প্রতিবেশী-আঞ্চলিক সহযোগিতা কোন পথে by জিল্লুর রহমান খান
এমন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠিত হতে হবে, যাদের দায়িত্ব থাকবে মানব, বৈষয়িক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বই কেবল এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে চমৎকার নজির স্থাপন করেছেন।
ওই মহাদেশের দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে বিবাদ-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। এখন আর কেউ ওই পথে সমস্যা সমাধানের কথা ভাবে না। এ সংস্থা গঠনে বেলজিয়াম উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশও কিন্তু তেমন
উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে
বাংলাদেশের দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার। তিনটি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শে খুব একটা মিল পাওয়া যাবে না। জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নেও তাদের রয়েছে উদ্বেগ। কিন্তু চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে ফিরে গেলে ভিন্ন এক চিত্র আমরা দেখতে পাব। ভারতের নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা সমর্থন ও সহযোগিতা এবং সে সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনরত বার্মার নেতা উ থান্টের সক্রিয় সমর্থন ব্যতিরেকে এ সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতে পারত এবং আমাদের হয়তো আরও মূল্য দিতে হতো। এ প্রেক্ষাপট কোনোভাবেই ভুললে চলবে না। ভারতের সঙ্গে ভূখণ্ডগত সমস্যা রয়েছে আমাদের। সীমান্তে বিএসএফের অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও লোমহর্ষক নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে চলেছে। বাংলাদেশে এ নিয়ে ক্ষোভের মাত্রা সঙ্গতভাবেই ব্যাপক। একই সঙ্গে লক্ষ্য করছি ভারতের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজও বিএসএফের কাজে অসন্তুষ্ট। সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়েও রয়েছে দুই দেশে উদ্বেগ।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। তারপরও বলব, পারস্পরিক সহযোগিতার পথে চললে তিনটি দেশই উপকৃত হতে পারে। বিশেষ করে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে সমুদ্রসম্পদের অপরিমেয় ভাণ্ডারকে।
এ তিনটি দেশের সম্পর্কের কেন অবনতি ঘটল এবং কীভাবে তা বিপরীতমুখী করা যায়_ সেটা নিয়েই এ লেখা। ভূখণ্ড, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান, এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রানজিট রুট, চোরাচালান, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা_ এসব ইস্যু নিয়ে তিন দেশের উদ্বেগ রয়েছে। পরস্পর দোষারোপের মনোভাবেরও প্রকাশ ঘটে। এর পরিবর্তে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে প্রয়োজন প্রতিটি পর্যায়ে অব্যাহত ইতিবাচক যোগাযোগ ও আলোচনা। এ জন্য অপরিহার্য একটি শর্ত হচ্ছে_ গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাজনৈতিক পরিবেশ। আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে আমার অভিমত_ এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সহিষ্ণুতা এবং এমনকি বিপরীত মতের প্রতিও সম্মান দেখানো।
প্রথমেই আমরা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। পাকিস্তানের 'অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের' বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণ সফল যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পরিহাসের বিষয় যে, ১৯৪৬ সালের গণভোটে এই বাঙালিরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরঙ্কুশ রায় দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাত বছর পর বাঙালিরা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে। ততদিনে পূর্ব বাংলার জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এর ১৭ বছর পর, ১৯৭১ সালে বাঙালিরা পৌঁছায় অভীষ্ট লক্ষ্যে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশ। এ জন্য অবশ্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন পড়ে। এ সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে প্রায় এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের মাটিতে।
স্বাধীনতাউত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য বিপুল সুবিধা এনে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কালে ব্যাপক অপপ্রচার, বিশ্ব অর্থনীতিতে নিদারুণ সংকট, প্রভাব বাড়াতে পরাশক্তির দ্বন্দ্ব্বের পরিণতিতে ১৯৭৪ সালের বন্যা-পরবর্তী খাদ্য সংকটের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত খাদ্য সহায়তা আকস্মিকভাবে স্থগিত রাখা_ এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অশনি সংকেত দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেন। তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক সংকেত ধরা হলেও ভারতীয় নেতৃত্ব বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষুদ্র একদল সেনা অফিসারের হাতে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটলে ভারতীয় নেতৃত্বের হতাশা ও অবিশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়।
অভ্যুত্থানের সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ১৫ আগস্ট, যা ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মহান নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে শুধু শ্রদ্ধাই করতেন না, একই সঙ্গে মনে করতেন বন্ধু। মুজিব-পরবর্তী সামরিক শাসকদের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর অবিশ্বাসের কারণে বেশ কিছু জরুরি সমস্যা যেমন গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন, অফসোরে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধান ও আহরণ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রভৃতি ইস্যু অনিষ্পন্ন থেকে যায়। এসব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ছিল অপরিহার্য। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ায় বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের প্রতি নয়াদিলি্লর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। ইসলামী দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণেও ভারতের মনোভাব কঠোর হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে এসব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ক্ষমা প্রদর্শন এবং দালাল আইন প্রত্যাহার করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে, যাতে ইসলামী ঐক্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে তিনি বিরোধিতা না করেন। তার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল_ পাকিস্তানে আটকে পড়া সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার দায়ে অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের পরিণতিতে রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ক্ষমাপ্রাপ্তদের একটি অংশেরই এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে।
মুজিব হত্যার পর দুই দফায় সামরিক শাসন জারি হয়। এ সময় ক্ষমতাসীনরা রক্ষণশীল ও ভারতবিরোধী শক্তির মধ্যে সমর্থন জোরদারে ইসলামী দলগুলোকে ব্যবহার করতে থাকে। জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসিত করেন এবং তার মন্ত্রিসভায় ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থিদের স্থান করে দেন। এর পরিণতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়। বিশেষভাবে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশে ইসলামী জেহাদি শক্তি সহিংস আন্দোলন শুরু করলে সামাজিক স্থিতি বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়।
১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি, গত দুই বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর শেষে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ_ এসব ইতিবাচক উদ্যোগে দিলি্ল ও ঢাকার সম্পর্কে ইতিবাচক মোড় নিতে থাকে। সম্প্রতি মিয়ানমারেও ঘটে চলেছে পরিবর্তন। দীর্ঘ ও কঠোর সামরিক শাসনের পর সেখানে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এখনও অনেক কাঁটা। বিভিন্ন ইস্যুতে এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানও দেখা যায়।
১৯৬০ সালে জেনারেল নে উইন প্রধানমন্ত্রী উ নুকে অপসারণ করে দেশের ক্ষমতা দখল করেন। দুই বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বৌদ্ধ রাষ্ট্রটিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে গড়ে তোলায় সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ সময়েই মুসলিম নাগরিকদের প্রতি বিশেষভাবে বৈষম্য করা হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আড়াই লাখের বেশি অধিবাসী বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালে দেশটিতে নতুন একটি সামরিক সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মোড় নেয়। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটে। এ সময়ে অং সান সু চিসহ কিছু রাজনীতিককে মুক্তি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকেও প্রত্যাহার করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সময়ে মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আপত্তি জানাতে থাকে। শুধু তাই নয়, বল প্রয়োগে নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো শুরু হয়। এ সময়ে আরও একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়_ তিনটি দেশের রাজনৈতিক চরমপন্থিদের পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেওয়ার তৎপরতা। অথচ আঞ্চলিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে এর বিপরীতটাই প্রয়োজন। ১৯৯২ সালে ভারতের চরমপন্থি হিন্দুরা উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের চরমপন্থি মুসলিমরা বিপুলসংখ্যক মন্দির ধ্বংস করে। অনেকের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানো হয়। মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপরও নতুন করে অত্যাচার শুরু হয়।
যেসব দেশ বৃহৎ প্রতিবেশী পরিবেষ্টিত, তাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে 'শক্তির ভারসাম্য' যথাযথ উপলব্ধি এবং এর যথাযথ প্রয়োগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার তাদের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চীন ও ভারত উভয়ের কাছ থেকেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। এ অঞ্চলে জাপান-চীন অক্ষশক্তিও সক্রিয়। তাদের কাছ থেকেও সুবিধা নেওয়ার রয়েছে। বিমস্টেকের মতো আন্তঃআঞ্চলিক জোটের মাধ্যমেও সম্পর্ক উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এ অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোটের সদস্য। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত কুনমিং ইনিশিয়েটিভও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা বিশেষ ভূমিকা রাখবে_ তাতে সন্দেহ নেই।
সার্ক সনদ অনুযায়ী এ ফোরামে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। সদস্য দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে যেসব জটিল সমস্যা রয়েছে তার সমাধানে যৌথ সিলেক্ট কমিটি গঠন করা যায়।
দক্ষিণ এশিয়া ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন বা সাফটা এবং দক্ষিণ এশিয়া প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা সাপটায় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তা সার্কের পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্যও যেন প্রযোজ্য হয়, তার চেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে এ সুবিধা দিতে হবে।
সামরিক উত্তেজনা কমিয়ে আনা এবং সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসানও জরুরি। আঞ্চলিক শান্তিস্ন ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে এবং তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সবশেষে বলব, এমন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠিত হতে হবে, যাদের দায়িত্ব থাকবে মানব, বৈষয়িক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বই কেবল এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে চমৎকার নজির স্থাপন করেছেন। ওই মহাদেশের দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে বিবাদ-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। এখন আর কেউ ওই পথে সমস্যা সমাধানের কথা ভাবে না। এ সংস্থা গঠনে বেলজিয়াম উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশও কিন্তু তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে
বাংলাদেশের দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার। তিনটি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শে খুব একটা মিল পাওয়া যাবে না। জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নেও তাদের রয়েছে উদ্বেগ। কিন্তু চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে ফিরে গেলে ভিন্ন এক চিত্র আমরা দেখতে পাব। ভারতের নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা সমর্থন ও সহযোগিতা এবং সে সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনরত বার্মার নেতা উ থান্টের সক্রিয় সমর্থন ব্যতিরেকে এ সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতে পারত এবং আমাদের হয়তো আরও মূল্য দিতে হতো। এ প্রেক্ষাপট কোনোভাবেই ভুললে চলবে না। ভারতের সঙ্গে ভূখণ্ডগত সমস্যা রয়েছে আমাদের। সীমান্তে বিএসএফের অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও লোমহর্ষক নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে চলেছে। বাংলাদেশে এ নিয়ে ক্ষোভের মাত্রা সঙ্গতভাবেই ব্যাপক। একই সঙ্গে লক্ষ্য করছি ভারতের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজও বিএসএফের কাজে অসন্তুষ্ট। সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়েও রয়েছে দুই দেশে উদ্বেগ।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। তারপরও বলব, পারস্পরিক সহযোগিতার পথে চললে তিনটি দেশই উপকৃত হতে পারে। বিশেষ করে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে সমুদ্রসম্পদের অপরিমেয় ভাণ্ডারকে।
এ তিনটি দেশের সম্পর্কের কেন অবনতি ঘটল এবং কীভাবে তা বিপরীতমুখী করা যায়_ সেটা নিয়েই এ লেখা। ভূখণ্ড, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান, এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রানজিট রুট, চোরাচালান, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা_ এসব ইস্যু নিয়ে তিন দেশের উদ্বেগ রয়েছে। পরস্পর দোষারোপের মনোভাবেরও প্রকাশ ঘটে। এর পরিবর্তে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে প্রয়োজন প্রতিটি পর্যায়ে অব্যাহত ইতিবাচক যোগাযোগ ও আলোচনা। এ জন্য অপরিহার্য একটি শর্ত হচ্ছে_ গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাজনৈতিক পরিবেশ। আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে আমার অভিমত_ এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সহিষ্ণুতা এবং এমনকি বিপরীত মতের প্রতিও সম্মান দেখানো।
প্রথমেই আমরা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। পাকিস্তানের 'অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের' বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণ সফল যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পরিহাসের বিষয় যে, ১৯৪৬ সালের গণভোটে এই বাঙালিরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরঙ্কুশ রায় দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাত বছর পর বাঙালিরা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে। ততদিনে পূর্ব বাংলার জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এর ১৭ বছর পর, ১৯৭১ সালে বাঙালিরা পৌঁছায় অভীষ্ট লক্ষ্যে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশ। এ জন্য অবশ্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন পড়ে। এ সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে প্রায় এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের মাটিতে।
স্বাধীনতাউত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য বিপুল সুবিধা এনে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কালে ব্যাপক অপপ্রচার, বিশ্ব অর্থনীতিতে নিদারুণ সংকট, প্রভাব বাড়াতে পরাশক্তির দ্বন্দ্ব্বের পরিণতিতে ১৯৭৪ সালের বন্যা-পরবর্তী খাদ্য সংকটের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত খাদ্য সহায়তা আকস্মিকভাবে স্থগিত রাখা_ এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অশনি সংকেত দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেন। তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক সংকেত ধরা হলেও ভারতীয় নেতৃত্ব বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষুদ্র একদল সেনা অফিসারের হাতে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটলে ভারতীয় নেতৃত্বের হতাশা ও অবিশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়।
অভ্যুত্থানের সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ১৫ আগস্ট, যা ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মহান নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে শুধু শ্রদ্ধাই করতেন না, একই সঙ্গে মনে করতেন বন্ধু। মুজিব-পরবর্তী সামরিক শাসকদের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর অবিশ্বাসের কারণে বেশ কিছু জরুরি সমস্যা যেমন গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন, অফসোরে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধান ও আহরণ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রভৃতি ইস্যু অনিষ্পন্ন থেকে যায়। এসব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ছিল অপরিহার্য। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ায় বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের প্রতি নয়াদিলি্লর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। ইসলামী দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণেও ভারতের মনোভাব কঠোর হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে এসব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ক্ষমা প্রদর্শন এবং দালাল আইন প্রত্যাহার করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে, যাতে ইসলামী ঐক্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে তিনি বিরোধিতা না করেন। তার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল_ পাকিস্তানে আটকে পড়া সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার দায়ে অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের পরিণতিতে রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ক্ষমাপ্রাপ্তদের একটি অংশেরই এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে।
মুজিব হত্যার পর দুই দফায় সামরিক শাসন জারি হয়। এ সময় ক্ষমতাসীনরা রক্ষণশীল ও ভারতবিরোধী শক্তির মধ্যে সমর্থন জোরদারে ইসলামী দলগুলোকে ব্যবহার করতে থাকে। জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসিত করেন এবং তার মন্ত্রিসভায় ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থিদের স্থান করে দেন। এর পরিণতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়। বিশেষভাবে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশে ইসলামী জেহাদি শক্তি সহিংস আন্দোলন শুরু করলে সামাজিক স্থিতি বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়।
১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি, গত দুই বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর শেষে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ_ এসব ইতিবাচক উদ্যোগে দিলি্ল ও ঢাকার সম্পর্কে ইতিবাচক মোড় নিতে থাকে। সম্প্রতি মিয়ানমারেও ঘটে চলেছে পরিবর্তন। দীর্ঘ ও কঠোর সামরিক শাসনের পর সেখানে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এখনও অনেক কাঁটা। বিভিন্ন ইস্যুতে এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানও দেখা যায়।
১৯৬০ সালে জেনারেল নে উইন প্রধানমন্ত্রী উ নুকে অপসারণ করে দেশের ক্ষমতা দখল করেন। দুই বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বৌদ্ধ রাষ্ট্রটিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে গড়ে তোলায় সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ সময়েই মুসলিম নাগরিকদের প্রতি বিশেষভাবে বৈষম্য করা হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আড়াই লাখের বেশি অধিবাসী বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালে দেশটিতে নতুন একটি সামরিক সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মোড় নেয়। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটে। এ সময়ে অং সান সু চিসহ কিছু রাজনীতিককে মুক্তি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকেও প্রত্যাহার করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সময়ে মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আপত্তি জানাতে থাকে। শুধু তাই নয়, বল প্রয়োগে নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো শুরু হয়। এ সময়ে আরও একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়_ তিনটি দেশের রাজনৈতিক চরমপন্থিদের পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেওয়ার তৎপরতা। অথচ আঞ্চলিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে এর বিপরীতটাই প্রয়োজন। ১৯৯২ সালে ভারতের চরমপন্থি হিন্দুরা উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের চরমপন্থি মুসলিমরা বিপুলসংখ্যক মন্দির ধ্বংস করে। অনেকের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানো হয়। মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপরও নতুন করে অত্যাচার শুরু হয়।
যেসব দেশ বৃহৎ প্রতিবেশী পরিবেষ্টিত, তাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে 'শক্তির ভারসাম্য' যথাযথ উপলব্ধি এবং এর যথাযথ প্রয়োগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার তাদের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চীন ও ভারত উভয়ের কাছ থেকেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। এ অঞ্চলে জাপান-চীন অক্ষশক্তিও সক্রিয়। তাদের কাছ থেকেও সুবিধা নেওয়ার রয়েছে। বিমস্টেকের মতো আন্তঃআঞ্চলিক জোটের মাধ্যমেও সম্পর্ক উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এ অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোটের সদস্য। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত কুনমিং ইনিশিয়েটিভও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা বিশেষ ভূমিকা রাখবে_ তাতে সন্দেহ নেই।
সার্ক সনদ অনুযায়ী এ ফোরামে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। সদস্য দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে যেসব জটিল সমস্যা রয়েছে তার সমাধানে যৌথ সিলেক্ট কমিটি গঠন করা যায়।
দক্ষিণ এশিয়া ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন বা সাফটা এবং দক্ষিণ এশিয়া প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা সাপটায় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তা সার্কের পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্যও যেন প্রযোজ্য হয়, তার চেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে এ সুবিধা দিতে হবে।
সামরিক উত্তেজনা কমিয়ে আনা এবং সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসানও জরুরি। আঞ্চলিক শান্তিস্ন ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে এবং তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সবশেষে বলব, এমন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠিত হতে হবে, যাদের দায়িত্ব থাকবে মানব, বৈষয়িক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বই কেবল এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে চমৎকার নজির স্থাপন করেছেন। ওই মহাদেশের দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে বিবাদ-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। এখন আর কেউ ওই পথে সমস্যা সমাধানের কথা ভাবে না। এ সংস্থা গঠনে বেলজিয়াম উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশও কিন্তু তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
জিল্লুর রহমান খান :যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক
No comments