শেয়ার ব্যবসায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ কোথায়? by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
সম্প্রতি শেয়ারবাজারে ধস নামার ফলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা উঠেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে এর পক্ষে অভিমত ছাপা হয়েছে। তা ছাড়া বেশ কিছুদিন আগে বিরোধী দলের এক নেত্রী বলেছিলেন, যারা শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে সেই টাকা আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের
মধ্যে বিতরণ করা হোক। মাঠে এসব রাজনৈতিক বক্তৃৃতা দিয়ে বাহবা কুড়ানো যায়। কিন্তু এটা যে কতটা অবাস্তব তা আলোচনা করলে বোঝা যাবে। বস্তুত শেয়ারবাজার কী, জিডিপি বৃদ্ধিতে কতখানি সাহায্য করে এবং কিভাবে এটি পরিচালিত হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে উচ্চ পর্যায়ের, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা সুস্পষ্ট ধারণা নিতে চান না। ধারণা নেই এ রকম কথা বলতে চাই না। কেননা কোনো ধারণা আগে থেকে মাথার ভেতর থাকে না, ইনপুট দিতে হয়। যখন যে দায়িত্ব আসে, তখন সে বিষয়ে ধারণা নিতে হয়। তাহলেই কর্তব্যপরায়ণ এবং দক্ষ বলা যাবে।
বাস্তবতা হলো, যে অভূতপূর্ব জনসমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেই জনপ্রিয়তাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শেয়ারবাজারের ধস। অথচ স্টক এঙ্চেঞ্জ শতভাগ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। এর ব্যর্থতার পুরো দায়ভার সরকারের নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্টক এঙ্চেঞ্জের কিছুসংখ্যক সদস্য যাঁরা সরকারি দলের, তাঁরা স্টক এঙ্চেঞ্জের ভূমিকা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত মন্তব্য করলেন। একপর্যায়ে মনে হলো, স্টক এঙ্চেঞ্জে বিনিয়োগের টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু ধরে ব্যাগে ঢোকানোর ব্যাপার। যা দুঃখজনক, তা হলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় এই ধাঁধায় পা দিল। আমাদের দেশে তো বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে। তাদের বক্তব্য, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলেই মুনাফার পাহাড় গড়া যাবে। যাক হোক কথা, অন্য প্রসঙ্গে আসি। সব তালিকাভুক্ত কম্পানির সব শেয়ার লেনদেন করতে হয় স্টক এঙ্চেঞ্জের মাধ্যমে। দুটো পথ থাকে, একজন ক্রেতা এবং অপরজন বিক্রেতা। কম্পিউটারে রেকর্ড হয় কে কত টাকা হারে কার কাছ থেকে কত শেয়ার কিনলেন বা বিক্রি করলেন।
এই আলোচনায় অগ্রসর হওয়ার আগে বলতে চাই, একজন কিভাবে তাঁর টাকা খুইয়েছেন। তিনি অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে বেশি দামে শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় বা বলতে গেলে ধস নামায় তিনি ক্ষতির সম্মুখীন। হয় তিনি ইতিমধ্যে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন অথবা ঘরে রেখে অস্থিরচিত্তে দিন কাটাচ্ছেন। আইনগত দিকটা তো দেখতে হবে। যে হারেই শেয়ার বিক্রি করে থাকেন না কেন, তার আদেশমতো তো শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে। তার আদেশ ছাড়া বিক্রি করা হয়েছে কি না। যদি তা করা হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতিকার রয়েছে। প্রথমত, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কাছে লিখিত অভিযোগ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্টক এঙ্চেঞ্জের কাছেও অভিযোগ করা যায়। ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) ১৯৯৮ সালে Investor Protection Fund Rules নামে একটি তহবিল গঠন করার জন্য বিধি তৈরি করে। ব্রোকারের গাফিলতির কারণে যদি কোনো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট প্রতারণার অভিযোগ থাকলে ফৌজদারি মামলাও করা যেতে পারে। কিন্তু লাখো বিনিয়োগকারীর সহস্র কোটি টাকা লোকসানের বিষয়টি চিহ্নিত করা যাবে কিভাবে এবং কার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে, সেটাই বড় ডলার প্রশ্ন। মেনে নিলাম যে কয়েকজনের চক্রান্তের ফলে একটি শেয়ারের দাম বেড়েছে। কিন্তু তাঁদের নামে যদি স্টক এঙ্চেঞ্জের রেকর্ডে লেনদেনের কথা না থাকে, তাহলে কিভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে যে তাঁরা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অতএব তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ভেতর বিতরণ করা হোক। এ রকম রবিনহুড হওয়ার সুযোগ কোথায়? যদি সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করে থাকেন, তাহলে তা চিহ্নিত করতে হবে।
ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট চালাতে হলে সিডিবিএলের পরিষেবা লাগবে। অর্থাৎ সিডিবিএলে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, যে কারণে ব্যাপক হারে ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক নেতা বললেন যে তিনি চিটাগাং স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলেন এবং সিডিবিএল স্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তা তিনি। হ্যাঁ, এসইসির নীল আঁখির ঝলক ছিল সিএসই। সিএসইর বদৌলতে বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হলো নেটিং। শেয়ারবাজার সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা থাকলে তিনি বলবেন যে নেটিংয়ের অপর নাম গ্যাম্বলিং (Gambling)। স্টক এঙ্চেঞ্জের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অধিকমাত্রায় শক্তিশালী করার জন্য লিস্টিং ফি (Listing Fee) অতিমাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। একটা কম্পানির তহবিল থেকে স্টক এঙ্চেঞ্জের কর্মকর্তা ও শীর্ষ নেতাদের বিদেশ ভ্রমণ এবং রাজসিক ভোজের আয়োজন করা সহজ হয়েছে। সিডিবিএলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং বর্তমান কর্মকর্তাদের পথ খুঁজে বের করা উচিত যেন ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট না খোলা যায়। অনেক মরণব্যাধি রয়েছে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব, কিন্তু অসুখ হলে আর চিকিৎসা করে আরোগ্য লাভের সুযোগ থাকে না। শেয়ারবাজারের অবস্থা অনেকটা সেই রকম।
শেয়ার কেলেঙ্কারির মূল হোতা চিহ্নিত হলে তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গোটা মার্কেটে লেনদেনকারীর সংখ্যা ব্যাপক। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা নিয়মকানুন জেনেই লেনদেন করা হয়। অতএব কিছু লেনদেন বৈধ, কিছু অবৈধ রকম করার সুযোগ নেই। প্রতিষেধক-ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হয়। কম্পানির হিসাব যেন যথাসময়ে প্রকাশিত হয়, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। অবশ্য বিনিয়োগকারী যেন প্রয়োজনীয় আর্থিক তথ্য ঠিকমতো পান। শেয়ারবাজার সম্পর্কে লোভনীয় তথ্য যেন সাধারণ মানুষের কাছে না যায়। এবার এটিই ঘটেছে বলে অনেকের আশঙ্কা। শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু লোক সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের নানাভাবে প্রলোভিত করেছেন। শেয়ারবাজারে লোকসান বলে কিছু নেই, শুধু লাভ আর লাভ_এ ধরনের কথাও প্রচার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব অপকর্ম করার সুযোগ না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শেয়ারবাজারে সংঘটিত অপরাধ নির্ণয় করা এবং ভুক্তভোগীদের সাহায্য করা কত কঠিন, তার আরো দুই-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। যেমন INSIDER TRADING| কম্পানির কোনো গোপন তথ্য যেমন লভ্যাংশ বা বোনাস শেয়ারের সংবাদ কেউ জেনে তার ফায়দা লুটে নেন। অনেক সময় একে বলা হয় VICTIMLESS CRIME। এ ক্ষেত্রে যারা লোকসান গুনবেন, তাঁদের সাহায্যে কে এবং কিভাবে এগিয়ে আসবেন। সম্মানিত পাঠক, লক্ষ করে থাকবেন, এসইসি এখন নড়েচড়ে উঠেছে। প্রথমে গণরোষ এবং সমালোচনার ভয়ে চুপ করে ছিল। উত্তাপ কমার অপেক্ষায় ছিল এসইসি। এসইসি জানে, সব অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। যেমন বলা যায়, এর আগে তারা কোনো কোনো কম্পানিকে ডাইরেক্ট লিস্টিং দিয়ে কিংবা বুকবিল্ডিংয়ের অনুমতি দিয়ে অন্যায় করেছে। কিন্তু এই দুটি বিষয়ে অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা এসইসির রয়েছে। তবে তা ঝঁনলবপঃরাব না Objective Satisfaction-এ অনুমতি দিয়েছে, তা অনুধাবন করা কঠিন। শেয়ারবাজারের এই বিপর্যয়ের পেছনে কিছু ব্যক্তি আছেন। আবার এসইসি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং স্টক এঙ্চেঞ্জের ব্যর্থতাও আছে। ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, সজ্ঞানে না অজ্ঞানে কিংবা কোনো MALAFIDE INTENTION ছিল কি না এসবই এখন বিচার্য সময়।
বিলম্বে হলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তবে তা আরো আগেই করা দরকার ছিল এবং অর্থ মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারত পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তা সংগত ছিল বলে মনে করি না। আবার এ কথাও বলা হয়েছিল যে, এসইসির জন্য যোগ্য চেয়ারম্যান পাওয়া যাচ্ছে না বলে এর সংস্কার করা যাচ্ছে না। এ রকম কথা মেনে নেওয়া কঠিন। আর্থিক খাতে বহু শিক্ষিত লোক কাজ করছেন। কেউ যদি যোগ্যতা নিয়ে এবং নির্বাচন কমিটির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাহলে তিনি ঠিকমতো কাজ করবেন। শেষ পর্যন্ত সেই তো অনেক কিছু করা হলো, কিন্তু তা আরো আগে করলে অনেক ভালো হতো। এখন প্রয়োজনবোধে একটি সক্রিয় উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে, যার গঠনে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের পর সরকারের তরফে কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সাময়িকভাবে ঘুরে দাঁড়ালেও আবার সংকট দেখা যাচ্ছে। যেভাবেই হোক বিপুলসংখ্যক লোক শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়কে ব্যক্তি বা দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং করণীয় এখনো অনেক কিছু বাকি।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস, কলামিস্ট ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক
বাস্তবতা হলো, যে অভূতপূর্ব জনসমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেই জনপ্রিয়তাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শেয়ারবাজারের ধস। অথচ স্টক এঙ্চেঞ্জ শতভাগ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। এর ব্যর্থতার পুরো দায়ভার সরকারের নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্টক এঙ্চেঞ্জের কিছুসংখ্যক সদস্য যাঁরা সরকারি দলের, তাঁরা স্টক এঙ্চেঞ্জের ভূমিকা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত মন্তব্য করলেন। একপর্যায়ে মনে হলো, স্টক এঙ্চেঞ্জে বিনিয়োগের টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু ধরে ব্যাগে ঢোকানোর ব্যাপার। যা দুঃখজনক, তা হলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় এই ধাঁধায় পা দিল। আমাদের দেশে তো বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে। তাদের বক্তব্য, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলেই মুনাফার পাহাড় গড়া যাবে। যাক হোক কথা, অন্য প্রসঙ্গে আসি। সব তালিকাভুক্ত কম্পানির সব শেয়ার লেনদেন করতে হয় স্টক এঙ্চেঞ্জের মাধ্যমে। দুটো পথ থাকে, একজন ক্রেতা এবং অপরজন বিক্রেতা। কম্পিউটারে রেকর্ড হয় কে কত টাকা হারে কার কাছ থেকে কত শেয়ার কিনলেন বা বিক্রি করলেন।
এই আলোচনায় অগ্রসর হওয়ার আগে বলতে চাই, একজন কিভাবে তাঁর টাকা খুইয়েছেন। তিনি অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে বেশি দামে শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় বা বলতে গেলে ধস নামায় তিনি ক্ষতির সম্মুখীন। হয় তিনি ইতিমধ্যে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন অথবা ঘরে রেখে অস্থিরচিত্তে দিন কাটাচ্ছেন। আইনগত দিকটা তো দেখতে হবে। যে হারেই শেয়ার বিক্রি করে থাকেন না কেন, তার আদেশমতো তো শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে। তার আদেশ ছাড়া বিক্রি করা হয়েছে কি না। যদি তা করা হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতিকার রয়েছে। প্রথমত, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কাছে লিখিত অভিযোগ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্টক এঙ্চেঞ্জের কাছেও অভিযোগ করা যায়। ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) ১৯৯৮ সালে Investor Protection Fund Rules নামে একটি তহবিল গঠন করার জন্য বিধি তৈরি করে। ব্রোকারের গাফিলতির কারণে যদি কোনো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট প্রতারণার অভিযোগ থাকলে ফৌজদারি মামলাও করা যেতে পারে। কিন্তু লাখো বিনিয়োগকারীর সহস্র কোটি টাকা লোকসানের বিষয়টি চিহ্নিত করা যাবে কিভাবে এবং কার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে, সেটাই বড় ডলার প্রশ্ন। মেনে নিলাম যে কয়েকজনের চক্রান্তের ফলে একটি শেয়ারের দাম বেড়েছে। কিন্তু তাঁদের নামে যদি স্টক এঙ্চেঞ্জের রেকর্ডে লেনদেনের কথা না থাকে, তাহলে কিভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে যে তাঁরা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অতএব তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ভেতর বিতরণ করা হোক। এ রকম রবিনহুড হওয়ার সুযোগ কোথায়? যদি সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করে থাকেন, তাহলে তা চিহ্নিত করতে হবে।
ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট চালাতে হলে সিডিবিএলের পরিষেবা লাগবে। অর্থাৎ সিডিবিএলে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, যে কারণে ব্যাপক হারে ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক নেতা বললেন যে তিনি চিটাগাং স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলেন এবং সিডিবিএল স্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তা তিনি। হ্যাঁ, এসইসির নীল আঁখির ঝলক ছিল সিএসই। সিএসইর বদৌলতে বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হলো নেটিং। শেয়ারবাজার সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা থাকলে তিনি বলবেন যে নেটিংয়ের অপর নাম গ্যাম্বলিং (Gambling)। স্টক এঙ্চেঞ্জের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অধিকমাত্রায় শক্তিশালী করার জন্য লিস্টিং ফি (Listing Fee) অতিমাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। একটা কম্পানির তহবিল থেকে স্টক এঙ্চেঞ্জের কর্মকর্তা ও শীর্ষ নেতাদের বিদেশ ভ্রমণ এবং রাজসিক ভোজের আয়োজন করা সহজ হয়েছে। সিডিবিএলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং বর্তমান কর্মকর্তাদের পথ খুঁজে বের করা উচিত যেন ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট না খোলা যায়। অনেক মরণব্যাধি রয়েছে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব, কিন্তু অসুখ হলে আর চিকিৎসা করে আরোগ্য লাভের সুযোগ থাকে না। শেয়ারবাজারের অবস্থা অনেকটা সেই রকম।
শেয়ার কেলেঙ্কারির মূল হোতা চিহ্নিত হলে তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গোটা মার্কেটে লেনদেনকারীর সংখ্যা ব্যাপক। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা নিয়মকানুন জেনেই লেনদেন করা হয়। অতএব কিছু লেনদেন বৈধ, কিছু অবৈধ রকম করার সুযোগ নেই। প্রতিষেধক-ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হয়। কম্পানির হিসাব যেন যথাসময়ে প্রকাশিত হয়, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। অবশ্য বিনিয়োগকারী যেন প্রয়োজনীয় আর্থিক তথ্য ঠিকমতো পান। শেয়ারবাজার সম্পর্কে লোভনীয় তথ্য যেন সাধারণ মানুষের কাছে না যায়। এবার এটিই ঘটেছে বলে অনেকের আশঙ্কা। শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু লোক সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের নানাভাবে প্রলোভিত করেছেন। শেয়ারবাজারে লোকসান বলে কিছু নেই, শুধু লাভ আর লাভ_এ ধরনের কথাও প্রচার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব অপকর্ম করার সুযোগ না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শেয়ারবাজারে সংঘটিত অপরাধ নির্ণয় করা এবং ভুক্তভোগীদের সাহায্য করা কত কঠিন, তার আরো দুই-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। যেমন INSIDER TRADING| কম্পানির কোনো গোপন তথ্য যেমন লভ্যাংশ বা বোনাস শেয়ারের সংবাদ কেউ জেনে তার ফায়দা লুটে নেন। অনেক সময় একে বলা হয় VICTIMLESS CRIME। এ ক্ষেত্রে যারা লোকসান গুনবেন, তাঁদের সাহায্যে কে এবং কিভাবে এগিয়ে আসবেন। সম্মানিত পাঠক, লক্ষ করে থাকবেন, এসইসি এখন নড়েচড়ে উঠেছে। প্রথমে গণরোষ এবং সমালোচনার ভয়ে চুপ করে ছিল। উত্তাপ কমার অপেক্ষায় ছিল এসইসি। এসইসি জানে, সব অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। যেমন বলা যায়, এর আগে তারা কোনো কোনো কম্পানিকে ডাইরেক্ট লিস্টিং দিয়ে কিংবা বুকবিল্ডিংয়ের অনুমতি দিয়ে অন্যায় করেছে। কিন্তু এই দুটি বিষয়ে অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা এসইসির রয়েছে। তবে তা ঝঁনলবপঃরাব না Objective Satisfaction-এ অনুমতি দিয়েছে, তা অনুধাবন করা কঠিন। শেয়ারবাজারের এই বিপর্যয়ের পেছনে কিছু ব্যক্তি আছেন। আবার এসইসি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং স্টক এঙ্চেঞ্জের ব্যর্থতাও আছে। ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, সজ্ঞানে না অজ্ঞানে কিংবা কোনো MALAFIDE INTENTION ছিল কি না এসবই এখন বিচার্য সময়।
বিলম্বে হলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তবে তা আরো আগেই করা দরকার ছিল এবং অর্থ মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারত পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তা সংগত ছিল বলে মনে করি না। আবার এ কথাও বলা হয়েছিল যে, এসইসির জন্য যোগ্য চেয়ারম্যান পাওয়া যাচ্ছে না বলে এর সংস্কার করা যাচ্ছে না। এ রকম কথা মেনে নেওয়া কঠিন। আর্থিক খাতে বহু শিক্ষিত লোক কাজ করছেন। কেউ যদি যোগ্যতা নিয়ে এবং নির্বাচন কমিটির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাহলে তিনি ঠিকমতো কাজ করবেন। শেষ পর্যন্ত সেই তো অনেক কিছু করা হলো, কিন্তু তা আরো আগে করলে অনেক ভালো হতো। এখন প্রয়োজনবোধে একটি সক্রিয় উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে, যার গঠনে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের পর সরকারের তরফে কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সাময়িকভাবে ঘুরে দাঁড়ালেও আবার সংকট দেখা যাচ্ছে। যেভাবেই হোক বিপুলসংখ্যক লোক শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়কে ব্যক্তি বা দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং করণীয় এখনো অনেক কিছু বাকি।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস, কলামিস্ট ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক
No comments