আরেকটি অপেক্ষার দিন আক্ষেপে শেষ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৫০ ওভারে ২১১/৯ বাংলাদেশ : ৩৪.১ ওভারে ১৩৬ ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭৫ রানে জয়ী by মোস্তফা মামুন
ড্যারেন সামি আর মুশফিক কনট্রাস্ট হিসেবে দারুণ। উচ্চতার বিরাট পার্থক্যের কারণে ছবিটা প্রায়ই ওঠান ফটোগ্রাফাররা। এবং আগে সেটা সাধারণত হয়ে থাকত দুই দলের শক্তির পার্থক্যেরও প্রতীক। এবার বিষয়টা একটুও সে রকম ছিল না। ওয়ানডে সিরিজে তো অবশ্যই নয়।
কাল আমরা ছাপলাম দুজনের আলাদা ছবি। দুই ফ্রেমে, তাই উচ্চতার পার্থক্য নেই, দুজন একেবারে সমান। প্রিভিউয়ের প্রয়োজনে কালকের ব্যবহৃত সেই ছবিটাই আজ ঘটনা। চার ম্যাচ শেষে দুই দল দাঁড়িয়ে দুই-দুই সমতায়। ঠিক এই সমান জায়গা থেকে আজ শেষ দিনের লড়াই। সুযোগ এখনো হাতছাড়া হয়ে যায়নি, কিন্তু স্বপ্ন থেকে গেল দূর থেকে আরেকটু দূরে। একটু আবছাও দেখাচ্ছে কি! কালকের ম্যাচকেও দুই অধিনায়ক-কেন্দ্রিক ব্যবচ্ছেদ করা যায়। ড্যারেন সামি লাইনচ্যুত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসকে লাইনে ফিরিয়ে আনলেন দক্ষ ট্রেন ড্রাইভারের মতো, ১৬০-৭০ হওয়া নিয়ে যেখানে ছিল সন্দেহ, সেটাই হয়ে গেল ২১১। আর তিনি, মুশফিক, সতীর্থদের ব্যর্থতাকে ব্যাট দিয়ে আড়াল করার চেষ্টায় সফল হয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ। বড় লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন বটে, কিন্তু আউট হওয়াটা ঠিক এই প্রতিজ্ঞার সঙ্গে যায় না। স্টাম্পিং। এমন ইনিংসে স্টাম্পিং মানায় না! যা-ই হোক, এসব কাহিনীতে পরে আসছি। আগে বরং একটু পেছন ফিরে দেখি।
ধরা যাক, এই সিরিজের আগে দুজন ক্রিকেটপ্রেমী সিরিজের সম্ভাব্য ফল নিয়ে আলোচনা করছিল। একজন খুব আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অবিশ্বাস্য স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার বক্তব্য, ওয়ানডে সিরিজ নির্ধারিত হবে শেষ ম্যাচে। দ্বিতীয় জন তর্ক বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত, 'যদি এমন হয় তাহলে তোমাকে স্পেশাল ট্রিট দেব।' কিন্তু কথা দিয়ে থাকলেও এখন দেবে না। কারণ, চার ম্যাচ শেষে ২-২ হয়েছে বটে কিন্তু সেই ২-২ তো আসলে বাংলাদেশ চায়নি। দুই ম্যাচ শুধু আগে জেতা হয়েছে বলেই নয়, পরের দুটো ম্যাচও তো মুঠোয় এসে মুঠো গলে বেরিয়ে গেল। সিরিজ শুরুর আগে যা ছিল চরম সুখময় কল্পনা, তা-ই এখন হয়ে আসছে চরমতম হাহাকারের ছবি হয়ে।
যেকোনো খেলাই ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে। ক্রিকেট লম্বা ম্যাচ, তাই সম্ভাবনাটা থাকে আরো বেশি। আর সে সব বদল কিছু কিছু অনুসিদ্ধান্ত তৈরি করে। কাল যেমন, বাংলাদেশ ইনিংস চলার সময় প্রথম অনুসিদ্ধান্ত হলো এই উইকেটটাতে স্পিনারদের খেলা আসলে সম্ভবই না। পেসারররা বরং এখানে সুবিধাজনক। সেই অনুসিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতে এমন অপমানিত হলো যে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর ম্যাচের গতিপ্রকৃতিকে কোনো সমীকরণে ফেলতে দেখলাম অনেকেই হাবুডুবু খাচ্ছেন। মাত্র ষষ্ঠ ওভারের মধ্যে ১৩ রানে নেই ৫ উইকেট, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনাররা তখনো বল হাতেই নেননি। ম্যাচ শেষ। অতএব স্পিনাররা, স্পিন উইকেট- এসব আলোচনার আর কোনো মানে হয় না। আসলে কোনো ইনিংসে এই ঘটনা ঘটে গেলে এরপর কী হলো না হলো, প্রতিপক্ষ কত করল না করল কিছুই আর ব্যাপার না। ব্যাপার অবশ্য হয়েছে একটা, ৫৮-র মতো কিছু ঘটেনি। মাহমুদ উল্লাহ ও মুশফিক সামাল দিয়েছেন। তবে স্বপ্ন-সম্ভাবনা কিছুই আর তৈরি হয়নি। সে আশা করাও যায় না। ১৩ রানে ৫ জন ফিরে গেলে বাকি যা থাকে সেটা আসলে মৃতদেহ সৎকারের কাজ। শেষকৃত্য সুচারুভাবে সম্পাদনের চেষ্টা।
বিভীষিকাময় উইকেট। বাংলাদেশের সাধারণত টার্নহীন স্পিনাররাই মুরালিধরন-ওয়ার্ন হয়ে যাচ্ছেন! এখানে জেতার দুটো উপায়, প্রথমত নিজেদের পুরোপুরি নিবেদন করে দেখে-শুনে তীরে পৌঁছানো। বল-রানের অঙ্ক নেই যেহেতু, কাজেই সেভাবে ব্যাট করাটা আদর্শ। কিন্তু বাংলাদেশের যে ব্যাটিং ধারাপাতের কথা আমরা জানি তাতে এই সহজ কাজটার চেয়ে কঠিন কিছু হয় না। কাজেই দ্বিতীয় উপায়। সেটা কেউ একজন খুব বিস্ফোরক একটা ইনিংস খেলবেন। ৪০ বলে ৬০-৬৫, টার্গেটটা চলে আসবে হাতের মুঠোয়, বিপক্ষ বোলিং পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যাবে। এবং সেই কেউ একজন হতে পারতেন একজনই। তামিম ইকবাল। শুরুতে অন্য প্রান্তে দুই উইকেট পড়ে যাওয়ায় ভেবে খারাপ লাগল যে এরপর তামিমের পক্ষে ওই ইনিংস খেলা আর সম্ভব হবে না। কারণ সতর্ক থাকতে হবে, স্ট্রোকের থলিতে তালা লাগাতে হবে। তামিম অবশ্য সে রকম কোনো সমস্যায় নিজেকে ফেললেন না। ১ রান করে বাকিদের পথ ধরে ফিরে গেলেন নিজেও, দলের রান ৪ উইকেটে ৩। এর আগে গেছেন এনামুল এবং নাঈম। দুজনের ক্ষেত্রে দুটো টিকা লাগছে। এনামুল দুটো ওয়ানডেতে দারুণ খেলে উজ্জ্বল সম্ভাবনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রয়েসয়ে খেলা ছিল, কিন্তু ফাঁকফোকরও ছিল কিছু। সেই ফাঁকগুলো সময়ে ভরাট হওয়ার কথা। হচ্ছে তো না! আর নাঈম কি টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ দুটোতে একটা করে ইনিংস খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! একটা খেলবেন, কোটা শেষ হয়ে যাবে, এরপর আর কোনো দায়িত্ব নেই। ঠিক যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা শুরুটা করেছেন দারুণ, জায়গায় বল রেখেছেন, মুভমেন্টও ছিল; কিন্তু এটাও ঠিক যে তাঁরা পার্থের উইকেটের ডেল স্টেইন নন। এমন বোলারদের এমন কন্ডিশনে কত খেলেছে বাংলাদেশ! তাহলে? দায় নিতেই হবে। নাসির নতুন বলে সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ, আর এ রকম নতুন অবস্থায় নামার কথাও তো নয়। যেমন মমিনুলেরও কথা নয় এ রকম সময়ে শট খেলে আউট হওয়ার। আসলে শুরুতে গোলমাল হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটা এমন নাড়া খেয়ে যায় যে কিছুই আর ঠিকঠাকমতো চলে না। এর পরও মাহমুদ উল্লাহর মতো কেউ কেউ থাকেন। নিজেকে এসব সময়ে আরো বেশি করে ঢেলে দেন। ৭-৮ নম্বরে ব্যাট করেন, সুযোগ অনেক সীমিত, আবার সেদিনই সুযোগ বেশি আসে যেদিন দল চাপে। চাপের মুখে ভেঙে না পড়ার উদাহরণ হিসেবে তিনি তৈরি করছেন একের পর এক আলোকিত অধ্যায়। ব্যাটটাকে বানাচ্ছেন বাংলাদেশের লজ্জা ঢাকার ঢাল। কাল ওই অবস্থায় নেমেও ৭৮ বলে ৫৬ রানের ধৈর্য আর স্থৈর্যের মিশেল ইনিংস। তাই রক্ষা। লজ্জা বাঁচাতে মুশফিকেরও ভূমিকা আছে। ২৭ রান করে ৭৪ রানের জুটিটিতে মাহমুদ উল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। প্রশংসা পাওনা। কিন্তু আফসোসও থাকে। অধিনায়ক, শুরুটা পেয়ে গেছেন, চাপটা সামলানো হয়ে গেছে, এরপর কি আরো বড় কিছু দল তাঁর কাছে চাইতে পারে না? আর এই দিনে স্টাম্পিংই বা হবেন কেন? স্টাম্পিং ধৈর্য হারানো, উচ্চাভিলাষী ব্যাটিংয়ের প্রতীক। ১৩ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর এমন আউট একজন অধিনায়কের পক্ষে শোভন দেখায় না।
জয়ের কিছু সমস্যাও আছে। বাংলাদেশের মতো আবেগের এবং ক্ষেত্রবিশেষে হুজুগের দেশে সেটা আরো বড়। প্রথম দুই ম্যাচ জেতায় যেমন আমাদের চোখে ধরা পড়েনি বাংলাদেশের ফিল্ডারদের হাত থেকে ক্যাচ পড়ছে। তৃতীয় ম্যাচে হারার পর শেষে খেয়াল হলো, আরে ক্যাচ পড়াতেই তো সমস্যা হচ্ছে। ৯৬ রানে মারলন স্যামুয়েলসের ক্যাচটা ফেলে দেওয়াতেই না...। বিষয়টা খেয়াল হয়েছে কিন্তু শোধরানো যায়নি। কালও ক্যাচ পড়ল। গুনে রাখার মতো পাঁচটি। এর মধ্যে একটি ড্যারেন সামির; সেই সামি, যিনি একার হাতে ম্যাচটা বের করে নিয়ে গেছেন। উইকেট থেকে মাহমুদ উল্লাহ টার্ন পাচ্ছেন মুরালিধরনের মতো, ইলিয়াস সানির বলের বিষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নীল। দেখে কারো কারো মনে হচ্ছে, এটা পঞ্চম দিনের ভারতীয় উইকেট। কেউ বলছেন, ভারতের বিখ্যাত স্পিন চতুষ্টয়ও এই বোলিং দেখে ঈর্ষা করতেন। কেউ একজন রসিকতা করলেন, 'পরের ম্যাচে বাংলাদেশ খেলবে ৯ স্পিনার, ১ উইকেটরক্ষক আর ১ ব্যাটসম্যান নিয়ে। তাতেই হবে!' ইদানীং ভারতীয় মিডিয়া আর মহেন্দ্র সিং ধোনির শিশুতোষ বায়নার কারণে 'র্যাংক টার্নার' বলে একটা শব্দ খুব চালু, সেই উইকেট যেখানে বল প্রথম দিন থেকে ঘোরে। কালকের মিরপুরের উইকেট ঠিক 'র্যাংক টার্নার' নয়, 'সুপার র্যাংক টার্নার', যেখানে প্রথম ওভার থেকেই বল ঘোরে আর ব্যাটসম্যানরা খাবি খায়। মনে হয় ব্যাটিং ক্লাসের প্রথম পাঠের ছাত্র। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে তখন মনে হচ্ছে ব্যাটিং ক্লাসের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র, যাদের মাথায় তখন অনেক প্রশ্ন- যাদের হতবুদ্ধি মাথায় তখন প্রশ্ন বল কেন এত ঘোরে? স্পিন কেমন করে খেলে? কাজেই ৭৯ রানে ৫ উইকেট পড়ে, ১৫৫ রানে হয় ৮, আমরা ধরে নেই এই কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তৈরি হয় গর্বিত হওয়ার মতো নানা তথ্য। ৭৫ বল ধরে কোনো বাউন্ডারি নেই, মাঝব্যাট দিয়ে খেলতে পারছেন না এত ওভার ধরে। সেখানেই সামির গল্প। আর তার পেছনের গল্প ক্যাচ ফেলার। ৩০ রানে ডিপ মিড উইকেটে সোহাগ গাজী তাঁর ক্যাচটা ফেললেন, সামি তাঁর কুফল ফলিয়ে গেলেন বাকি সময়। খেললেন ৬২ বলে ৬০ রানের ইনিংস। শেষ দুই ওভারে এলো ২৬, শেষ ১০ ওভারে ৮১। তাই যে ইনিংস ৪০ ওভার শেষে ছিল ১৩০/৭, সেই ইনিংসটাই হয়ে গেল ২১১। ম্যাচ তখন পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। আর সেটা পাঁচ-পঁচানব্বই হয়ে গেল শুরুর পাঁচ ওভারের মধ্যে। এবং সেখানেও সামি। প্রথম পাঁচজনের তিনজনই তাঁর শিকার।
সামি আর মুশফিকের শারীরিক পার্থক্য আর তাঁর প্রতীকী নানা ব্যবহারের কথা বলছিলাম। এর বাইরেও সামির পরিচয় তৈরি হয়েছে কয়েকটা। খুব হাসেন। হাসতে হাসতে আমাদের কেমন কান্নার জোগাড় করলেন! বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের ক্রিকেটকে খুব ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার মানুষটির হাতেই আরেকবার স্বপ্ন খুন।
ভালোবাসার মানুষের আঘাতে নাকি বেদনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্তিও থাকে কিছু। না, কোনো প্রাপ্তি তো দেখছি না। দেখছি স্বপ্নের রং ফিকে হয়ে যাওয়া। দেখছি আশার ছলনা। আর দেখছি অপেক্ষার বাংলাদেশ বারবার কী করে আক্ষেপের বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে!
ধরা যাক, এই সিরিজের আগে দুজন ক্রিকেটপ্রেমী সিরিজের সম্ভাব্য ফল নিয়ে আলোচনা করছিল। একজন খুব আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অবিশ্বাস্য স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার বক্তব্য, ওয়ানডে সিরিজ নির্ধারিত হবে শেষ ম্যাচে। দ্বিতীয় জন তর্ক বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত, 'যদি এমন হয় তাহলে তোমাকে স্পেশাল ট্রিট দেব।' কিন্তু কথা দিয়ে থাকলেও এখন দেবে না। কারণ, চার ম্যাচ শেষে ২-২ হয়েছে বটে কিন্তু সেই ২-২ তো আসলে বাংলাদেশ চায়নি। দুই ম্যাচ শুধু আগে জেতা হয়েছে বলেই নয়, পরের দুটো ম্যাচও তো মুঠোয় এসে মুঠো গলে বেরিয়ে গেল। সিরিজ শুরুর আগে যা ছিল চরম সুখময় কল্পনা, তা-ই এখন হয়ে আসছে চরমতম হাহাকারের ছবি হয়ে।
যেকোনো খেলাই ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে। ক্রিকেট লম্বা ম্যাচ, তাই সম্ভাবনাটা থাকে আরো বেশি। আর সে সব বদল কিছু কিছু অনুসিদ্ধান্ত তৈরি করে। কাল যেমন, বাংলাদেশ ইনিংস চলার সময় প্রথম অনুসিদ্ধান্ত হলো এই উইকেটটাতে স্পিনারদের খেলা আসলে সম্ভবই না। পেসারররা বরং এখানে সুবিধাজনক। সেই অনুসিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতে এমন অপমানিত হলো যে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর ম্যাচের গতিপ্রকৃতিকে কোনো সমীকরণে ফেলতে দেখলাম অনেকেই হাবুডুবু খাচ্ছেন। মাত্র ষষ্ঠ ওভারের মধ্যে ১৩ রানে নেই ৫ উইকেট, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনাররা তখনো বল হাতেই নেননি। ম্যাচ শেষ। অতএব স্পিনাররা, স্পিন উইকেট- এসব আলোচনার আর কোনো মানে হয় না। আসলে কোনো ইনিংসে এই ঘটনা ঘটে গেলে এরপর কী হলো না হলো, প্রতিপক্ষ কত করল না করল কিছুই আর ব্যাপার না। ব্যাপার অবশ্য হয়েছে একটা, ৫৮-র মতো কিছু ঘটেনি। মাহমুদ উল্লাহ ও মুশফিক সামাল দিয়েছেন। তবে স্বপ্ন-সম্ভাবনা কিছুই আর তৈরি হয়নি। সে আশা করাও যায় না। ১৩ রানে ৫ জন ফিরে গেলে বাকি যা থাকে সেটা আসলে মৃতদেহ সৎকারের কাজ। শেষকৃত্য সুচারুভাবে সম্পাদনের চেষ্টা।
বিভীষিকাময় উইকেট। বাংলাদেশের সাধারণত টার্নহীন স্পিনাররাই মুরালিধরন-ওয়ার্ন হয়ে যাচ্ছেন! এখানে জেতার দুটো উপায়, প্রথমত নিজেদের পুরোপুরি নিবেদন করে দেখে-শুনে তীরে পৌঁছানো। বল-রানের অঙ্ক নেই যেহেতু, কাজেই সেভাবে ব্যাট করাটা আদর্শ। কিন্তু বাংলাদেশের যে ব্যাটিং ধারাপাতের কথা আমরা জানি তাতে এই সহজ কাজটার চেয়ে কঠিন কিছু হয় না। কাজেই দ্বিতীয় উপায়। সেটা কেউ একজন খুব বিস্ফোরক একটা ইনিংস খেলবেন। ৪০ বলে ৬০-৬৫, টার্গেটটা চলে আসবে হাতের মুঠোয়, বিপক্ষ বোলিং পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যাবে। এবং সেই কেউ একজন হতে পারতেন একজনই। তামিম ইকবাল। শুরুতে অন্য প্রান্তে দুই উইকেট পড়ে যাওয়ায় ভেবে খারাপ লাগল যে এরপর তামিমের পক্ষে ওই ইনিংস খেলা আর সম্ভব হবে না। কারণ সতর্ক থাকতে হবে, স্ট্রোকের থলিতে তালা লাগাতে হবে। তামিম অবশ্য সে রকম কোনো সমস্যায় নিজেকে ফেললেন না। ১ রান করে বাকিদের পথ ধরে ফিরে গেলেন নিজেও, দলের রান ৪ উইকেটে ৩। এর আগে গেছেন এনামুল এবং নাঈম। দুজনের ক্ষেত্রে দুটো টিকা লাগছে। এনামুল দুটো ওয়ানডেতে দারুণ খেলে উজ্জ্বল সম্ভাবনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রয়েসয়ে খেলা ছিল, কিন্তু ফাঁকফোকরও ছিল কিছু। সেই ফাঁকগুলো সময়ে ভরাট হওয়ার কথা। হচ্ছে তো না! আর নাঈম কি টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ দুটোতে একটা করে ইনিংস খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! একটা খেলবেন, কোটা শেষ হয়ে যাবে, এরপর আর কোনো দায়িত্ব নেই। ঠিক যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা শুরুটা করেছেন দারুণ, জায়গায় বল রেখেছেন, মুভমেন্টও ছিল; কিন্তু এটাও ঠিক যে তাঁরা পার্থের উইকেটের ডেল স্টেইন নন। এমন বোলারদের এমন কন্ডিশনে কত খেলেছে বাংলাদেশ! তাহলে? দায় নিতেই হবে। নাসির নতুন বলে সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ, আর এ রকম নতুন অবস্থায় নামার কথাও তো নয়। যেমন মমিনুলেরও কথা নয় এ রকম সময়ে শট খেলে আউট হওয়ার। আসলে শুরুতে গোলমাল হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটা এমন নাড়া খেয়ে যায় যে কিছুই আর ঠিকঠাকমতো চলে না। এর পরও মাহমুদ উল্লাহর মতো কেউ কেউ থাকেন। নিজেকে এসব সময়ে আরো বেশি করে ঢেলে দেন। ৭-৮ নম্বরে ব্যাট করেন, সুযোগ অনেক সীমিত, আবার সেদিনই সুযোগ বেশি আসে যেদিন দল চাপে। চাপের মুখে ভেঙে না পড়ার উদাহরণ হিসেবে তিনি তৈরি করছেন একের পর এক আলোকিত অধ্যায়। ব্যাটটাকে বানাচ্ছেন বাংলাদেশের লজ্জা ঢাকার ঢাল। কাল ওই অবস্থায় নেমেও ৭৮ বলে ৫৬ রানের ধৈর্য আর স্থৈর্যের মিশেল ইনিংস। তাই রক্ষা। লজ্জা বাঁচাতে মুশফিকেরও ভূমিকা আছে। ২৭ রান করে ৭৪ রানের জুটিটিতে মাহমুদ উল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। প্রশংসা পাওনা। কিন্তু আফসোসও থাকে। অধিনায়ক, শুরুটা পেয়ে গেছেন, চাপটা সামলানো হয়ে গেছে, এরপর কি আরো বড় কিছু দল তাঁর কাছে চাইতে পারে না? আর এই দিনে স্টাম্পিংই বা হবেন কেন? স্টাম্পিং ধৈর্য হারানো, উচ্চাভিলাষী ব্যাটিংয়ের প্রতীক। ১৩ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর এমন আউট একজন অধিনায়কের পক্ষে শোভন দেখায় না।
জয়ের কিছু সমস্যাও আছে। বাংলাদেশের মতো আবেগের এবং ক্ষেত্রবিশেষে হুজুগের দেশে সেটা আরো বড়। প্রথম দুই ম্যাচ জেতায় যেমন আমাদের চোখে ধরা পড়েনি বাংলাদেশের ফিল্ডারদের হাত থেকে ক্যাচ পড়ছে। তৃতীয় ম্যাচে হারার পর শেষে খেয়াল হলো, আরে ক্যাচ পড়াতেই তো সমস্যা হচ্ছে। ৯৬ রানে মারলন স্যামুয়েলসের ক্যাচটা ফেলে দেওয়াতেই না...। বিষয়টা খেয়াল হয়েছে কিন্তু শোধরানো যায়নি। কালও ক্যাচ পড়ল। গুনে রাখার মতো পাঁচটি। এর মধ্যে একটি ড্যারেন সামির; সেই সামি, যিনি একার হাতে ম্যাচটা বের করে নিয়ে গেছেন। উইকেট থেকে মাহমুদ উল্লাহ টার্ন পাচ্ছেন মুরালিধরনের মতো, ইলিয়াস সানির বলের বিষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নীল। দেখে কারো কারো মনে হচ্ছে, এটা পঞ্চম দিনের ভারতীয় উইকেট। কেউ বলছেন, ভারতের বিখ্যাত স্পিন চতুষ্টয়ও এই বোলিং দেখে ঈর্ষা করতেন। কেউ একজন রসিকতা করলেন, 'পরের ম্যাচে বাংলাদেশ খেলবে ৯ স্পিনার, ১ উইকেটরক্ষক আর ১ ব্যাটসম্যান নিয়ে। তাতেই হবে!' ইদানীং ভারতীয় মিডিয়া আর মহেন্দ্র সিং ধোনির শিশুতোষ বায়নার কারণে 'র্যাংক টার্নার' বলে একটা শব্দ খুব চালু, সেই উইকেট যেখানে বল প্রথম দিন থেকে ঘোরে। কালকের মিরপুরের উইকেট ঠিক 'র্যাংক টার্নার' নয়, 'সুপার র্যাংক টার্নার', যেখানে প্রথম ওভার থেকেই বল ঘোরে আর ব্যাটসম্যানরা খাবি খায়। মনে হয় ব্যাটিং ক্লাসের প্রথম পাঠের ছাত্র। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে তখন মনে হচ্ছে ব্যাটিং ক্লাসের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র, যাদের মাথায় তখন অনেক প্রশ্ন- যাদের হতবুদ্ধি মাথায় তখন প্রশ্ন বল কেন এত ঘোরে? স্পিন কেমন করে খেলে? কাজেই ৭৯ রানে ৫ উইকেট পড়ে, ১৫৫ রানে হয় ৮, আমরা ধরে নেই এই কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তৈরি হয় গর্বিত হওয়ার মতো নানা তথ্য। ৭৫ বল ধরে কোনো বাউন্ডারি নেই, মাঝব্যাট দিয়ে খেলতে পারছেন না এত ওভার ধরে। সেখানেই সামির গল্প। আর তার পেছনের গল্প ক্যাচ ফেলার। ৩০ রানে ডিপ মিড উইকেটে সোহাগ গাজী তাঁর ক্যাচটা ফেললেন, সামি তাঁর কুফল ফলিয়ে গেলেন বাকি সময়। খেললেন ৬২ বলে ৬০ রানের ইনিংস। শেষ দুই ওভারে এলো ২৬, শেষ ১০ ওভারে ৮১। তাই যে ইনিংস ৪০ ওভার শেষে ছিল ১৩০/৭, সেই ইনিংসটাই হয়ে গেল ২১১। ম্যাচ তখন পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। আর সেটা পাঁচ-পঁচানব্বই হয়ে গেল শুরুর পাঁচ ওভারের মধ্যে। এবং সেখানেও সামি। প্রথম পাঁচজনের তিনজনই তাঁর শিকার।
সামি আর মুশফিকের শারীরিক পার্থক্য আর তাঁর প্রতীকী নানা ব্যবহারের কথা বলছিলাম। এর বাইরেও সামির পরিচয় তৈরি হয়েছে কয়েকটা। খুব হাসেন। হাসতে হাসতে আমাদের কেমন কান্নার জোগাড় করলেন! বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের ক্রিকেটকে খুব ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার মানুষটির হাতেই আরেকবার স্বপ্ন খুন।
ভালোবাসার মানুষের আঘাতে নাকি বেদনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্তিও থাকে কিছু। না, কোনো প্রাপ্তি তো দেখছি না। দেখছি স্বপ্নের রং ফিকে হয়ে যাওয়া। দেখছি আশার ছলনা। আর দেখছি অপেক্ষার বাংলাদেশ বারবার কী করে আক্ষেপের বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে!
No comments