নিজের মত প্রকাশ করতে চাই by তৌহিদা শিরোপা
২০০৯ সালের কথা। কান্দে আমার মা নামে প্রামাণ্যচিত্রভিত্তিক একটি অনুষ্ঠানের শুটিং চলছে। এটি করতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের অজানা অনেক শহীদের কথা, তাঁদের পরিবারের কথা উঠে আসে। তখন তাঁর মনে হয়, কারও কারও কথা পাঁচ-দশ মিনিটে ধারণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য আরও অনেক সময় লাগবে।
সেই ভাবনা থেকেই ২০০৯ সালে নূর খাতুনকে নিয়ে সে কথা বলে যাই প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন ফৌজিয়া খান। এভাবে কাজ করতে গিয়ে ২০১০ সালে দেখা পান রবীন্দ্রনাথ সরকারের পরিবারের। কোথায় পাব তারে এই পরিবারকে ঘিরেই। বাংলাদেশের একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক ফৌজিয়া খান নিজের মতো করে কাজ করে চলেছেন। বর্তমানে ঢাকা আর্ট সেন্টারের রিসোর্স সেন্টারের খণ্ডকালীন সমন্বয়ক হিসেবে আছেন।
‘২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদের সভাপতি ছিলাম আমি। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর “মুক্তিযুদ্ধ ও মানবাধিকার” নামে মুক্তিযুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্র উৎসব করে থাকে। তারই অংশ হিসেবে সেবার এই গোলটেবিল বৈঠক হয়। আর সে সময় আমি রশীদ হায়দারের স্মৃতি একাত্তর বইটি পড়ছিলাম। মনে হলো, এসব স্মৃতিকথায় শুধু মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের কথা উঠে এসেছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরাও তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁদের কথা তো কেউ জানছে না। সেটি জানাতে হবে। তখন “কান্দে আমার মা” অনুষ্ঠানের ভাবনা আসে। এটিএন বাংলার সঙ্গে কথা বলি। তারা রাজি হয় এই অনুষ্ঠান প্রচারে। ১৪টি জেলায় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তখন খোঁজ মেলে রবীন্দ্রনাথ সরকারের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নির্বিচারে শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সরকার এ রকম একজন ধনী হিন্দু পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর বন্ধু ছিলেন রাজাকারের ছেলে। সেই বন্ধুই তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িটি। শুরুতে তাঁর মা, ভাই, স্ত্রী—কেউই কথা বলতে চাননি। পরে তাঁরা কথা বলা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সরকারের স্ত্রী প্রায় ১২ বছর ভেবেছিলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁর স্বামী আর ফেরেন না। কোথায় পাব তারে তাঁদের গল্পকথা। এটি প্রচারের পর সবার খুব প্রশংসা পেয়েছিলাম।
‘আমি জন্মেছি ১৯৭০ সালে। তাই মুক্তিযুদ্ধের কথা আমার কিছু মনে নেই। আমি আসলে আমার মায়ের চোখ দিয়ে, তাঁর গল্প শুনে সে সময়কে মনের মধ্যে গেঁথেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের মিরপুরের বাড়িটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার খালু নিখোঁজ হয়ে যান।’ বলছিলেন ফৌজিয়া খান।
এ পেশায় আসার স্বপ্নটা কি আগে থেকেই ছিল—এমন প্রশ্নের উত্তরে মুখে হাসি এনে ফৌজিয়া খান বলেন, ‘এ রকম কখনো ভাবিনি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দেশ-বিদেশের নামকরা সব চলচ্চিত্র দেখানো হতো। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ক্লাস শেষে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম। মিলনায়তনের সব আলো যখন নিভে যেত, পর্দায় সিনেমা শুরু হলেই আমি আর আমার মধ্যে থাকতাম না। কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক হব, এমন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ছিল না। আমিও কখনো ভাবিনি। মাস্টার্স করার সময় একদিন আমার সহপাঠী পরিচালক নুরুল আলম আতিক বলল, ভারতের পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এফটিআই) বৃত্তির আবেদন করব কি না। কিছু না ভেবে করেও ফেললাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, হয়েও গেল। যেহেতু বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, তাই বাড়িতেও কোনো আপত্তি ছিল না। আমার মাস্টার্স পরীক্ষার মাঝখানে চলে গেলাম পুনেতে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়তে। সেখানে পড়ার সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। পড়া শেষে দেশে ফিরে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে খানিকটা স্বপ্নভঙ্গ হলো। যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলাম, নানা প্রতিকূলতার কারণে তা করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছে, নারী হিসেবে এই পেশায় টিকে থাকা বেশ কঠিন। তবুও থেমে থাকলাম না। এর মধ্যে মানজারে হাসিন মুরাদের সহযোগিতায় স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টে অডিও ভিজুয়্যাল বিভাগে কাজ শুরু করি। সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করি। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির ওপর একটি ফেলোশিপ পাই। সেখানেও কাজ করেছি।
‘অনেকে মনে করেন, প্রামাণ্যচিত্র শুধু তথ্যভিত্তিক হবে, বিষয়টি তা নয়। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও দেখার মধ্য দিয়ে অন্য কোনো জীবনের বাস্তবতার রস আস্বাদনের সুযোগ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে শৈল্পিক ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটে। তবে নারীদের জীবনের নানা দিক নিয়ে কাজ করতে চাই। এর মধ্যে কয়েকটি নারীপ্রধান উপন্যাস নিয়ে নাটক পরিচালনা করেছি। দেখা যায়, নিজের নাটকের প্রযোজনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেকেই করতে হয়। গৎবাঁধা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র করতে নিজেকে তৈরি করব না। স্বাধীনভাবে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরে চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাই।
‘তবে আজ আমি এত স্বাধীনভাবে ভাবতে পারি আমার মায়ের কারণে। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে নিজের মতো করে চিন্তা করতে হয়। তাঁর অনুপ্রেরণার কারণে আজকের আমি।’
‘২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদের সভাপতি ছিলাম আমি। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর “মুক্তিযুদ্ধ ও মানবাধিকার” নামে মুক্তিযুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্র উৎসব করে থাকে। তারই অংশ হিসেবে সেবার এই গোলটেবিল বৈঠক হয়। আর সে সময় আমি রশীদ হায়দারের স্মৃতি একাত্তর বইটি পড়ছিলাম। মনে হলো, এসব স্মৃতিকথায় শুধু মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের কথা উঠে এসেছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরাও তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁদের কথা তো কেউ জানছে না। সেটি জানাতে হবে। তখন “কান্দে আমার মা” অনুষ্ঠানের ভাবনা আসে। এটিএন বাংলার সঙ্গে কথা বলি। তারা রাজি হয় এই অনুষ্ঠান প্রচারে। ১৪টি জেলায় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তখন খোঁজ মেলে রবীন্দ্রনাথ সরকারের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নির্বিচারে শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সরকার এ রকম একজন ধনী হিন্দু পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর বন্ধু ছিলেন রাজাকারের ছেলে। সেই বন্ধুই তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িটি। শুরুতে তাঁর মা, ভাই, স্ত্রী—কেউই কথা বলতে চাননি। পরে তাঁরা কথা বলা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সরকারের স্ত্রী প্রায় ১২ বছর ভেবেছিলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁর স্বামী আর ফেরেন না। কোথায় পাব তারে তাঁদের গল্পকথা। এটি প্রচারের পর সবার খুব প্রশংসা পেয়েছিলাম।
‘আমি জন্মেছি ১৯৭০ সালে। তাই মুক্তিযুদ্ধের কথা আমার কিছু মনে নেই। আমি আসলে আমার মায়ের চোখ দিয়ে, তাঁর গল্প শুনে সে সময়কে মনের মধ্যে গেঁথেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের মিরপুরের বাড়িটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার খালু নিখোঁজ হয়ে যান।’ বলছিলেন ফৌজিয়া খান।
এ পেশায় আসার স্বপ্নটা কি আগে থেকেই ছিল—এমন প্রশ্নের উত্তরে মুখে হাসি এনে ফৌজিয়া খান বলেন, ‘এ রকম কখনো ভাবিনি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দেশ-বিদেশের নামকরা সব চলচ্চিত্র দেখানো হতো। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ক্লাস শেষে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম। মিলনায়তনের সব আলো যখন নিভে যেত, পর্দায় সিনেমা শুরু হলেই আমি আর আমার মধ্যে থাকতাম না। কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক হব, এমন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ছিল না। আমিও কখনো ভাবিনি। মাস্টার্স করার সময় একদিন আমার সহপাঠী পরিচালক নুরুল আলম আতিক বলল, ভারতের পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এফটিআই) বৃত্তির আবেদন করব কি না। কিছু না ভেবে করেও ফেললাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, হয়েও গেল। যেহেতু বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, তাই বাড়িতেও কোনো আপত্তি ছিল না। আমার মাস্টার্স পরীক্ষার মাঝখানে চলে গেলাম পুনেতে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়তে। সেখানে পড়ার সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। পড়া শেষে দেশে ফিরে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে খানিকটা স্বপ্নভঙ্গ হলো। যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলাম, নানা প্রতিকূলতার কারণে তা করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছে, নারী হিসেবে এই পেশায় টিকে থাকা বেশ কঠিন। তবুও থেমে থাকলাম না। এর মধ্যে মানজারে হাসিন মুরাদের সহযোগিতায় স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টে অডিও ভিজুয়্যাল বিভাগে কাজ শুরু করি। সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করি। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির ওপর একটি ফেলোশিপ পাই। সেখানেও কাজ করেছি।
‘অনেকে মনে করেন, প্রামাণ্যচিত্র শুধু তথ্যভিত্তিক হবে, বিষয়টি তা নয়। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও দেখার মধ্য দিয়ে অন্য কোনো জীবনের বাস্তবতার রস আস্বাদনের সুযোগ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে শৈল্পিক ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটে। তবে নারীদের জীবনের নানা দিক নিয়ে কাজ করতে চাই। এর মধ্যে কয়েকটি নারীপ্রধান উপন্যাস নিয়ে নাটক পরিচালনা করেছি। দেখা যায়, নিজের নাটকের প্রযোজনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেকেই করতে হয়। গৎবাঁধা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র করতে নিজেকে তৈরি করব না। স্বাধীনভাবে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরে চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাই।
‘তবে আজ আমি এত স্বাধীনভাবে ভাবতে পারি আমার মায়ের কারণে। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে নিজের মতো করে চিন্তা করতে হয়। তাঁর অনুপ্রেরণার কারণে আজকের আমি।’
No comments