সরল গরল-বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প শুনুন by মিজানুর রহমান খান

শোনেন শোনেন প্রিয় পাঠক, শোনেন দিয়া মন, খুনি বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প এখন করিব বর্ণন। তবে তার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা! গত বছরের জুলাইতে আলোচিত আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের ‘অবিসংবাদিত’ নেতা আবু তাহেরের পুত্র বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মাফ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও নামটা


পড়েছিল রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের। আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ তখন বলেছিলেন, আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছু জানে না। এই কথিত না জানার খবরটি যিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তিনি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছিলেন, এ বিষয়ে নিয়ম মানা হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই ক্ষমার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
২৫ জুলাই ২০১১ আমার ‘প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমা বৈধ নয়’ শীর্ষক লেখায় আইনমন্ত্রীর ওই না জানার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানতেন না, এই কথা অন্তত দালিলিকভাবে ঠিক নয়। কারণ, যে চিঠির ভিত্তিতে নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ হয়, সেটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিল। আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত আইন সচিবসহ (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক) পাঁচজনের সই করা চিঠি। এই চিঠিতে ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনা’ শব্দটি আছে। এর মানে, আইন মন্ত্রণালয় ক্ষমা করে দেওয়ার দায়ভার সরাসরি নেয়নি। এমনকি এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাঁধে বন্দুক রেখে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করার একটা সূক্ষ্ম চেষ্টাও থাকতে পারে। তবে তারা তাহেরপুত্র ও তাঁর বন্ধু বাবরের ক্ষমা ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনায়’ ছাড়লেও এটাই তাদের অবস্থান নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ক্ষমা না করার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। খুনি পুত্রের জন্য আবু তাহের তাঁর দলীয় পরিচয় পুঁজি করেন। তিনি আওয়ামী লীগার, সে কারণেই তাঁর পুত্রকে জড়ানো এবং সেই কারণেই তাঁর ঘাতক পুত্র ক্ষমাপ্রার্থী, সে বিষয়টি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক ছিল না। গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠক করেন। এ সময় মেয়র আবু তাহের উপস্থিত ছিলেন। বিটিভি এ নিয়ে সচিত্র খবর সম্প্রচার করেছিল। ওই বৈঠকে শিবিরকর্মী মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা যে ‘নির্দোষ’ এবং তাঁদের সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়। লক্ষ্মীপুরের একজন সাংবাদিক সোমবার এ কথা বলেছেন এই নিবন্ধকারকে।
এবার আমরা দেখব, খুনি বিপ্লব কাকে, কেন ও কীভাবে খুন করেছিলেন। নির্দলীয় ও দক্ষ বিচারপতি হিসেবে মো. ইমান আলীর সুনাম সুবিদিত। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি আপিল বিভাগে উন্নীত হন। রাষ্ট্র বনাম এ এইচ এম বিপ্লব মামলার মূল রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. ইমান আলী। ৬০ পৃষ্ঠার সুলিখিত এই রায় সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত করেছে যে মহসিন হত্যাকাণ্ডের মূলনায়ক তাহেরপুত্র বিপ্লব। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০০। আওয়ামী লীগের জমানা। লক্ষ্মীপুর শহরের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। এদিন মহসিন খুন হন। ২০০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত রায়ের বিবরণ থেকে দেখা যায়, পলাতক বিপ্লবের পক্ষে রাষ্ট্র আইনজীবী দিয়েছিল।
মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও বাবরসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ৬ জুলাই লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রেফারেন্স পাঠান। এ সময় বিপ্লব ও আবু তাহেরের পালকপুত্রখ্যাত লাবু বাদে অন্য তিনজন কারাগারে ছিলেন। বাবরসহ তিনজনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য তৈরি করা যন্ত্রণাদায়ক সেলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে যেমন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষও বলেছিল, ‘রাজনৈতিক শত্রুতার কারণেই মহসিনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মহসিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্বীকৃতমতে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী ছিলেন।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, যাঁদের মধ্যে এখন একজন সাংবিধানিক পদে আছেন, বিপ্লব, বাবর বা লাবু ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন, তা দাবি করতে ভরসা পাননি। তাঁরা বলেছেন, মহসিনকে খুন করাই যদি লক্ষ্য হতো, তাহলে বিপ্লবরা মহসিনের হাত-পায়ে গুলি ছুড়তেন না। তাই ৩০২ ধারায় না হয়ে ৩২৬ ধারায় তাঁদের শাস্তি হতে পারে।
উভয় পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্ক শ্রবণ শেষে আদালত কিন্তু তাঁদের যুক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করেননি। খুন ও খুনিদের কাণ্ড আদালত সাব্যস্ত করেন এভাবে: ‘ওই কক্ষ থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে অভিযুক্ত লাবু, বাবর ও বিপ্লব মহসিনকে টেনেহিঁচড়ে আবদুল আউয়াল এমপির সুপারির বাগানে নিয়ে যায়। বাবর ও লাবু নিহত মহসিনের দুই হাত চেপে ধরে। এ সময় তাহেরপুত্র বিপ্লব মহসিনের দুই পায়ে গুলি করলে সে লুটিয়ে পড়ে। এরপর তাহেরের পালকপুত্র লাবুও গুলি করে এবং তাঁর কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে বিপ্লব-বন্ধু বাবর মহসিনের বগলে গুলি করে। এই হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটেছে। এটা বলা যায় না যে, আসামিরা কোনোভাবেই জনতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।’
বাবর ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মার্জু ও মেহেদী ছিলেন যুবলীগের কর্মী।
বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ের উপসংহারে লিখেছেন, ‘ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। তারা একটি রাজনৈতিক সভা করছিল বলেই অভিযুক্তদের সন্দেহ ছিল। তারা তাদের কাছে চাঁদা চায়নি। তাদের কাছ থেকে মূল্যবান কিছু ছিনিয়েও নেয়নি। আসামিরা তাদের দেহ তল্লাশি করেছিল। তবে নিহত এবং অন্যরা যদি কোনো রাজনৈতিক সভায়ও মিলিত হয়, তাহলেও তাদের সভা পণ্ড করে দেওয়ার কোনো অধিকার আসামিদের ছিল না। মহসিন এই জঘন্য অপরাধের টার্গেট হয়েছিল।’
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ‘এ এইচ এম বিপ্লব, সৈয়দ নুরুল আজিম বাবর এবং আবদুল জব্বার লাবু ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপটে ছিল। তারাই যে মহসিনকে অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করেছিল, তা অবিশ্বাসের কোনো কারণ আমরা দেখি না।’
আমরাও আদালতের সঙ্গে একমত। আইন মন্ত্রণালয়ও ‘স্বীয় বিবেচনায়’ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আদালতের ওই রায়কে অবিশ্বাস করার পরামর্শ দেয়নি। তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের চাকরি বাঁচিয়েছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তাঁরা কেন ক্ষমা বা অনুকম্পা পাচ্ছেন?
হাইকোর্ট কেন তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন, তার বিবরণ এ রকম: ‘বিপ্লব-বাবর ও লাবু যেভাবে গুলি করেছে, তা ময়নাতদন্তের চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার পালের সাক্ষ্যেও প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের পক্ষে যদিও যুক্তি দেওয়া হয়েছে, মহসিনকে তারা হত্যা করতে চায়নি। সেটা চাইলে তারা ঘটনাস্থলেই হত্যা করতে পারত। রিকশা ডেকে হাসপাতালে নিত না।’ আদালত তা মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মহসিনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার গুলি চালানো হয়। এ কারণে আহত ব্যক্তি মারা যেতে পারে—এটা তাদের জানা ছিল না। সে কারণেই তারা খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না।’ আদালত দুটি কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লব ও অন্যদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন। আদালত বলেছেন, ‘শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গুলি না করা এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করার কারণে বিপ্লব, বাবর ও লাবুর শাস্তি লঘু করা হলো। তাদের যাবজ্জীবন বহাল থাকবে। মার্জু ওরফে নুরুল্লা এবং মেহেদী হাসানকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হলো।’
মহসিনের তিন ঘাতকের মধ্যে বিপ্লব ও বাবরের দণ্ড কমেছে বলে প্রথম আলো খবর দিয়েছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, তাহেরের পালিত পুত্র লাবুরটাও কমবে। সুশাসিত এই রাষ্ট্রে এক যাত্রায় তিন ফল হয় না! লক্ষ্মীপুর জেলে সহযোগীদের নিয়ে ‘বড়মিয়ার (বিপ্লব) বিলাসীজীবন’ কারও অজানা নয়। কিন্তু এসব ঘটছে কিসের মানদণ্ডে? এক অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদ ধরে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নাম ভাঙাবেন, কিন্তু সেটা ধোপে টিকবে না। কারণ, এমন অনেক ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগারের দেখা মিলবে, যাঁরা সংগত কারণ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায্য অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এটা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন যে মহসিনের ঘাতকেরা হাইকোর্ট থেকেও একবার অনুকম্পা নিয়েছিলেন। সুতরাং, ঘাতকেরা দুবার অনুকম্পা নিলেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে তাই অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উচ্চ আদালতে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জযোগ্য। সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত এই ক্ষমায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.