সাক্ষাৎকার-সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় নির্বাচন হতে হবে by ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন রাজনৈতিক অঙ্গনের সন্ধিক্ষণে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও
দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে কাকুল মিলিটারি একাডেমী থেকে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং পরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টাফ কলেজে অধ্যয়ন এবং পাকিস্তানে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে নির্বাচনী সংস্কার বিষয়ে সম্প্রতি এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দেশ-বিদেশে তার বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫
সমকাল : আমরা শুনেছি, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনার একটি বই প্রকাশিত হওয়ার পথে। সেটি কত দূর?
সাখাওয়াত হোসেন : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই আমি লিখেছি। সেটা ঠিক গবেষণাধর্মী নয়, নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্ণনাধর্মী বই। নির্বাচন কমিশনে যাওয়াটা আমার জন্য অপ্রত্যাশিতই ছিল। একটি কুয়াসি-জুডিসিয়ারি সংস্থায় কাজ করার কথা আগে কখনও ভাবিনি। ফলে আমার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। গত পাঁচ বছর নির্বাচন কমিশনে কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথাই আমি বইয়ে তুলে ধরছি। প্রথম দফা লেখার পর এখন সম্পাদনা করছি। বইটি বাজারে আসতে আরও তিন-চার মাস লেগে যাবে।
সমকাল : নির্বাচন কমিশনের প্রধান পদে আমরা দেখেছি বিচারপতিরা বেশি দায়িত্ব পেয়েছেন। তুলনামূলক কম হলেও আমলারাও ছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ছিলেন, এমন কেউ আপনার আগে নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পাননি। আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন কমিশনে কাজ করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জের ছিল দুই কারণে। প্রথমত, ওই সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের নেপথ্যে ছিল সেনাবাহিনী। আবার আমি নিজেও সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলাম। এর আগে সেনাবাহিনী থেকে কেউ নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে নির্বাচন কমিশনে আমার ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভিন্নতর ব্যাখ্যার সুযোগ ছিল। সেটা হয়েছেও। তবে আমি নিজে কখনও মনে করিনি যে, দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কিংবা সামরিক শাসন দেশের জন্য কখনও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। যদিও উপমহাদেশের সামরিক শাসনের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর সামরিক শাসনের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সব সামরিক শাসনেরই কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের জন্য সহায়ক হয় না। সামরিক শাসন যদি বেসামরিক চেহারা পায়, অতীতে এ দেশে যা দেখা গেছে, তার অনেক ভালো দিক থাকতে পারে; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য কখনও সহায়ক হয় না। এই বিষয়টি সবসময়ই আমার মাথায় থাকে। যে কারণে আমাকে নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও তা অমূলক ছিল। আত্মবিশ্বাসের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, আমি আর দশজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার মতো ছিলাম না। কেউ বলতে পারেনি যে, হঠাৎ করে অপরিচিত কাউকে এনে বসানো হয়েছে। আমার ভালো-মন্দ মোটামুটি অনেকের জানা ছিল। নিজে দীর্ঘদিন সিভিল সোসাইটির সঙ্গে মিশেছি। লেখালেখি করেছি। শাসন পদ্ধতি, নির্বাচন, রাজনীতি নিয়ে আমার নিজেরও বক্তব্য ছিল। আমার লক্ষ্য ছিল একটাই, কীভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারি। ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমি সেটা ভুলিনি।
সমকাল : আপনি নিজের দিক থেকে স্বচ্ছ ছিলেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কি কোনো সুবিধা-অসুবিধা তৈরি করেছে? বিশেষ করে সে সময় পর্দার অন্তরালে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
সাখাওয়াত হোসেন : কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো অসুবিধা বোধ করিনি। বরং ওই সময় আমি কিছুটা সুবিধাই পেয়েছি। কারণ, আমি আঁচ করতে পারতাম কী ঘটছে, কী ঘটতে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই হয়তো তারা (সামরিক বাহিনী) আমার ওপর নির্ভর করত। আমি সেই সম্পর্ককে সুষ্ঠু নির্বাচনের কাজে সদ্ব্যবহার করেছি। নির্বাচন কমিশন এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে আমি কাজ করেছি। আমি থাকাতে দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়েছিল। যৌথ সভাগুলোতে আমি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতাম। বিশেষ করে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময়। এটির ধারণাগত ও পদ্ধতিগত দিক ঠিক করার ক্ষেত্রে আমরা সবাই মিলে যে কাজ করেছি, সেই পরিবেশ তৈরি করা, ভাবনা আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে আমার একটা বড় ভূমিকা ছিল।
সমকাল : ওই সময় নানা আশঙ্কার কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াত। নির্বাচন নাও হতে পারে_ এমন শঙ্কা কি কখনও আপনার মনে দেখা দিয়েছিল?
সাখাওয়াত হোসেন : যেহেতু সামরিক বাহিনী ওই সময় ক্ষমতা গ্রহণ কিংবা সেনাসমর্থিত সরকার প্রলম্বিত করার উচ্চাভিলাষ একেবারেই প্রদর্শন করেনি, সেহেতু আমি কখনও মনে করিনি যে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা হতে পারে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যখনই কথাবার্তা হতো, আমি পরিষ্কার বলতাম নির্বাচন না হওয়ার নূ্যনতম আশঙ্কাও যদি দেখা দেয়, নির্বাচন কমিশনে আমার থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ আমি জানি, নির্বাচন যদি না হয়, সেনাবাহিনী যদি ক্ষমতা গ্রহণ করে, আমার ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক, অনেকখানি দায় আমার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে। সাংবাদিকরাও প্রায়শই আমাকে প্রশ্ন করতেন যে, নির্বাচন হবে কি? আমি ঠাট্টা করে বলতাম, সকালে এসে যদি দেখেন আমি আসিনি, 'স্বাস্থ্যগত কারণে' পদত্যাগ করেছি, তাহলে বুঝবেন নির্বাচন হবে না।
সমকাল : আপনাদের জন্য তখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সব দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
সাখাওয়াত হোসেন : আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা একবার তৈরি হয়েছিল। একেবারে শেষ দিকে। সবকিছু প্রস্তুত। কেবল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা বাকি। সে নিয়ে দুই প্রধান দলের মধ্যে মতবিরোধ। এক পর্যায়ে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, এই কথা শোনা যাচ্ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা নেগোসিয়েশন করছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তখন নির্বাচন নিয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, নির্বাচন ভেস্তে গেলে দীর্ঘমেয়াদে অনির্বাচিত সরকারের হাতে চলে যাবে। মনে হচ্ছিল, নতুন আরেকটি সরকার আসছে। একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সভায় গিয়ে আমার মনে হলো, অনেকে চান না নির্বাচন যথাসময়ে হোক। ওই সময় যারা দুই দলের মধ্যে সমঝোতার দায়িত্বে ছিলেন, তারা সবাই আন্তরিক ছিলেন কি-না, আমার সন্দেহ আছে। এক পর্যায়ে সেটা ব্যর্থও হলো। এর পরপরই কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা বললাম যে নির্বাচন যথাসময়েই হবে। তখন কোনো কোনো বিশেষ সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কয়েক দফা ছোটখাটো তর্ক পর্যন্ত হয়েছে। আমি তাদের ক্যাটাগরিক্যালি বলেছি, নির্বাচন না হলে যে জাতীয় সংকট তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়ার মতো নেতৃত্ব আমার চোখের সামনে কেউ নেই। দুই বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নির্বাচন কমিশনের কথা হয়েছে। আমি নিজে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। সবাইকে আমরা বলেছি, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে দেশ যে বিরাট সংকটে পড়বে, তা থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। পরে সবাই কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্বাচনে এসেছে। সেটা ছিল সত্যিই এক সন্ধিক্ষণ।
সমকাল : নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বিএনপি বিভক্ত করতে চাইছে।
সাখাওয়াত হোসেন : এই অভিযোগ সত্য নয়। তখন নির্বাচন কমিশন বরং চেয়েছে সবাই মিলেমিশে থাকুক। ভালোয় ভালোয় নির্বাচন হয়ে যাক। তখনকার বিএনপির দুই অংশকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তখন বিএনপির কোনো অংশই কিন্তু বলেনি যে তারা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধের বিএনপি। দু'পক্ষই বলেছে, তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানে। যাদের তিনি বহিষ্কার করেছিলেন, তারা তো আসেনি। অন্যরা এসে বলেছেন, এই স্থায়ী কমিটিতে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এসব চিঠিপত্র আমার কাছে রয়েছে। বইয়ে দেখতে পাবেন।
সমকাল : ওই সময় নানা বিষয়ে সংস্কারের কথা হতো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগই ব্যর্থ। আপনারা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা কতটা সফল হয়েছে?
সাখাওয়াত হোসেন : আমাদের অগ্রাধিকার ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে মোটাদাগে তিনটি বিষয় ঠিক করতে চেয়েছি। প্রথম ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা। কারণ এটিই সব গণ্ডগোলের মূল। কীভাবে গ্রহণযোগ্য, জনগণের অংশগ্রহণমূলক ভোটার তালিকা করা যায়, যাতে সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন না ওঠে। আমরা পুরনো প্রক্রিয়া স্টাডি করে দেখলাম, নাগরিকের জানার সুযোগ নেই যে ভোটার তালিকা কে কখন তৈরি করছে। কার নাম আছে, কার নাম নেই, তা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে দেখার সুযোগ নেই। নির্বাচনের দিন গিয়ে দেখে, নাম নেই বা নাম আছে, ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। কীভাবে এই ভোটার তালিকা হবে? পদ্ধতিগত জটিলতা ছিল। সামরিক বাহিনী এটা করবে কি-না, এ নিয়ে দাতা সংস্থার আপত্তি ছিল। আমি বললাম, সেনাবাহিনীর বিকল্প কী? অতীতে ছবি তুলতে গিয়ে লেজেগোবরে হয়েছিল। এবারও শঙ্কা ছিল, সেনাবাহিনী কি সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে পারবে? কেউ যদি ইচ্ছা করে বিলম্ব করিয়ে দেয়? অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার স্বস্তি এসেছিল। ভোটার তালিকা তৈরির কাজ সেনবাহিনীর জন্যও দেশে-বিদেশে সুনাম বয়ে এনেছে।
সমকাল : অন্য দুটি চ্যালেঞ্জ কী কী?
সাখাওয়াত হোসেন : দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল আইনি। যে আইন দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবেন, সেটা যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়, যদি ফাঁক থাকে, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে আইনের অপব্যাখ্যা হয় অনেক। প্রচারের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যয়, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ছিল নিয়মিত। দেয়াল দখল নিয়েও মারামারি হতো। সবার পরামর্শ নিয়ে এগুলো আমরা বন্ধ করেছি। যে কারণে কেউ বিরোধিতা করেনি, আইন পাসের সময় কেউ আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষের বিশ্বাস জন্মেছে যে, পরিচ্ছন্ন নির্বাচনী প্রচার চলতে পারে। পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও মানুষ আইন মেনেছে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। বিশেষ করে আমাদের ঠিক আগের নির্বাচন কমিশন ভাবমূর্তির যে ড্যামেজ করে গিয়েছিল, সেটা পুনরুদ্ধার করা। এর একমাত্র পথ ছিল আমরা যে ভিন্নভাবে ভিন্ন ধরনের কাজ করছি, সেটা জনগণকে জানানো। আমরা নিজেরা মাঠপর্যায়ে গিয়েছি। মানুষ যাতে বোঝে, নির্বাচন কমিশন কী। জনগণের দোরগোড়ায় গিয়ে আমরা নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছি। সব কাজে স্বচ্ছতা বজায় রেখেছি। আগের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক তিক্ততম হয়ে পড়েছিল। আমরা দূরত্ব কমিয়ে আনায় মনোযোগ দিয়েছিলাম। পরিবর্তনগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যও তো মিডিয়া দরকার। পরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানেও মিডিয়া আমাদের ব্যাপক সহায়তা করেছে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফিরে এসেছে। এখন এই আস্থা ধরে রাখাই হবে নতুন কমিশনের চ্যালেঞ্জ।
সমকাল : আপনারা কতখানি সফল? যদি নিজেদের নম্বর দিতে বলি, দশে কত দেবেন?
সাখাওয়াত হোসেন : আমি দশে পৌনে নয় দেব। একটু কম কেন? কিছু কাজ আমরা সম্পন্ন করতে পারিনি। যেমন সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করার কাজ শুরু করেছি, শেষ করতে পারিনি। নির্বাচন কমিশনের জনবলের উচ্চতর প্রশিক্ষণের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, শেষ করতে পারিনি। ইভিএম আমরা সূচনা করেছি, সব নির্বাচনে ব্যবহারের পর্যায়ে নিতে পারিনি। ভোটার আইডি কার্ড, স্মার্ট কার্ড করার চিন্তা-ভাবনা ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। নির্বাচনে অদৃশ্য অর্থের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। মনোনয়ন কেনাবেচা বন্ধ করা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ভবনের ব্যাপারে আমরা সব করেছি; কিন্তু সেটা মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়ালে আমাদের ভালো লাগত। আমি মনে করি, ছয়-সাত বছর সময় পেলে সব সম্পন্ন করা যেত। এসব নিয়ে আমাদের অতৃপ্তি রয়েছে। আমি ব্যর্থতা বলব না। তবে আসার আগে আমরা পাঁচ বছরের পরিকল্পনা এবং দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা রেখে এসেছি। আশা করি, নতুন কমিশন সেটাকে কাজে লাগাবে।
সমকাল : প্রত্যেক নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেই বিরোধী দলের সমালোচনা দেখা যায়। আপনাদের ব্যাপারেও খানিকটা ছিল। এর কারণ কী?
সাখাওয়াত হোসেন : এটা আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা সহযোগিতা করলেই কেবল নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। রাজনীতিতে অবিশ্বাসের কারণেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এসেছিল।
সমকাল : শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন : এটা একেবারে ভুল ধারণা। নির্বাচন কমিশন কখনও সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কমিশনের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দিলেও সম্ভব নয়। তার কাজ হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনা করা, দেশ পরিচালনা নয়। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন যে সরকারই হোক, তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করা। আমরাও শেষে বলে এসেছি যে, চারটি মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের কাছে দিতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। মূল কথা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যা চায়, তা করতে হবে। যা করতে নিষেধ করবে, কেউই করবে না। তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
সমকাল : বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে?
সাখাওয়াত হোসেন : আমি আশাবাদী, কিছু একটা সমাধান হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় নির্বাচন হতে হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না, টেকসই হবে না।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাখাওয়াত হোসেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
সমকাল : আমরা শুনেছি, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনার একটি বই প্রকাশিত হওয়ার পথে। সেটি কত দূর?
সাখাওয়াত হোসেন : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই আমি লিখেছি। সেটা ঠিক গবেষণাধর্মী নয়, নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্ণনাধর্মী বই। নির্বাচন কমিশনে যাওয়াটা আমার জন্য অপ্রত্যাশিতই ছিল। একটি কুয়াসি-জুডিসিয়ারি সংস্থায় কাজ করার কথা আগে কখনও ভাবিনি। ফলে আমার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। গত পাঁচ বছর নির্বাচন কমিশনে কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথাই আমি বইয়ে তুলে ধরছি। প্রথম দফা লেখার পর এখন সম্পাদনা করছি। বইটি বাজারে আসতে আরও তিন-চার মাস লেগে যাবে।
সমকাল : নির্বাচন কমিশনের প্রধান পদে আমরা দেখেছি বিচারপতিরা বেশি দায়িত্ব পেয়েছেন। তুলনামূলক কম হলেও আমলারাও ছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ছিলেন, এমন কেউ আপনার আগে নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পাননি। আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন কমিশনে কাজ করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জের ছিল দুই কারণে। প্রথমত, ওই সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের নেপথ্যে ছিল সেনাবাহিনী। আবার আমি নিজেও সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলাম। এর আগে সেনাবাহিনী থেকে কেউ নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে নির্বাচন কমিশনে আমার ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভিন্নতর ব্যাখ্যার সুযোগ ছিল। সেটা হয়েছেও। তবে আমি নিজে কখনও মনে করিনি যে, দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কিংবা সামরিক শাসন দেশের জন্য কখনও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। যদিও উপমহাদেশের সামরিক শাসনের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর সামরিক শাসনের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সব সামরিক শাসনেরই কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের জন্য সহায়ক হয় না। সামরিক শাসন যদি বেসামরিক চেহারা পায়, অতীতে এ দেশে যা দেখা গেছে, তার অনেক ভালো দিক থাকতে পারে; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য কখনও সহায়ক হয় না। এই বিষয়টি সবসময়ই আমার মাথায় থাকে। যে কারণে আমাকে নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও তা অমূলক ছিল। আত্মবিশ্বাসের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, আমি আর দশজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার মতো ছিলাম না। কেউ বলতে পারেনি যে, হঠাৎ করে অপরিচিত কাউকে এনে বসানো হয়েছে। আমার ভালো-মন্দ মোটামুটি অনেকের জানা ছিল। নিজে দীর্ঘদিন সিভিল সোসাইটির সঙ্গে মিশেছি। লেখালেখি করেছি। শাসন পদ্ধতি, নির্বাচন, রাজনীতি নিয়ে আমার নিজেরও বক্তব্য ছিল। আমার লক্ষ্য ছিল একটাই, কীভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারি। ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমি সেটা ভুলিনি।
সমকাল : আপনি নিজের দিক থেকে স্বচ্ছ ছিলেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কি কোনো সুবিধা-অসুবিধা তৈরি করেছে? বিশেষ করে সে সময় পর্দার অন্তরালে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
সাখাওয়াত হোসেন : কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো অসুবিধা বোধ করিনি। বরং ওই সময় আমি কিছুটা সুবিধাই পেয়েছি। কারণ, আমি আঁচ করতে পারতাম কী ঘটছে, কী ঘটতে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই হয়তো তারা (সামরিক বাহিনী) আমার ওপর নির্ভর করত। আমি সেই সম্পর্ককে সুষ্ঠু নির্বাচনের কাজে সদ্ব্যবহার করেছি। নির্বাচন কমিশন এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে আমি কাজ করেছি। আমি থাকাতে দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়েছিল। যৌথ সভাগুলোতে আমি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতাম। বিশেষ করে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময়। এটির ধারণাগত ও পদ্ধতিগত দিক ঠিক করার ক্ষেত্রে আমরা সবাই মিলে যে কাজ করেছি, সেই পরিবেশ তৈরি করা, ভাবনা আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে আমার একটা বড় ভূমিকা ছিল।
সমকাল : ওই সময় নানা আশঙ্কার কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াত। নির্বাচন নাও হতে পারে_ এমন শঙ্কা কি কখনও আপনার মনে দেখা দিয়েছিল?
সাখাওয়াত হোসেন : যেহেতু সামরিক বাহিনী ওই সময় ক্ষমতা গ্রহণ কিংবা সেনাসমর্থিত সরকার প্রলম্বিত করার উচ্চাভিলাষ একেবারেই প্রদর্শন করেনি, সেহেতু আমি কখনও মনে করিনি যে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা হতে পারে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যখনই কথাবার্তা হতো, আমি পরিষ্কার বলতাম নির্বাচন না হওয়ার নূ্যনতম আশঙ্কাও যদি দেখা দেয়, নির্বাচন কমিশনে আমার থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ আমি জানি, নির্বাচন যদি না হয়, সেনাবাহিনী যদি ক্ষমতা গ্রহণ করে, আমার ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক, অনেকখানি দায় আমার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে। সাংবাদিকরাও প্রায়শই আমাকে প্রশ্ন করতেন যে, নির্বাচন হবে কি? আমি ঠাট্টা করে বলতাম, সকালে এসে যদি দেখেন আমি আসিনি, 'স্বাস্থ্যগত কারণে' পদত্যাগ করেছি, তাহলে বুঝবেন নির্বাচন হবে না।
সমকাল : আপনাদের জন্য তখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সব দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
সাখাওয়াত হোসেন : আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা একবার তৈরি হয়েছিল। একেবারে শেষ দিকে। সবকিছু প্রস্তুত। কেবল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা বাকি। সে নিয়ে দুই প্রধান দলের মধ্যে মতবিরোধ। এক পর্যায়ে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, এই কথা শোনা যাচ্ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা নেগোসিয়েশন করছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তখন নির্বাচন নিয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, নির্বাচন ভেস্তে গেলে দীর্ঘমেয়াদে অনির্বাচিত সরকারের হাতে চলে যাবে। মনে হচ্ছিল, নতুন আরেকটি সরকার আসছে। একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সভায় গিয়ে আমার মনে হলো, অনেকে চান না নির্বাচন যথাসময়ে হোক। ওই সময় যারা দুই দলের মধ্যে সমঝোতার দায়িত্বে ছিলেন, তারা সবাই আন্তরিক ছিলেন কি-না, আমার সন্দেহ আছে। এক পর্যায়ে সেটা ব্যর্থও হলো। এর পরপরই কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা বললাম যে নির্বাচন যথাসময়েই হবে। তখন কোনো কোনো বিশেষ সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কয়েক দফা ছোটখাটো তর্ক পর্যন্ত হয়েছে। আমি তাদের ক্যাটাগরিক্যালি বলেছি, নির্বাচন না হলে যে জাতীয় সংকট তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়ার মতো নেতৃত্ব আমার চোখের সামনে কেউ নেই। দুই বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নির্বাচন কমিশনের কথা হয়েছে। আমি নিজে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। সবাইকে আমরা বলেছি, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে দেশ যে বিরাট সংকটে পড়বে, তা থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। পরে সবাই কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্বাচনে এসেছে। সেটা ছিল সত্যিই এক সন্ধিক্ষণ।
সমকাল : নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বিএনপি বিভক্ত করতে চাইছে।
সাখাওয়াত হোসেন : এই অভিযোগ সত্য নয়। তখন নির্বাচন কমিশন বরং চেয়েছে সবাই মিলেমিশে থাকুক। ভালোয় ভালোয় নির্বাচন হয়ে যাক। তখনকার বিএনপির দুই অংশকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তখন বিএনপির কোনো অংশই কিন্তু বলেনি যে তারা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধের বিএনপি। দু'পক্ষই বলেছে, তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানে। যাদের তিনি বহিষ্কার করেছিলেন, তারা তো আসেনি। অন্যরা এসে বলেছেন, এই স্থায়ী কমিটিতে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এসব চিঠিপত্র আমার কাছে রয়েছে। বইয়ে দেখতে পাবেন।
সমকাল : ওই সময় নানা বিষয়ে সংস্কারের কথা হতো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগই ব্যর্থ। আপনারা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা কতটা সফল হয়েছে?
সাখাওয়াত হোসেন : আমাদের অগ্রাধিকার ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে মোটাদাগে তিনটি বিষয় ঠিক করতে চেয়েছি। প্রথম ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা। কারণ এটিই সব গণ্ডগোলের মূল। কীভাবে গ্রহণযোগ্য, জনগণের অংশগ্রহণমূলক ভোটার তালিকা করা যায়, যাতে সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন না ওঠে। আমরা পুরনো প্রক্রিয়া স্টাডি করে দেখলাম, নাগরিকের জানার সুযোগ নেই যে ভোটার তালিকা কে কখন তৈরি করছে। কার নাম আছে, কার নাম নেই, তা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে দেখার সুযোগ নেই। নির্বাচনের দিন গিয়ে দেখে, নাম নেই বা নাম আছে, ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। কীভাবে এই ভোটার তালিকা হবে? পদ্ধতিগত জটিলতা ছিল। সামরিক বাহিনী এটা করবে কি-না, এ নিয়ে দাতা সংস্থার আপত্তি ছিল। আমি বললাম, সেনাবাহিনীর বিকল্প কী? অতীতে ছবি তুলতে গিয়ে লেজেগোবরে হয়েছিল। এবারও শঙ্কা ছিল, সেনাবাহিনী কি সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে পারবে? কেউ যদি ইচ্ছা করে বিলম্ব করিয়ে দেয়? অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার স্বস্তি এসেছিল। ভোটার তালিকা তৈরির কাজ সেনবাহিনীর জন্যও দেশে-বিদেশে সুনাম বয়ে এনেছে।
সমকাল : অন্য দুটি চ্যালেঞ্জ কী কী?
সাখাওয়াত হোসেন : দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল আইনি। যে আইন দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবেন, সেটা যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়, যদি ফাঁক থাকে, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে আইনের অপব্যাখ্যা হয় অনেক। প্রচারের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যয়, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ছিল নিয়মিত। দেয়াল দখল নিয়েও মারামারি হতো। সবার পরামর্শ নিয়ে এগুলো আমরা বন্ধ করেছি। যে কারণে কেউ বিরোধিতা করেনি, আইন পাসের সময় কেউ আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষের বিশ্বাস জন্মেছে যে, পরিচ্ছন্ন নির্বাচনী প্রচার চলতে পারে। পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও মানুষ আইন মেনেছে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। বিশেষ করে আমাদের ঠিক আগের নির্বাচন কমিশন ভাবমূর্তির যে ড্যামেজ করে গিয়েছিল, সেটা পুনরুদ্ধার করা। এর একমাত্র পথ ছিল আমরা যে ভিন্নভাবে ভিন্ন ধরনের কাজ করছি, সেটা জনগণকে জানানো। আমরা নিজেরা মাঠপর্যায়ে গিয়েছি। মানুষ যাতে বোঝে, নির্বাচন কমিশন কী। জনগণের দোরগোড়ায় গিয়ে আমরা নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছি। সব কাজে স্বচ্ছতা বজায় রেখেছি। আগের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক তিক্ততম হয়ে পড়েছিল। আমরা দূরত্ব কমিয়ে আনায় মনোযোগ দিয়েছিলাম। পরিবর্তনগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যও তো মিডিয়া দরকার। পরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানেও মিডিয়া আমাদের ব্যাপক সহায়তা করেছে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফিরে এসেছে। এখন এই আস্থা ধরে রাখাই হবে নতুন কমিশনের চ্যালেঞ্জ।
সমকাল : আপনারা কতখানি সফল? যদি নিজেদের নম্বর দিতে বলি, দশে কত দেবেন?
সাখাওয়াত হোসেন : আমি দশে পৌনে নয় দেব। একটু কম কেন? কিছু কাজ আমরা সম্পন্ন করতে পারিনি। যেমন সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করার কাজ শুরু করেছি, শেষ করতে পারিনি। নির্বাচন কমিশনের জনবলের উচ্চতর প্রশিক্ষণের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, শেষ করতে পারিনি। ইভিএম আমরা সূচনা করেছি, সব নির্বাচনে ব্যবহারের পর্যায়ে নিতে পারিনি। ভোটার আইডি কার্ড, স্মার্ট কার্ড করার চিন্তা-ভাবনা ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। নির্বাচনে অদৃশ্য অর্থের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। মনোনয়ন কেনাবেচা বন্ধ করা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ভবনের ব্যাপারে আমরা সব করেছি; কিন্তু সেটা মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়ালে আমাদের ভালো লাগত। আমি মনে করি, ছয়-সাত বছর সময় পেলে সব সম্পন্ন করা যেত। এসব নিয়ে আমাদের অতৃপ্তি রয়েছে। আমি ব্যর্থতা বলব না। তবে আসার আগে আমরা পাঁচ বছরের পরিকল্পনা এবং দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা রেখে এসেছি। আশা করি, নতুন কমিশন সেটাকে কাজে লাগাবে।
সমকাল : প্রত্যেক নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেই বিরোধী দলের সমালোচনা দেখা যায়। আপনাদের ব্যাপারেও খানিকটা ছিল। এর কারণ কী?
সাখাওয়াত হোসেন : এটা আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা সহযোগিতা করলেই কেবল নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। রাজনীতিতে অবিশ্বাসের কারণেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এসেছিল।
সমকাল : শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন : এটা একেবারে ভুল ধারণা। নির্বাচন কমিশন কখনও সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কমিশনের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দিলেও সম্ভব নয়। তার কাজ হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনা করা, দেশ পরিচালনা নয়। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন যে সরকারই হোক, তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করা। আমরাও শেষে বলে এসেছি যে, চারটি মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের কাছে দিতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। মূল কথা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যা চায়, তা করতে হবে। যা করতে নিষেধ করবে, কেউই করবে না। তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
সমকাল : বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে?
সাখাওয়াত হোসেন : আমি আশাবাদী, কিছু একটা সমাধান হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় নির্বাচন হতে হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না, টেকসই হবে না।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাখাওয়াত হোসেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments