু করেছে, তা-ই সেই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। পশ্চিমা দুনিয়া যদি এ অঞ্চলের জনগণকে বন্দুকের পরিবর্তে সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করে, তাহলে আল-কায়েদা সেখানে খুব একটা বড় ব্যাপার হবে না।
তবে আরব বিশ্বের জন্য একটা সুখবর আছে। গাদ্দাফি, আসাদ এবং সালেহ কিন্তু অন্য চিন্তা করতে শুরু করেছেন।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments