বিপন্ন সুন্দরবন, বিপন্ন বাংলাদেশ by ড. মোহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণ ও দুর্নীতির কারণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে_এ রকম প্রতিবেদন ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। তবে ৩০ এপ্রিল ২০১১ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল থেকে সারা বিশ্বে একযোগে প্রকাশিত জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিশ্ব দুর্নীতি প্রতিবেদনে


এসব তথ্য-উপাত্ত নতুন করে বিশদ তুলে ধরা হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞাত হলাম, ১ মে ২০১১ তারিখে বাংলাদেশের প্রায় সব কয়টি জাতীয় দৈনিকে এই প্রতিবেদনের বরাতে বেশ কয়েকটি নতুন সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সুন্দরবনের যে চিত্র নতুন করে উপস্থাপিত হলো, তা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ এবং উদ্বেগজনক। এসব প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সুন্দরবন থেকে বছরে ১৩৫টি গাছ চুরি হয়। বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ একটি শক্তিশালী চক্র এই অপক্রিয়ায় লিপ্ত। অসাধু বন কর্মকর্তারা বাওয়ালিদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ছয় কোটি টাকা ঘুষ নেন এবং জেলেদের কাছ থেকে নেন প্রায় ২৩ কোটি টাকা! দুর্নীতি বাংলাদেশে কিভাবে জেঁকে বসেছে এটি এর একটিমাত্র নজির। আমাদের স্মরণে আছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের কথা। প্রবাসে বসেও আমরা প্রতিনিয়ত দুর্নীতিবিষয়ক যা জেনেছি তাতে আমাদের মাথা নুইয়ে গেছে। যদিও ওই শাসনামল নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে, কিন্তু দুর্নীতি যে বাংলাদেশের একটি বড় ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে তা তো অসত্য নয়।
সুন্দরবনকে প্রকৃতির প্রাচীরও বলা হয়। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের শক্তির পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয়_এটি গবেষণা থেকে জানা গেছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। সিডর ও আইলার ক্ষত এখনো বাংলাদেশ সেরে উঠতে পারেনি। অথচ এই প্রকৃতির প্রাচীরকে কতিপয় লোভী ও স্বেচ্ছাচারী কী রকমভাবে ভেঙে ফেলছে এবং এর বিরূপ প্রভাব ক্রমেই কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠছে, তা নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। সুন্দরবন এখন শুধু বিপন্নই নয়, সুন্দরবনের দুরবস্থা আমাদের জন্য বড় ধরনের অশনিশংকেত। আমরা জানি না, সুন্দরবনকে যারা খুবলে খুবলে খাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কতটা কী নেবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তার পরও আশা করব, যেহেতু মহাজোট সরকার পরিবর্তনের অঙ্গীকার করে বিপুল জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এবার অন্তত ভিন্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। যদিও এখন পর্যন্ত এ সরকারের অনেক অর্জন ম্লান হতে চলেছে অদূরদর্শিতা আর অপরিপক্ব কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে, তবুও দেশ-বিদেশের সিংহভাগ মানুষ (বাঙালি) এখনো মনে করেন সরকার ভুলগুলো শুধরে তাদের অঙ্গীকার পালনে সফল হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা আগামী দিনে অনেক বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অনেক বেশি। জলবায়ুর পরিবর্তন প্রতিহত করা এবং এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করা খুব দুরূহ ব্যাপার। এর মধ্যে দুর্নীতি যদি পথটাকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করে, তাহলে গত্যন্তরটা কী? দুর্নীতি এমন কোনো বিষয় নয় যে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে তা থামিয়ে দেওয়া যাবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার, প্রশাসন, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি।
সুন্দরবন মরতে বসেছে, একই সঙ্গে আমাদের নানাবিধ বিপদাশঙ্কা পুষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবন ক্রমেই বিপন্ন হওয়ার পেছনের কারণগুলো যেহেতু অজানা নয়, সেহেতু এর প্রতিকারে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াটাও দুরূহ বিষয় নয়। চাই শুধু দৃঢ় অঙ্গীকার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবার দায়বদ্ধতা। আমাদের রাজনীতিকরা কথা বলেন অনেক বেশি, অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি প্রদানে আরো এক ধাপ এগিয়ে; কিন্তু কাজের কাজ করেন না তেমন কিছু। এর অব্যাহত মাসুল গুনতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে অন্ধকারে সব ঢেকে যাবে_এটিই খুব স্বাভাবিক। আমরা জানি না সুন্দরবনের এ পরিস্থিতি দায়িত্বশীলদের কতটা কী ভাবাতে সক্ষম হবে। তবে এই অশনিশংকেত সম্পর্কে উদাসীন থাকলে চরম খেসারত দিতে হবে, এ নিয়ে সচেতন কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিছু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফল দেশবাসীকে ভোগ করতে হবে কেন? কেন তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির কারণে অসংখ্য মানুষ অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াবে? এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি, সুন্দরবন রক্ষায় সরকার, প্রশাসন ও দায়িত্বশীল সবাই নড়েচড়ে বসলেই মঙ্গল। আমরা আশা করব, দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে তাঁরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবেন।

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক

No comments

Powered by Blogger.