নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- দুজনের ভোট সমান, কিন্তু একজন জয়ী by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে সরকার-সমর্থক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) জয়ী হয়েছে। এ সংবাদ পাঠক ইতিমধ্যেই জেনেছেন। নির্বাচনের ফল যে বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) প্রত্যাখ্যান করেছে, এ কথাও অজানা নয়।
দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে আমাদের দেশে যেকোনো সরকারের আমলে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচনে সরকার-সমর্থকদের বিজয়ী হওয়া এবং বিরোধী দল-সমর্থিতদের পরাজয় ও ফল প্রত্যাখ্যান স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে একটি ছবি ছাপা হয়েছে এ রকম—চট্টগ্রামে বিএমএর নির্বাচন শেষে ভোট গণনার একপর্যায়ে ব্যালট বাক্সের ওপর শুয়ে পড়ে ছিনতাইয়ের হাত থেকে ব্যালট রক্ষার চেষ্টা করছেন একজন প্রার্থী। কথায় আছে, ছবি কথা বলে। বিএমএ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে, প্রতিবাদ জানিয়ে বা সংবাদ সম্মেলন করে ড্যাব যে কথাটি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে গলদঘর্ম হচ্ছিল, এই ছবি তার চেয়ে অনেক জোরালো প্রমাণই যেন হাজির করেছে দেশবাসীর কাছে।
ব্যালট বাক্স যিনি আঁকড়ে ধরে ছিলেন তিনি ড্যাবের কেউ নন, চট্টগ্রামে স্বাচিপেরই বিদ্রোহী সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মিনহাজুর রহমান। ভোট গণনার একেবারের শেষ মুহূর্তের ছবি এটি।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন সাংবাদিকের সাক্ষ্যে ভোট গণনার শেষ মুহূর্তটির বর্ণনা দিতে চাই। সাধারণ সম্পাদক পদে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল স্বাচিপেরই দুই প্রার্থী মোহাম্মদ শরীফ ও মিনহাজুর রহমানের মধ্যে। কখনো শরীফ এগিয়ে যান, কখনো মিনহাজুর। এ রকম স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনার একপর্যায়ে দুজনের ভোট সংখ্যা হয়ে পড়ে সমান। তখন মাত্র আর একটি ব্যালট বাকি আছে। এই ব্যালটের ভোট দিয়ে নির্ধারিত হবে জয়-পরাজয়। ব্যালটটি ওলটানো হলো, সেটিতে মিনহাজুর রহমানের পক্ষে রায় দেওয়া আছে। কিন্তু এই ভোটটি যথাযথ হয়নি দাবি করে সেখানেই সেটি ছিঁড়ে ফেলেন স্বাচিপের কর্মীরা। এখানেই শেষ হয়নি এই কর্মীদের বীরত্ব। তাঁরা নির্বাচন কমিশনার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বুথের সব ব্যালট জোর করে নিয়ে যান। এসব ঘটনা ঘটেছে সাংবাদিকদের সামনেই। নির্বাচন কমিশনার কাজী শফিকুল আলম ব্যালট ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘কিছু ব্যালট পেপার আমার সামনে থেকে নিয়ে গেছে’ (প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর)।
মোহাম্মদ শরীফের সমর্থকেরা তাঁর সামনে থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে গেছেন, এ কথা নির্বাচন কমিশনার স্বীকার করেছেন বৃহস্পতিবার রাতে, কিন্তু শুক্রবার দিনের বেলায় তিনি শরীফকেই নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন। কেন এমন করলেন তিনি? এ কথা জানার জন্য বারবার ফোন করেও তাঁর ফোন বন্ধ পেয়েছেন সাংবাদিকেরা। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নির্বাচন ও তার ফলাফল সম্পর্কে কিছু বলার মতো মুখ তাঁর নেই।
শরীফের সমর্থকেরা দাবি করেছিলেন, শেষ ব্যালটটির ভোট ‘নিয়মমাফিক’ হয়নি, তাই সেটা বাতিল করতে হবে। তাঁদের দাবি যদি সত্যি বলেও ধরে নিই, তাহলেও দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা হয় সমান (দুজনেই এক হাজার এক ভোট)। সমান ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বিজয়ী ঘোষণা করার কারণ বা যুক্তি আমরা জানতে পারলাম না নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে, আর কখনোই হয়তো পারব না। কারণ, নির্বাচন কমিশনার হলেও তিনি সরকারি চাকরিরত একজন চিকিৎসকই। তাঁর কাঁধে মাথা একটি, এবং ‘বদলি-আতঙ্ক’ অন্যদের মতো তাঁরও আছে।
নানা সময়ে নানা অনিয়মের কথা মনে রেখেও বলি, পেশাজীবীদের নির্বাচনে প্রকাশ্যে ব্যালট ছিঁড়ে ফেলা বা নির্বাচন কমিশনারের সামনে থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া স্মরণকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে হয়েছে আমাদের। এককালে স্থানীয় নির্বাচন বা ছাত্র সংসদের নির্বাচনে নানা অনিয়ম, সহিংসতা, বল প্রয়োগ দেখেছি আমরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ডাকসু নির্বাচনে পরাজয়ের আভাস পেয়ে ছাত্রলীগের ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা এখনো কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। জাসদ ছাত্রলীগ-সমর্থিত মাহবুব-জহুর পরিষদের নিশ্চিত বিজয় সেদিন ছিনতাই হয়েছিল বটে, কিন্তু ছাত্রছাত্রী বা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। আজ যারা ব্যালট ছিঁড়ে ফেলা বা কেড়ে নেওয়ার সাফল্যে উদ্দীপ্ত (?), তাদের ইতিহাসের সেই পাতাটি একবার উল্টে দেখতে বলি।
জিয়া-এরশাদ দুই সামরিক শাসকের আমলে অনুষ্ঠিত ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনে সরকারের পূর্বনির্ধারিত ফলাফল আদায়ে কেন্দ্র দখল থেকে মিডিয়া ক্যু পর্যন্ত সব রকম অনিয়ম হয়েছে। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে ক্রমশ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার যে উন্নতি হয়েছে, তা-ও সবাইকে স্বীকার করতে হবে। এখন নির্বাচনব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে বলতে হবে। বলতে ভালো লাগছে, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে ইচ্ছামতো সিল মারার যুগ প্রায় পেরিয়ে এসেছি আমরা। বর্তমান সরকারের আমলে বেশ কিছু স্থানীয় নির্বাচন বা উপনির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ পর্ব দেখে, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পরাজয় দেখে এই প্রত্যয় আমাদের জন্মেছে যে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে সহিষ্ণুতা বেড়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে মূল্য দেওয়ার সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করছে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ।
এই ইতিবাচক পরিবর্তনের কালে পেশাজীবীদের নির্বাচনে এমন নেতিবাচক ঘটনা আমাদের মনে হতাশার সৃষ্টি করে। চট্টগ্রামে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (ড্যাব) প্রার্থীরা বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন স্বাচিপের কাছে। কিন্তু স্বাচিপের একজন বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করতে পারল না একই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা।
সমগ্র দেশের প্রেক্ষাপটে বিএমএ নির্বাচনের তাৎপর্য থাকলেও চট্টগ্রাম শাখার ভোট গ্রহণ পর্বের গুরুত্ব হয়তো ততটা নয়। কিন্তু এই যে আস্থার সংকট তৈরি হলো, এটার সুদূরপ্রসারী মূল্য আছে বলে মনে হয় আমাদের। একটি পেশাজীবী নির্বাচনে এ রকম অনিয়ম হলে, তার কোনো রকম প্রভাব কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে না? এ রকম প্রশ্ন মানুষের মনে উঠলে তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে? কেননা, আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবই।
 বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.