চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-ধর্মতন্ত্রী জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ by যতীন সরকার
এ বছরের (২০১২) নভেম্বরেই খবরটি বেরিয়েছিল। ৫ নভেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম ছিল- 'এশিয়ান টাইগার হতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র : মজিনা।'
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) আয়োজিত এক সভায় অনেক রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদের উপস্থিতিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা তাঁর বচনামৃত পরিবেশন করছিলেন।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন জানিয়েছে-
"স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবিলা, জাতীয় নিরাপত্তা, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহায়তার কথা তুলে ধরে মজিনা বলেন, 'আমি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছি। আগামীর এশিয়ান টাইগারের জন্ম দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে মার্কিন দূতাবাস কাজ করবে।' তিনি বলেন, 'এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে। বছরে এ সাহায্যের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে'।"
অর্থাৎ আমেরিকা যে আজ বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত তারই নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো ভয়ে শিউরে উঠছি এই ভেবে, তাঁর এই নিশ্চয়তা দান তো আসলে বাংলাদেশের জন্য একান্ত অনিশ্চয়তার বার্তাই বহন করে এনেছে। শুধু অনিশ্চয়তা নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর নিশ্চয়ই নেমে আসছে নগ্নতর হস্তক্ষেপ। 'আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই'- এককালের ভিয়েতনামের এক নেতার এ উক্তিটি আমার বারবারই মনে পড়ছে। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে কোনোরূপ ধানাইপানাই না করে আমাদের প্রকাশ্য শত্রুতা করছিল, তখন আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করছিলাম। কারণ তখন তো স্পষ্টভাবে আমরা জেনে নিয়েছিলাম আমেরিকা আমাদের শত্রু, বন্ধুর ছদ্মবেশ ধরে আমাদের প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করছে না। কিন্তু আজ যখন সেই আমেরিকা আমাদের পাশে থাকার অভয়বাণী প্রদান করছে, তখনই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। 'অ্যামচেম'-এর সভায় মজিনা সাহেব বন্ধুত্বের বার্তা আমাদের কানে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন যেদিন, তার কয়েক দিন যেতে না যেতেই তিনি আমাদের সরকারকে বিশেষ পরামর্শ দিয়ে বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন। সেই পরামর্শটি হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধরত মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে সংলাপে বসার।
বেশ কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রর কাছ থেকে 'মডারেট মুসলিম শক্তি' অভিধা পেয়ে গেছে ধর্মতন্ত্রী জঙ্গি মৌলবাদী সেই গোষ্ঠীটি, যেটি দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়েই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিল। ওরাই ছিল স্বাধীনতার ঘৃণ্য দুশমন রাজাকার, ওরাই তৈরি করেছিল আলবদর-আলশামসের মতো হন্তারক সংগঠন, ওদের হাতেই অপহৃত হয়েছিল আমাদের মাতা-বধূ-কন্যাদের সম্ভ্রম এবং অগণিত মানুষের ধন-প্রাণ। ওরাই আমাদের বিজয়ের পূর্বক্ষণে হত্যা করেছিল দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের। স্বাধীন বাংলাদেশেও ওরা অব্যাহত রেখেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপকর্ম। এই ২০১২ সালে তো ওরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আর ওদের সঙ্গেই কিনা সংলাপে বসার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নির্দেশ। হ্যাঁ, 'নির্দেশ'ই তো বলতে হয়। বর্তমানে এককেন্দ্রিক বিশ্বে নিজেদের যারা বিশ্বেশ্বর ভাবছে, বিশ্বের যেকোনো দেশকে পরামর্শের নামে নির্দেশই দেয় তারা। তাদের নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়টিও কথাবার্তায় ও ভাবভঙ্গিতে তারা জানিয়ে দেয়।
আর তাদের 'সহায়তা'? এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র- যে বাংলাদেশকে বেশি সহায়তা দেয়- এ কথা তো মজিনা সাহেব অ্যামচেমের সভায়ই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকার সহায়তায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কী দশা ঘটেছে ও ঘটছে তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশেও সহায়তাদানের পাশাপাশিই যে মার্কিনি উপদেশ তথা নির্দেশ আসছে, তার পরিণতি কল্পনা করা মোটেই কঠিন নয়।
তবে অনেকটা স্বস্তি পেলাম এ বিষয়ে সরকারি মহলের সচেতনতা প্রত্যক্ষ করে। 'মজিনার কড়া সমালোচনা সংসদে : জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি'- ১৯ নভেম্বর এই সংবাদ শিরোনামটি দেখেই খবরটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। ১৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে সিনিয়র সদস্যরা যা বলেন, তারই সারসংক্ষেপ এ রকম :
'জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার আহ্বানের কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে শক্তিধর দেশটির রাষ্ট্রদূত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টিকারীদের উৎসাহিত করেছেন। সংসদ সদস্যরা মজিনার প্রতি প্রশ্ন করেন, 'আপনার দেশের পুলিশের ওপর যদি তারা (জামায়াত-শিবির) হামলা করত, তাহলে কি আপনারা আক্রমণকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন?'
জাতীয় সংসদ সদস্যরা যে খুব একটা কড়া সমালোচনা করেছেন, তেমন মনে করা যায় না। তবু তাঁরা যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, এ জন্যই তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবু এর পরও বলি : এটুকুই যথেষ্ট নয়; সব ধরনের দোদুল্যমানতা পরিহার করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ না করতে পারলে এ ধরনের অবাঞ্ছিত অবস্থার প্রতিকার কোনো মতেই সম্ভব হবে না। যে প্রশ্ন সংসদ সদস্যরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রতি রেখেছেন, এর জবাবে তিনি কী বলবেন কিংবা আদৌ কিছু বলার গরজ তাঁর আছে কি না আমরা জানি না। তিনি হয়তো মার্কিন সহায়তাপুষ্ট একটি দেশের সংসদ সদস্যদের 'স্পর্ধা'র সমুচিত জবাব দেওয়ার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেই তাঁর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। এ রকম অবহিত করানোর দায়িত্ব দিয়েই তো দেশে দেশে মার্কিন দূতদের পাঠানো হয়ে থাকে।
একাত্তর সালে এবং তারও আগে, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকার কথাটিও এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি। শুধু আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রদূতদেরই নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিযুক্ত করে রেখেছিল এমন অনেক ব্যক্তি ও সংস্থাকে, যাদের নির্দেশও ছিল পাকিস্তান সরকারের জন্য অবশ্য পালনীয়। সে সময়কার এ রকমই একজন ক্ষমতাধর মার্কিন সাংবাদিকের অসাধারণ ক্ষমতার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৫৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকার পাকিস্তানের প্রতিনিধি সেই সাংবাদিকের নাম ছিল কালাহান।
সে বছর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ-বিরোধী যুক্তফ্রন্টের বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করার পর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী (আজাদ পত্রিকার ভাষায় 'উজিরে আলা')। নির্বাচনের কিছুদিন পরই শেরেবাংলা কলকাতায় যান এবং সেখানে তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। তাঁর সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় শেরেবাংলা প্রদত্ত বক্তৃতার একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট রিপোর্ট পাঠান কালাহান। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সেই রিপোর্টটিতে ছাপা হয়েছিল : সংবর্ধনার উত্তরে শেরেবাংলা এমন অনেক কথা বলেন যাতে বোঝা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বেই তাঁর বিশ্বাস নেই। তাঁর মতে, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে শুধু ভৌগোলিক দূরত্বই বিস্তর নয়, দুইয়ের সব কিছুই আলাদা; তাই তিনি এই কৃত্রিম রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে চান, তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চান।
শেরেবাংলা এই রিপোর্টের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, এটিকে তিনি 'মিথ্যার বেসাতি' বলে উল্লেখ করেছিলেন; দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছিলেন, তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিই শুধু করেছেন, স্বাধীনতার কথা বলেননি। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেরেবাংলার প্রতিবাদকে মোটেই আমল দিল না, মার্কিন সাংবাদিক কালাহানের কথাকেই অমোঘ সত্য বলে গ্রহণ করল। পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষকালের মধ্যেই চুয়ান্নর ৩০ মে, তা বাতিল করে দিল। মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলাকে গৃহবন্দি করল, কারাগারে পাঠাল শেখ মুজিবসহ ৩০ জন আইনসভা সদস্য ও দেড় শ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে। স্বাক্ষরিত হলো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান যুক্ত হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেন্টো-সিয়াটোর সঙ্গে। অর্থাৎ পাকিস্তান পুরোপুরি প্রবিষ্ট হয়ে গেল মার্কিন পক্ষপুটে।
ষাটের দশকে যখন পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে তা স্বাধীনতার অভিমুখী হতে থাকে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তখনকার লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলায় তার প্রভাব আরো জোরদার করে তোলা। পকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্রাজ্যবাদের আপত্তি করার তেমন কিছু ছিল না; তার আসল উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো অবস্থায়ই পূর্ব বাংলাকে মার্কিন প্রভুত্বের বৃত্তে আটকে রাখা। পাকিস্তানে সে সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন যোশেফ ফারল্যান্ড। সত্তরের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পাকিস্তানের 'প্রধানমন্ত্রী' পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা জঙ্গি শাসক ইয়াহিয়ার মুখেও শোনা যাচ্ছিল। তখনই যোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎকারেই তিনি বুঝে ফেলেন, অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশটির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, এ অঞ্চলটিতে মার্কিন প্রভুত্বও অক্ষুণ্ন থাকবে না।
এর পরবর্তীকালের মার্কিন ভূমিকার কথা আমাদের সবারই জানা। তবে পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে এবং সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তারা ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। অথচ সেই বাংলাদেশেই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আজ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ ঘটে, তখন কি শুধু মার্কিন রাষ্টদূতের সমালোচনা করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই যে এ দেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের তাণ্ডব ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এই সহজ সত্যটি বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির দরকার পড়ে কি? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা মোকাবিলা করে যে স্বাধীনতা আমরা লাভ করেছিলাম, সেই স্বাধীনতাই কি আমরা রক্ষা করতে পারব সাম্রাজ্যবাদ তোষণ করে?
দেশ থেকে ধর্মতন্ত্রী জঙ্গি মৌলবাদের উচ্ছেদ তো ঘটাতেই হবে। তবে মনে রাখা উচিত : দেশে সর্বাত্মক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রচণ্ড আন্দোলনের সৃষ্টি না করে সে কাজটি কিছুতেই সম্ভব হবে না। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয় থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে এসেই জঙ্গিবাদের হাত থেকে মুক্ত হওয়া ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা দান সম্ভব।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন জানিয়েছে-
"স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবিলা, জাতীয় নিরাপত্তা, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহায়তার কথা তুলে ধরে মজিনা বলেন, 'আমি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছি। আগামীর এশিয়ান টাইগারের জন্ম দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে মার্কিন দূতাবাস কাজ করবে।' তিনি বলেন, 'এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে। বছরে এ সাহায্যের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে'।"
অর্থাৎ আমেরিকা যে আজ বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত তারই নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো ভয়ে শিউরে উঠছি এই ভেবে, তাঁর এই নিশ্চয়তা দান তো আসলে বাংলাদেশের জন্য একান্ত অনিশ্চয়তার বার্তাই বহন করে এনেছে। শুধু অনিশ্চয়তা নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর নিশ্চয়ই নেমে আসছে নগ্নতর হস্তক্ষেপ। 'আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই'- এককালের ভিয়েতনামের এক নেতার এ উক্তিটি আমার বারবারই মনে পড়ছে। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে কোনোরূপ ধানাইপানাই না করে আমাদের প্রকাশ্য শত্রুতা করছিল, তখন আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করছিলাম। কারণ তখন তো স্পষ্টভাবে আমরা জেনে নিয়েছিলাম আমেরিকা আমাদের শত্রু, বন্ধুর ছদ্মবেশ ধরে আমাদের প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করছে না। কিন্তু আজ যখন সেই আমেরিকা আমাদের পাশে থাকার অভয়বাণী প্রদান করছে, তখনই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। 'অ্যামচেম'-এর সভায় মজিনা সাহেব বন্ধুত্বের বার্তা আমাদের কানে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন যেদিন, তার কয়েক দিন যেতে না যেতেই তিনি আমাদের সরকারকে বিশেষ পরামর্শ দিয়ে বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন। সেই পরামর্শটি হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধরত মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে সংলাপে বসার।
বেশ কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রর কাছ থেকে 'মডারেট মুসলিম শক্তি' অভিধা পেয়ে গেছে ধর্মতন্ত্রী জঙ্গি মৌলবাদী সেই গোষ্ঠীটি, যেটি দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়েই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিল। ওরাই ছিল স্বাধীনতার ঘৃণ্য দুশমন রাজাকার, ওরাই তৈরি করেছিল আলবদর-আলশামসের মতো হন্তারক সংগঠন, ওদের হাতেই অপহৃত হয়েছিল আমাদের মাতা-বধূ-কন্যাদের সম্ভ্রম এবং অগণিত মানুষের ধন-প্রাণ। ওরাই আমাদের বিজয়ের পূর্বক্ষণে হত্যা করেছিল দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের। স্বাধীন বাংলাদেশেও ওরা অব্যাহত রেখেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপকর্ম। এই ২০১২ সালে তো ওরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আর ওদের সঙ্গেই কিনা সংলাপে বসার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নির্দেশ। হ্যাঁ, 'নির্দেশ'ই তো বলতে হয়। বর্তমানে এককেন্দ্রিক বিশ্বে নিজেদের যারা বিশ্বেশ্বর ভাবছে, বিশ্বের যেকোনো দেশকে পরামর্শের নামে নির্দেশই দেয় তারা। তাদের নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়টিও কথাবার্তায় ও ভাবভঙ্গিতে তারা জানিয়ে দেয়।
আর তাদের 'সহায়তা'? এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র- যে বাংলাদেশকে বেশি সহায়তা দেয়- এ কথা তো মজিনা সাহেব অ্যামচেমের সভায়ই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকার সহায়তায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কী দশা ঘটেছে ও ঘটছে তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশেও সহায়তাদানের পাশাপাশিই যে মার্কিনি উপদেশ তথা নির্দেশ আসছে, তার পরিণতি কল্পনা করা মোটেই কঠিন নয়।
তবে অনেকটা স্বস্তি পেলাম এ বিষয়ে সরকারি মহলের সচেতনতা প্রত্যক্ষ করে। 'মজিনার কড়া সমালোচনা সংসদে : জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি'- ১৯ নভেম্বর এই সংবাদ শিরোনামটি দেখেই খবরটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। ১৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে সিনিয়র সদস্যরা যা বলেন, তারই সারসংক্ষেপ এ রকম :
'জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার আহ্বানের কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে শক্তিধর দেশটির রাষ্ট্রদূত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টিকারীদের উৎসাহিত করেছেন। সংসদ সদস্যরা মজিনার প্রতি প্রশ্ন করেন, 'আপনার দেশের পুলিশের ওপর যদি তারা (জামায়াত-শিবির) হামলা করত, তাহলে কি আপনারা আক্রমণকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন?'
জাতীয় সংসদ সদস্যরা যে খুব একটা কড়া সমালোচনা করেছেন, তেমন মনে করা যায় না। তবু তাঁরা যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, এ জন্যই তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবু এর পরও বলি : এটুকুই যথেষ্ট নয়; সব ধরনের দোদুল্যমানতা পরিহার করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ না করতে পারলে এ ধরনের অবাঞ্ছিত অবস্থার প্রতিকার কোনো মতেই সম্ভব হবে না। যে প্রশ্ন সংসদ সদস্যরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রতি রেখেছেন, এর জবাবে তিনি কী বলবেন কিংবা আদৌ কিছু বলার গরজ তাঁর আছে কি না আমরা জানি না। তিনি হয়তো মার্কিন সহায়তাপুষ্ট একটি দেশের সংসদ সদস্যদের 'স্পর্ধা'র সমুচিত জবাব দেওয়ার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেই তাঁর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। এ রকম অবহিত করানোর দায়িত্ব দিয়েই তো দেশে দেশে মার্কিন দূতদের পাঠানো হয়ে থাকে।
একাত্তর সালে এবং তারও আগে, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকার কথাটিও এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি। শুধু আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রদূতদেরই নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিযুক্ত করে রেখেছিল এমন অনেক ব্যক্তি ও সংস্থাকে, যাদের নির্দেশও ছিল পাকিস্তান সরকারের জন্য অবশ্য পালনীয়। সে সময়কার এ রকমই একজন ক্ষমতাধর মার্কিন সাংবাদিকের অসাধারণ ক্ষমতার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৫৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকার পাকিস্তানের প্রতিনিধি সেই সাংবাদিকের নাম ছিল কালাহান।
সে বছর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ-বিরোধী যুক্তফ্রন্টের বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করার পর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী (আজাদ পত্রিকার ভাষায় 'উজিরে আলা')। নির্বাচনের কিছুদিন পরই শেরেবাংলা কলকাতায় যান এবং সেখানে তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। তাঁর সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় শেরেবাংলা প্রদত্ত বক্তৃতার একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট রিপোর্ট পাঠান কালাহান। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সেই রিপোর্টটিতে ছাপা হয়েছিল : সংবর্ধনার উত্তরে শেরেবাংলা এমন অনেক কথা বলেন যাতে বোঝা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বেই তাঁর বিশ্বাস নেই। তাঁর মতে, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে শুধু ভৌগোলিক দূরত্বই বিস্তর নয়, দুইয়ের সব কিছুই আলাদা; তাই তিনি এই কৃত্রিম রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে চান, তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চান।
শেরেবাংলা এই রিপোর্টের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, এটিকে তিনি 'মিথ্যার বেসাতি' বলে উল্লেখ করেছিলেন; দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছিলেন, তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিই শুধু করেছেন, স্বাধীনতার কথা বলেননি। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেরেবাংলার প্রতিবাদকে মোটেই আমল দিল না, মার্কিন সাংবাদিক কালাহানের কথাকেই অমোঘ সত্য বলে গ্রহণ করল। পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষকালের মধ্যেই চুয়ান্নর ৩০ মে, তা বাতিল করে দিল। মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলাকে গৃহবন্দি করল, কারাগারে পাঠাল শেখ মুজিবসহ ৩০ জন আইনসভা সদস্য ও দেড় শ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে। স্বাক্ষরিত হলো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান যুক্ত হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেন্টো-সিয়াটোর সঙ্গে। অর্থাৎ পাকিস্তান পুরোপুরি প্রবিষ্ট হয়ে গেল মার্কিন পক্ষপুটে।
ষাটের দশকে যখন পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে তা স্বাধীনতার অভিমুখী হতে থাকে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তখনকার লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলায় তার প্রভাব আরো জোরদার করে তোলা। পকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্রাজ্যবাদের আপত্তি করার তেমন কিছু ছিল না; তার আসল উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো অবস্থায়ই পূর্ব বাংলাকে মার্কিন প্রভুত্বের বৃত্তে আটকে রাখা। পাকিস্তানে সে সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন যোশেফ ফারল্যান্ড। সত্তরের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পাকিস্তানের 'প্রধানমন্ত্রী' পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা জঙ্গি শাসক ইয়াহিয়ার মুখেও শোনা যাচ্ছিল। তখনই যোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎকারেই তিনি বুঝে ফেলেন, অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশটির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, এ অঞ্চলটিতে মার্কিন প্রভুত্বও অক্ষুণ্ন থাকবে না।
এর পরবর্তীকালের মার্কিন ভূমিকার কথা আমাদের সবারই জানা। তবে পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে এবং সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তারা ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। অথচ সেই বাংলাদেশেই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আজ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ ঘটে, তখন কি শুধু মার্কিন রাষ্টদূতের সমালোচনা করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই যে এ দেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের তাণ্ডব ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এই সহজ সত্যটি বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির দরকার পড়ে কি? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা মোকাবিলা করে যে স্বাধীনতা আমরা লাভ করেছিলাম, সেই স্বাধীনতাই কি আমরা রক্ষা করতে পারব সাম্রাজ্যবাদ তোষণ করে?
দেশ থেকে ধর্মতন্ত্রী জঙ্গি মৌলবাদের উচ্ছেদ তো ঘটাতেই হবে। তবে মনে রাখা উচিত : দেশে সর্বাত্মক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রচণ্ড আন্দোলনের সৃষ্টি না করে সে কাজটি কিছুতেই সম্ভব হবে না। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয় থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে এসেই জঙ্গিবাদের হাত থেকে মুক্ত হওয়া ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা দান সম্ভব।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments