চারদিক-আদিবাসী ভাষামেলা by রাফি শাহরিন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আয়োজন করা হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী ভাষামেলার। বাংলাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার সঙ্গে এ দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠীর পরিচয় ঘটানোই ছিল তিন দিনের এ মেলার মূল উদ্দেশ্য।


২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল নগরবাসীর অনেকটা অগোচরেই আয়োজিত এ মেলার শেষ দিন। ওই দিন বিকেলে মৎস্য ভবন থেকে মেলার দিকে যেতেই কানে এল সম্মিলিত কণ্ঠের অনেকটা আদিবাসী সুরের আবৃত্তি। মেলা প্রাঙ্গণে চোখে পড়ল দেয়ালজুড়ে টাঙানো দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকচিত্র। এর সামনে দাঁড়িয়ে গারো ভাষার একটি ছড়া উপজাতীয় সুরে আবৃত্তির চেষ্টা করছে ঢাকা কলেজ থেকে আসা একদল শিক্ষার্থী। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল তাদের সে সুর—
জাজং নাম্মা তা. পাংপাং
মিকগ্রি থুয়া গাং পাংপাং
আক্কি. সানি জামানো
থুয়ে জারনি কেৎ চিকিত্তা।
বাংলা অনুবাদ—
জ্যোৎস্নার আলো উপচে পড়ে
অন্ধ ঘুমায় চিৎ
তাইনা দেখে একটু পরে
উঠে দাঁড়ায় ভালো।
মেলায় উপস্থাপিত হয়েছিল চাকমা, মারমা, গারো, তিব্বতি, তঞ্চঙ্গাসহ দেশের ১৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার পরিচয়, লিপি, ভাষিক এলাকা আর তাদের প্রাথমিক শিক্ষার কিছু বই ও প্রাচীন পুঁথির আলোকচিত্র। সে সঙ্গে ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনেরও কিছু চিত্র।
মেলা থেকে জানলাম, দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে চাকমা জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষার নামও চাকমা। এদের এক অংশ বাস করে মিয়ানমারে। বাংলাদেশ অংশে এ ভাষাভাষীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। চাকমা ভাষার লিখিত রূপ প্রকাশ হয় বর্মি ও মনখমের লিপিতে। আর মণিপুরি জনগোষ্ঠীর রয়েছে দুটো ভাগ। এদের এক অংশের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। লিখিত রূপ প্রকাশ করা হয় বাংলা লিপিতে। আরেক অংশের ভাষা মণিপুরি মৈতেয়। এ ভাষায় রয়েছে মৈতেয় লিপি। নিজস্ব কোনো লিপি নেই চাক ও খিয়ং জনগোষ্ঠীর। এ ভাষাগুলোর চর্চাকারীর সংখ্যাও খুব কম। কোনোটিই দুই হাজারের বেশি নয়। তবে নিজস্ব লিপি থাকুক বা না থাকুক, আদিবাসীদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ কিন্তু শুরু হয় তাদের মাতৃভাষায় নয়, বরং বাংলা ভাষায়। ভাষা মেলায় খিয়ং জাতি-গোষ্ঠীর একটি প্রাথমিক শিক্ষার বইয়ের আলোকচিত্রে দেখা গেল এমনই কিছু উদাহরণ। বাংলাভাষীদের মতো ‘অ তে অক্ষর চিনি সবাই মিলে’ বলেই খিয়ংরা শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা। সে সঙ্গে মাতৃভাষায় শেখে ‘বারোহ ঙি ইথু রাকি ডাক’। ভবিষ্যতে চাকরির নিশ্চয়তার জন্যই এ প্রয়াস। এর ফলে বহু আদিবাসী ভাষার চর্চা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কোনো ভাষা আজ বিপন্ন, কোনোটি চলছে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। মৃত্যু ঘটেছে রাজবংশী ও ভোজপুরি ভাষার। আর কোনোমতে টিকে থাকা খুমি ভাষাভাষীর সংখ্যা এক হাজার ৮০০-এরও কম।
আদিবাসী ভাষার এ নিদর্শনগুলো দেখতে দেখতে শুনছিলাম ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষের মাইকে ভেসে আসছে শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার আহ্বান। শুদ্ধ বাংলা, বাংলাভাষীদের ইংরেজি ভাষা চর্চা ও আদিবাসী ভাষার বর্তমান অবস্থা বিষয়ে আলোচনা ছিল মেলার এ দিনের আয়োজন। প্রধান আলোচক হিসেবে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক পবিত্র সরকার। মেলায় সাধারণ দর্শকের সংখ্যা আশানুরূপ না হলেও, সেমিনারগুলোয় ছিল মিলনায়তন ভরা মানুষ। যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও তাঁদের শিক্ষকেরা। শেষ বিকেলের আলোয় তাঁরা শুনছিলেন কী করে বাংলা ভাষায় একটা দ্বিধার জায়গা তৈরি হচ্ছে, কী করে হচ্ছে বিকৃত। আর উপস্থিত তরুণ প্রজন্মকে এ বিকৃতি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান পবিত্র সরকার। বাংলা ভাষার এ বিকৃতি রোধ এবং বাংলাদেশে প্রচলিত অন্য ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই ব্যতিক্রমী এই ভাষা মেলার উদ্দেশ্য বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিজ্ঞানী সৌরভ শিকদার। শ্রমসাধ্য এ উদ্যোগের প্রধান মুখ তিনি। মেলার শেষ প্রহরে সৌরভ শিকদারের কণ্ঠে ছিল এর প্রচারণার ঘাটতি নিয়ে আক্ষেপ। পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে এ ধরনের আয়োজন করার ইচ্ছের কথা জানান তিনি। আর শুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি আদিবাসী ভাষাগুলোর চর্চার জন্য ভবিষ্যতে সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশের স্বপ্নও দেখেন এ ভাষাবিজ্ঞানী। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে শেষ হয়ে আসছিল মেলার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছিল সূর্য। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে একে একে নামিয়ে ফেলা হচ্ছে আলোকচিত্রগুলো। শুধু নামানো হয়নি প্রবেশমুখের ডিজিটাল ব্যানারটি। আর এ ব্যানারের নিচে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার বিকৃতির সমালোচনা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বর্তমানে বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে একে অখাদ্য বানানোর প্রতিযোগিতা। আর এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দূরেই থাকতে চান তাঁরা। সব ভাষারই করতে চান শুদ্ধ চর্চা।
এ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠের দৃঢ় প্রত্যয় স্বপ্ন দেখায়, এ দেশের তরুণ প্রজন্মই পারবে আগামী দিনগুলোয় মাতৃভাষা বাংলাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। তারাই পারবে চর্চার মাধ্যমে আদিবাসী ভাষাগুলো রক্ষা করতে।
রাফি শাহরিন

No comments

Powered by Blogger.