এসব খুঁটির জোর by শেখ রোকন
দুই পাড়ে সীমানা পিলার বসিয়ে নদী রক্ষার আয়োজন খানিকটা অভিনবই বটে; কিন্তু যথেষ্ট বিলম্ব করে গাজীপুর জেলা প্রশাসন যেভাবে পিলার বসাচ্ছে, তা আরও অভিনব। শুকনো মৌসুমে এসে প্রায় তলানি দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির রেখা আর যাই হোক নদীর 'সীমানা' যে হতে পারে না,
তা শিশু-কিশোরেরও বোঝার কথা। বর্ষা মৌসুমে তুরাগের পানি যখন উচ্চতা ও বিস্তৃতিতে আরও বেড়ে সীমানা খুঁটিগুলোকে অতিক্রম করবে, তখন আমরা কী বলব? বলব যে তুরাগই উল্টো লোকজনের ভূমি দখল করছে! আর পায়ে হাঁটার পথ নির্মাণ করা হবে নদী ভরাট করে!
অথচ নদীর সীমানা চিহ্নিত করার শাস্ত্রীয় নানা পদ্ধতি রয়েছে। কোনো কোনোমতে নদীর তীর হচ্ছে স্বাভাবিক জোয়ারে পানি যতদূর যায় ততদূর। অন্যভাবে_ শুকনো মৌসুমে পানির রেখা যেখানে থাকে এবং বর্ষা মৌসুমে যেখানে পেঁৗছে, তার মাঝামাঝি। তুরাগের সীমানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এর কোনোটিই মেনে চলা হয়নি। বড় কথা, হাইকোর্টের রায়ে তো স্পষ্ট করেই দেওয়া হয়েছে যে সিএস ও আরএস জরিপ মেনে নদীর অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে। যদি ইতিমধ্যে নদী সরে গিয়ে থাকে, তাহলে ওই ভূমি হবে সরকারি সম্পত্তি। কেউ যদি সন্দেহ করে, হাইকোর্টের আদেশে গোঁজামিল দিতেই সীমানা পিলার বসানোর জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয়েছে, জবাব কী?
সন্দেহ নেই, দিগন্ত বিস্তৃত স্রোতস্বিনীকে গবাদিপশুর মতো খোঁয়াড়ে আটকে রাখার বন্দোবস্ত নিয়ে পরিবেশবাদীদের কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন। বিশ্বের আর কোথাও এভাবে নদী সুরক্ষার আয়োজন হয়েছে কি-না অন্তত আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে বিশেষ করে নগর সংশ্লিষ্ট নদীগুলো দখলের সম্মুখীন হয়েছে, তাতে অন্য উপায়ই-বা কোথায়? উপযুক্ত আইন আছে, বিধান আছে, দায়িত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষ আছে; কিন্তু নদী দখল ঠেকানো যাচ্ছিল না। আমরা দেখেছি, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। কাজ হয়নি। প্রত্যেক দফা উচ্ছেদের পর দ্বিগুণ উদ্যমে দখলদাররা ফিরে এসেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি, আলোচনা হয়েছে; পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সভা-সমাবেশ করেছে, জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়েছে। সবই হয়েছে, কাজ হয়নি।
বস্তুত নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী হত্যার বেদনাদায়ক এ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই ২০০৯ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে খুঁটি বসিয়ে নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। কেবল তাই নয়, তীর বরাবর পায়ে হাঁটার পথ তৈরি এবং সারি করে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। হাইকোর্ট থেকে জেলা চারটির প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ১৯১৩ সালের সিএস জরিপ ও ১৯৮৩ সালের আরএস জরিপ রেকর্ড অনুযায়ী যেন নদী চারটির প্রকৃত অবস্থান শনাক্ত করে সীমানা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ডেইলি স্টারকে যথার্থই বলেছেন, বাস্তবে আসলে হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনই করা হচ্ছে।
এভাবে শুকনো মৌসুমে পানির রেখা বরাবর খুঁটি বসিয়ে বিদ্যমান দখলদারিত্বকেই কেবল বৈধতা দেওয়া হচ্ছে না
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন ঢাকা ঘিরে থাকা চারটি নদীর সীমানা খুঁটি বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল, আমরা আশা করেছিলাম এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম আদালত ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসানো খুঁটি দখলদারদের হটিয়ে দেবে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে দখলদারদের খুঁটির জোর এত বেশি যে, এসব খুঁটির মধ্য দিয়ে তাদের স্বত্বই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে!
skrokon@gmail.com
অথচ নদীর সীমানা চিহ্নিত করার শাস্ত্রীয় নানা পদ্ধতি রয়েছে। কোনো কোনোমতে নদীর তীর হচ্ছে স্বাভাবিক জোয়ারে পানি যতদূর যায় ততদূর। অন্যভাবে_ শুকনো মৌসুমে পানির রেখা যেখানে থাকে এবং বর্ষা মৌসুমে যেখানে পেঁৗছে, তার মাঝামাঝি। তুরাগের সীমানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এর কোনোটিই মেনে চলা হয়নি। বড় কথা, হাইকোর্টের রায়ে তো স্পষ্ট করেই দেওয়া হয়েছে যে সিএস ও আরএস জরিপ মেনে নদীর অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে। যদি ইতিমধ্যে নদী সরে গিয়ে থাকে, তাহলে ওই ভূমি হবে সরকারি সম্পত্তি। কেউ যদি সন্দেহ করে, হাইকোর্টের আদেশে গোঁজামিল দিতেই সীমানা পিলার বসানোর জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয়েছে, জবাব কী?
সন্দেহ নেই, দিগন্ত বিস্তৃত স্রোতস্বিনীকে গবাদিপশুর মতো খোঁয়াড়ে আটকে রাখার বন্দোবস্ত নিয়ে পরিবেশবাদীদের কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন। বিশ্বের আর কোথাও এভাবে নদী সুরক্ষার আয়োজন হয়েছে কি-না অন্তত আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে বিশেষ করে নগর সংশ্লিষ্ট নদীগুলো দখলের সম্মুখীন হয়েছে, তাতে অন্য উপায়ই-বা কোথায়? উপযুক্ত আইন আছে, বিধান আছে, দায়িত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষ আছে; কিন্তু নদী দখল ঠেকানো যাচ্ছিল না। আমরা দেখেছি, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। কাজ হয়নি। প্রত্যেক দফা উচ্ছেদের পর দ্বিগুণ উদ্যমে দখলদাররা ফিরে এসেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি, আলোচনা হয়েছে; পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সভা-সমাবেশ করেছে, জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়েছে। সবই হয়েছে, কাজ হয়নি।
বস্তুত নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী হত্যার বেদনাদায়ক এ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই ২০০৯ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে খুঁটি বসিয়ে নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। কেবল তাই নয়, তীর বরাবর পায়ে হাঁটার পথ তৈরি এবং সারি করে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। হাইকোর্ট থেকে জেলা চারটির প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ১৯১৩ সালের সিএস জরিপ ও ১৯৮৩ সালের আরএস জরিপ রেকর্ড অনুযায়ী যেন নদী চারটির প্রকৃত অবস্থান শনাক্ত করে সীমানা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ডেইলি স্টারকে যথার্থই বলেছেন, বাস্তবে আসলে হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনই করা হচ্ছে।
এভাবে শুকনো মৌসুমে পানির রেখা বরাবর খুঁটি বসিয়ে বিদ্যমান দখলদারিত্বকেই কেবল বৈধতা দেওয়া হচ্ছে না
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন ঢাকা ঘিরে থাকা চারটি নদীর সীমানা খুঁটি বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল, আমরা আশা করেছিলাম এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম আদালত ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসানো খুঁটি দখলদারদের হটিয়ে দেবে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে দখলদারদের খুঁটির জোর এত বেশি যে, এসব খুঁটির মধ্য দিয়ে তাদের স্বত্বই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে!
skrokon@gmail.com
No comments