ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়-আন্তনদী সংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ by ম. ইনামুল হক

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ভারতের আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সমগ্র দেশবাসীকে এর সুফল দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে কাপাডিয়া, বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক ও বিচারপতি সতান্তর কুমারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০০২ সালের এ সংক্রান্ত


একটি মামলার রায় দিয়ে এই কথা বলেন। তাঁরা বলেন, বিশেষ কমিটি প্রতি দুই বছর অন্তর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট কেন্দ্রে দাখিল করবে, যার ভিত্তিতে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। বেঞ্চ বলেন, এটি একটি জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিষয়। আমরা কোনো কারণ দেখি না, কেন রাজ্যগুলো নদী-সংযোগ প্রকল্পটির সফলতার জন্য পিছিয়ে থাকবে, যখন এই প্রকল্প খরায় পীড়িত মানুষদের ক্ষুধামুক্ত করবে ও বন্যাপীড়িত মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্ত করবে। (দ্য হিন্দু, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২)।
আন্তনদী-সংযোগ বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ বাংলাদেশের জনগণের কাছে একটি গুরুতর অশনিসংকেত ছাড়া আর কিছুই নয়। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এমনিতেই টানাপোড়েন চলছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গঙ্গার পানি নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্য; যেখানে তিনি ফারাক্কা ব্যারাজের দুটি গেট নষ্ট করে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে ১৯৯৬ সালের চুক্তির অতিরিক্ত পানি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ এনেছেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি এখন বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত (বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত তিন হাজার ৫০০ মিলিমিটার) থেকে পানি খাল কেটে সরিয়ে নিয়ে পশ্চিম ভারতে (বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৭০০ মিলিমিটার) দেওয়ার কাজে এগোয় তাহলে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে। তবে ভারতও যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বস্তির মধ্যে থাকবে, তা নয়। কারণ ভারতের আন্তনদী প্রকল্পটি আসাম থেকে উত্তর প্রদেশব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রাজস্থান, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের জনগণকে লাভবান করবে বিধায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণ এতে বাধা দেবে। এই প্রকল্পে পরিবেশের ক্ষতির কথা বলাই বাহুল্য।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভারতের পরিকল্পনাবিদেরা দেশব্যাপী আন্তনদী-সংযোগের প্রস্তাব করেন। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইনডাস ওয়াটারস ট্রেটি (Indus Waters Treaty) স্বাক্ষরিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে কোনো সমঝোতা বাদেই ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭৫ সালে এই ব্যারাজ চালু করে পানি প্রত্যাহার শুরু হলে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৭৭ সালের প্রথম পানি বণ্টন চুক্তিতে পানির যে ভাগাভাগি হয়, তা ভারতের কাছে চূড়ান্তভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ ওই চুক্তিতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবরাহের গ্যারান্টি দেওয়া ছিল। এর পরই ভারত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি এনে গঙ্গা নদীতে ফেলা তথা আন্তনদী-সংযোগ প্রস্তাব করতে থাকে। ভারতের প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে একটি খাল কেটে ফারাক্কার উজানে ফেলতে হবে। কিন্তু এতে লাখ লাখ মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে হতো এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটত। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। ফলে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর পার হলে আর নতুন চুক্তি হয়নি।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে শুকনো মৌসুমে গঙ্গা নদীর ঐতিহাসিক গড়প্রবাহ ছিল প্রায় এক লাখ কিউসেক। ১৯৭৭ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ন্যূনতম ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি সরবরাহের গ্যারান্টি ছিল। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে সর্বনিম্ন ২৭ হাজার ৬৩৩ কিউসেক পানি দেওয়ার কথা বলা হলো কিন্তু কোনো গ্যারান্টি দেওয়া হলো না। এরপর ১৯৯৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এলে ভারতের আন্তনদী-সংযোগ পরিকল্পনাটি নিয়ে পুনরায় তৎপরতা শুরু হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অখণ্ড ভারত ও হিন্দুত্বের জিগির এবং দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহে পরিকল্পনাটি অচিরেই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাদ সাধলেন বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যের জনগণ ও বুদ্ধিজীবীরা। মোট ৩০টি ক্যানেল সিস্টেমের এই পরিকল্পনায় তাদের তো কোনো উপকার নেই-ই, বরং আছে কোটি কোটি মানুষের উচ্ছেদ আর পরিবেশের বিপর্যয়।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা: আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের শুরু আসামের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। এই নদের পানি অন্যত্র সরাতে হলে গৌহাটি অথবা গোয়ালপাড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করতে হবে। এই ব্যারাজ আসামের বন্যার পানি দ্রুত সরে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে। তা ছাড়া পানি সরাতে সংযোগ প্রকল্পের ১৪ নম্বর খালটির মাধ্যমে আসামের বরপেটা, কোকড়াঝড় ও ধুবড়ি জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা এই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ এবং পরিবেশবিপর্যয় হবে।
পশ্চিমবঙ্গ: আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের ১ নম্বর খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি এই অঞ্চল দিয়ে নিতে হলে প্রায় ১০০ মিটার উঁচুতে তুলে ডুয়ার্সের উচ্চভূমি দিয়ে পার করতে হবে। এটি অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহ জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা এই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশের বিপর্যয় হবে। ব্রহ্মপুত্র থেকে গঙ্গায় আনা পানি ১০ নম্বর সংযোগ খালের মাধ্যমে বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলাগুলোর ওপর দিয়ে খাল কেটে দক্ষিণ ভারতে নেওয়া হবে, যা এই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশের বিপর্যয় হবে। তা ছাড়া দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সংগৃহীত পানির সিংহভাগই বাষ্পীভবন হয়ে উবে যাবে।
বিহার সমভূমি: বিহারের নদীগুলোতে যে পানি আছে, তা এই এলাকার জন্য যথেষ্ট। আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের ১২, ২ ও ৩ নম্বর খালের মাধ্যমে মেচি ও কোশি নদীর পানি বিহারের তরাই অঞ্চল দিয়ে এবং গন্ডক নদীর পানি সমভূমির ওপর দিয়ে গঙ্গায় ফেলা হবে। এতে এসব নদীর অববাহিকার জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা এই এলাকার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশের বিপর্যয় হবে।
বাংলাদেশ: বাংলাদেশে শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে, যার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের কৃষি ও জীব পরিবেশ গড়ে উঠেছে। অতএব এর একটা বিরাট অংশ ভারতের পশ্চিমে চালান করলে বাংলাদেশে পরিবেশের বিশাল বিপর্যয় হবে। সমুদ্রের লবণাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতীর কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ এবং মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। মিঠা পানির অভাবে সারা দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার ভূতল জীব ও জনজীবন অভূতপূর্ব বিপদের মুখে পড়বে। মোহনা এলাকার জীববৈচিত্র্য, মৎস্য ও জলসম্পদ বিপর্যস্ত হবে।
জনগণের আপত্তি সত্ত্বেও সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের প্রতি তেমন আপত্তি তোলা হয়েছে বলে জানা যায় না। ভারত যে সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তা নদীর গজলডোবা ব্যারাজের কাছে আসা তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার কিউসেক পানির সিংহভাগ সরিয়ে নিচ্ছে, সে ব্যাপারেও তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তিস্তার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণেই আমরা ভাটিতে দোয়ানীর কাছে মাত্র এক হাজার থেকে ৪০০ কিউসেক পানি পাচ্ছি। বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে হলে আমাদের তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা সড়কে যেতে হবে, যার পাশ দিয়ে মহানন্দা নদী প্রবাহিত। আমরা দেখব তিস্তার পানি এই নদীর মাধ্যমে চলে যাচ্ছে বিহারের মেচি নদীতে, সেখান থেকে ফুলহার নদের মাধ্যমে ফারাক্কার উজানে। আমরা গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ভারতের এসব খাল ও স্থাপনাগুলো সহজেই দেখতে পারি। ভারত মেচি নদীতে একটি ব্যারাজ নির্মাণ করছে, ফলে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে তার আন্তনদী-সংযোগ পরিকল্পনার অনেকটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ভারত ফাঁসিদেওয়ার কাছে একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে, যা তিস্তার ক্যানেলের পানি দিয়ে চালানো হয় এবং ওই পানি শেষমেশ বিহারের মেচি নদীতে চালান করা হয়।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.