সময়ের কথা-তবুও ভরসা জোগায় বাংলাদেশের কৃষি by অজয় দাশগুপ্ত
এবারে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের কারণে কিন্তু বলতে পারি যে, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সতর্কবার্তার পরও খাদ্যশস্য বিশেষ করে চাল নিয়ে বাংলাদেশের খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
কারণ আমাদের চালের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান আসবে দেশের কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান থেকে। এখন সরকারের জন্য অবশ্যকরণীয় হচ্ছে : অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন কৃষক-ক্ষেতমজুরদের কৃতিত্বকে নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাজারে অতিমাত্রায় কর্তৃত্ব স্থাপন
করতে না পারে
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে খুব বড় ধরনের বন্যা হয়। দেশের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছিল ব্যাপক। বিবিসি টেলিভিশনের এক সাংবাদিক তো এত পানি দেখে দারুণ ভয় পেয়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন, 'ক্ষেতের ফসল এবং অন্য সহায়সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে অন্তত দুই কোটি লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।' ওই সময়ে মাঠে মাঠে ছিল আমন ধানের চারা। বন্যার কারণে তার যথেষ্ট ক্ষতি হয়। তারপরও ফসল ঘরে তোলে কৃষকরা। বন্যায় মৃত্যু হয়েছিল হাতেগোনা কয়েকজনের। আর দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও দূর করা গিয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ছিলেন এসএএমএস কিবরিয়া এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তারা কৃষকদের নানাভাবে সহায়তা প্রদানের জন্য অনেক কিছু করেন। কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ব্যাংকগুলোতে নির্দেশ যায় : 'ঋণের আবেদন করার দুই দিনের মধ্যে ঋণ প্রদান করা না হলে শাস্তি দেওয়া হবে।' কৃষকদের বীজ-সার কেনায় কিছু টাকা অনুদান হিসেবেও দেওয়া হয়। আমি সে সময় একটি রিলিফ দলের সঙ্গে গিয়েছিলাম রাজধানী ঢাকার পাশের একটি গ্রামে। সরকারের তরফে তখন কৃষকদের লাউ-কুমড়া-শিমসহ কয়েক ধরনের সবজির বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছিল। শেখ হাসিনা বিভিন্ন এলাকায় রিলিফ দিতে গিয়ে সবজি বীজও দিচ্ছিলেন। আমাকে এক বৃদ্ধ বলেন, বীজ থেকে চারা গজাতে সময় লাগে। আমাদের বাড়ির চারপাশ এবং উঠান পর্যন্ত তলানো। বীজ দিয়ে কী করব? সরকার যদি চারা করে দেয়, ভালো হয়। এ নিয়ে একটি রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করি এবং কয়েকদিন পর দেখতে পাই যে, সরকার বীজ ও চারা দুটিই বিনামূল্যে বিতরণ করছে।
বন্যার পর বোরো ধানের মৌসুম আসে। আগের বড় বড় বন্যার পর দেখা গেছে, কৃষকরা বোরোর ওপর খুব জোর দেয়। ১৯৯৮ সালেও ব্যতিক্রম হয়নি। মে ও জুন মাসে বোরো ধান কাটা হয় এবং সবাই বলাবলি করতে থাকে, বাম্পার ফলন হয়েছে। মোটামুটি একটি হিসাব করা হয়, এক কোটি টনের মতো চাল বোরো ধান থেকে পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী, কৃষি ও অর্থমন্ত্রীও তাদের বিভিন্ন বক্তৃতায় এ সাফল্য তুলে ধরতে থাকেন। এ সময় রাজধানীর একটি বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ছিলেন ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকের এক বড় কর্মকর্তা। তার অনেক বেতন এবং অনেক সুবিধা। সেই অনুষ্ঠানে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বোরো মৌসুমে এক কোটি টন চাল পাওয়া যাবে বলে বক্তব্য রাখলে বিশ্বব্যাংকের ওই কর্মকর্তা কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে ওঠেন :'রিডিকুলাস'। এর অর্থ করা যায় 'অবিশ্বাস্য' কিংবা 'হাস্যকর'। পরে তিনি নিজের বক্তৃতাতেও এক কোটি টন চাল উৎপাদনের সরকারি দাবি বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেন। সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকা বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যই সঠিক বলে মনে করে। বিশ্বব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে পরে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছিল। তাদের যুক্তি : বোরো মৌসুমে এত বিপুল পরিমাণ চাল উৎপাদন সম্ভব নয়। অথচ মাত্র এক যুগ যেতে না যেতেই বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন এক কোটি টনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এবারে বোরো, আউশ ও আমন ধান এবং গমের উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এক কোটি দশ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল। তার সঙ্গে তুলনায় গেলে এ অনেক বড় অর্জন। কিন্তু যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে হিসাব করি তাহলে আমাদের মাথায় হাত পড়বে। আমাদের দেশে জমির পরিমাণ কম। প্রতি বছর ঘরবাড়ি, সড়ক, কলকারখানা এবং অন্যান্য অবকাঠামো বানাতে অনেক জমি ব্যবহার হয়। ফলে চাষের জমি কমছে। তারপরও আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে জমিতে ফসল বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে মানুষ। ধানের ফলন বাড়াতে পারছি, কিন্তু মানুষের সংখ্যাও যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে যে উন্নতি ঘটেছে তা দেখে অনেকেরই এখন এক ধরনের খেদ_ আমাদের লোকসংখ্যা যদি ১০-১২ কোটিতে সীমিত রাখা যেত!
বিশ্বে খাদ্য সংকট চলছে। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : বড় ধরনের সংকটের কাছাকাছি পেঁৗছে গেছি আমরা। খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে দরিদ্র দেশগুলোর একটি জেনারেশন হারিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। এক সময় ধনী পরিবারগুলো মনে করত, আটা হচ্ছে গরিবদের খাদ্য। আর গরিবরা মনে করত, আটার রুটি খেলে শরীরে বল পাওয়া যায় না। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। অনেক পরিবারে প্রতিদিন রুটি খাওয়া হয়। তাছাড়া বিস্কুট-পাউরুটিসহ অনেক ধরনের উপাদেয় খাদ্য তৈরি করতে চাই আটা। ময়দা-সুজির চাহিদাও বাড়ছে ক্রমাগত। এ জন্য ৪০ লাখ টন গমের চাহিদার মাত্র ১০-১২ লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে : ২০১০ সালের প্রথম দিকের তুলনায় ২০১১ সালের প্রথম দিকে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব পড়বে, এ তো জানা কথা। তবে এই সময়ে চালের দাম মোটামুটি একই রয়েছে। কিন্তু আমাদের ভরসার জায়গা তো কৃষকরা। এখন দেশের বাজারে চাল রয়েছে প্রচুর। বোরো উঠলে বাজারে ঘাটতি থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুটি : এক. যারা চাল কিনে খায় তারা কৃষকের দিকটা দেখতে কম আগ্রহী থাকে না। সরকারও চায় যে বাজারে চালের দাম কম থাকুক। এতে কৃষকের যে ক্ষতি হতে পারে কিংবা লাভের অঙ্ক কম হয় সেটা তারা হিসাবে নিতে চায় না। দুই. বাজারে এমন কিছু লোকের কর্তৃত্ব থাকে যাদের অসাধু বলে আখ্যায়িত করা হয়। এদের দমনে সরকার ব্যর্থ হয় দুটি কারণে : এক. বড় বড় দলে ব্যবসায়ীদের প্রচুর আধিপত্য ও খবরদারি। শহর ও গ্রাম সর্বত্রই এটা দেখা যায়। মুনাফার ওপর হাত পড়ে এমন কিছু সরকার করতে গেলেই তারা হৈচৈ করে ওঠে। দুই. মুক্তবাজার অর্থনীতি মেনে নিলে সরকার বাজারের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ যা-ই হোক, বাজার অস্থির হলে সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ বাড়ে। তারা বিশ্ববাজার বুঝতে চায় না। সরকারে যারা থাকে তারা যুক্তি দেয়, অন্যান্য দেশে সয়াবিন তেল, চাল, ডাল, চিনি এবং এ ধরনের অনেক জিনিসের দাম বাড়ছে। দেশের বাজারে তাই বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু যখন সিন্ডিকেট করে বা জোট বেঁধে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, সেটাও জনগণ বুঝতে পারে। তাই বিশ্ববাজারের ওপর দায় চাপানোর সরকারের যুক্তি তারা ঠিক মেনে নিতে পারে না।
এবারে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের কারণে কিন্তু বলতে পারি যে, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সতর্কবার্তার পরও খাদ্যশস্য বিশেষ করে চাল নিয়ে বাংলাদেশের খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ আমাদের চালের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান আসবে দেশের কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান থেকে। এখন সরকারের জন্য অবশ্যকরণীয় হচ্ছে : অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন কৃষক-ক্ষেতমজুরদের কৃতিত্বকে নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাজারে অতিমাত্রায় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারে। অতিমাত্রায় শব্দ এ কারণেই ব্যবহার করলাম যে, ব্যবসায়ীরা কিছু মুনাফা করবেই। এতে দোষের কিছু নেই। কৃষি কিংবা শিল্প যেখানেই উৎপাদন হোক তা বাজারে বিক্রি করে আরেক দল লোক, যাদের ব্যবসায়ী বলা হয়। তাদের না হলে অর্থনীতি চলে না। তাদের নানা ধরনের উৎসাহ দিতে হয় এবং সেটা সরকারের কাজ।
আমাদের কৃষির এই সম্ভাবনা আরও কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা শুধু সরকারকে নয়, কৃষির সঙ্গে যুক্ত অন্যদেরও ভাবতে হবে। বোরো ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকায় বাজারে চালের জোগান বেড়েছে। বিশ্ববাজারের অস্থিরতার মুখেও এ কারণে আমরা কিছুটা নিশ্চিত থাকতে পারছি। তবে বোরো ধান চাষে প্রচুর পানি দরকার হয় এবং তাতে মাটির নিচে পানির স্তরে সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাছাড়া সেচের জন্য দরকার হয় প্রচুর ডিজেল ও বিদ্যুৎ। সর্বোপরি রয়েছে রাসায়নিক সার। এর দাম প্রচুর এবং দেশে উৎপাদনে ব্যবহার করতে হয় মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস। এর পরিবর্তে আমন মৌসুমে ধানের ফলন বাড়ানোর ওপর আমাদের জোর দেওয়া উচিত। আমন মৌসুমের মূল সমস্যা হচ্ছে বন্যা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কয়েক ধরনের ধানবীজ উদ্ভাবন করেছে যাতে বন্যা হলেও ধানের চারার ক্ষতি কম হয়। বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকায় লবণাক্ততা সহ্য করেও ফলন দেয় এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসবই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এ ধরনের আরও বৈজ্ঞানিক সাফল্য আমাদের দরকার। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এসবের প্রয়োগ। বাংলাদেশের কৃষকরা ভালো কিছু পেলে তা সহজেই লুফে নেয়। খাদ্যের জোগান বাড়াতে তারা ধানের চাষ বাড়িয়েছে। তবে খাদ্য তালিকায় কেবল ভাত হলে চলে না। সুষম খাদ্যের জন্য চাই নানা ধরনের সবজি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলসহ অনেক কিছু। এসবের উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রেও চাই কৃষকদের সহায়তা। সরকারকে এ জন্য অর্থের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোকে কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য খাতে ঋণ দিতে হবে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতেই বেশি আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ক্রমাগত চাপে তারা কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও এসব প্রাইভেট ও বিদেশি ব্যাংকের ঋণের সিংহভাগ দেওয়া হয় শিল্প স্থাপন ও ব্যবসা খাতে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে কৃষি থেকে আমরা আরও সুফল পেতে পারব।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের মুখেও বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ নেই। এর পেছনে যে শক্তি কাজ করছে আমরা কি তার যথাযথ পরিচর্যা করব না? কথায় বলে, সাধের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দিতে নেই। আমাদের কৃষি খাত হচ্ছে এমনই এক সম্পদ। তার প্রতি অবহেলা করা হলে কিন্তু প্রকৃতির এমন প্রতিশোধ নেমে আসতে পারে যা সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
করতে না পারে
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে খুব বড় ধরনের বন্যা হয়। দেশের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছিল ব্যাপক। বিবিসি টেলিভিশনের এক সাংবাদিক তো এত পানি দেখে দারুণ ভয় পেয়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন, 'ক্ষেতের ফসল এবং অন্য সহায়সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে অন্তত দুই কোটি লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।' ওই সময়ে মাঠে মাঠে ছিল আমন ধানের চারা। বন্যার কারণে তার যথেষ্ট ক্ষতি হয়। তারপরও ফসল ঘরে তোলে কৃষকরা। বন্যায় মৃত্যু হয়েছিল হাতেগোনা কয়েকজনের। আর দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও দূর করা গিয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ছিলেন এসএএমএস কিবরিয়া এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তারা কৃষকদের নানাভাবে সহায়তা প্রদানের জন্য অনেক কিছু করেন। কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ব্যাংকগুলোতে নির্দেশ যায় : 'ঋণের আবেদন করার দুই দিনের মধ্যে ঋণ প্রদান করা না হলে শাস্তি দেওয়া হবে।' কৃষকদের বীজ-সার কেনায় কিছু টাকা অনুদান হিসেবেও দেওয়া হয়। আমি সে সময় একটি রিলিফ দলের সঙ্গে গিয়েছিলাম রাজধানী ঢাকার পাশের একটি গ্রামে। সরকারের তরফে তখন কৃষকদের লাউ-কুমড়া-শিমসহ কয়েক ধরনের সবজির বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছিল। শেখ হাসিনা বিভিন্ন এলাকায় রিলিফ দিতে গিয়ে সবজি বীজও দিচ্ছিলেন। আমাকে এক বৃদ্ধ বলেন, বীজ থেকে চারা গজাতে সময় লাগে। আমাদের বাড়ির চারপাশ এবং উঠান পর্যন্ত তলানো। বীজ দিয়ে কী করব? সরকার যদি চারা করে দেয়, ভালো হয়। এ নিয়ে একটি রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করি এবং কয়েকদিন পর দেখতে পাই যে, সরকার বীজ ও চারা দুটিই বিনামূল্যে বিতরণ করছে।
বন্যার পর বোরো ধানের মৌসুম আসে। আগের বড় বড় বন্যার পর দেখা গেছে, কৃষকরা বোরোর ওপর খুব জোর দেয়। ১৯৯৮ সালেও ব্যতিক্রম হয়নি। মে ও জুন মাসে বোরো ধান কাটা হয় এবং সবাই বলাবলি করতে থাকে, বাম্পার ফলন হয়েছে। মোটামুটি একটি হিসাব করা হয়, এক কোটি টনের মতো চাল বোরো ধান থেকে পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী, কৃষি ও অর্থমন্ত্রীও তাদের বিভিন্ন বক্তৃতায় এ সাফল্য তুলে ধরতে থাকেন। এ সময় রাজধানীর একটি বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ছিলেন ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকের এক বড় কর্মকর্তা। তার অনেক বেতন এবং অনেক সুবিধা। সেই অনুষ্ঠানে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বোরো মৌসুমে এক কোটি টন চাল পাওয়া যাবে বলে বক্তব্য রাখলে বিশ্বব্যাংকের ওই কর্মকর্তা কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে ওঠেন :'রিডিকুলাস'। এর অর্থ করা যায় 'অবিশ্বাস্য' কিংবা 'হাস্যকর'। পরে তিনি নিজের বক্তৃতাতেও এক কোটি টন চাল উৎপাদনের সরকারি দাবি বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেন। সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকা বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যই সঠিক বলে মনে করে। বিশ্বব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে পরে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছিল। তাদের যুক্তি : বোরো মৌসুমে এত বিপুল পরিমাণ চাল উৎপাদন সম্ভব নয়। অথচ মাত্র এক যুগ যেতে না যেতেই বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন এক কোটি টনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এবারে বোরো, আউশ ও আমন ধান এবং গমের উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এক কোটি দশ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল। তার সঙ্গে তুলনায় গেলে এ অনেক বড় অর্জন। কিন্তু যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে হিসাব করি তাহলে আমাদের মাথায় হাত পড়বে। আমাদের দেশে জমির পরিমাণ কম। প্রতি বছর ঘরবাড়ি, সড়ক, কলকারখানা এবং অন্যান্য অবকাঠামো বানাতে অনেক জমি ব্যবহার হয়। ফলে চাষের জমি কমছে। তারপরও আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে জমিতে ফসল বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে মানুষ। ধানের ফলন বাড়াতে পারছি, কিন্তু মানুষের সংখ্যাও যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে যে উন্নতি ঘটেছে তা দেখে অনেকেরই এখন এক ধরনের খেদ_ আমাদের লোকসংখ্যা যদি ১০-১২ কোটিতে সীমিত রাখা যেত!
বিশ্বে খাদ্য সংকট চলছে। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : বড় ধরনের সংকটের কাছাকাছি পেঁৗছে গেছি আমরা। খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে দরিদ্র দেশগুলোর একটি জেনারেশন হারিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। এক সময় ধনী পরিবারগুলো মনে করত, আটা হচ্ছে গরিবদের খাদ্য। আর গরিবরা মনে করত, আটার রুটি খেলে শরীরে বল পাওয়া যায় না। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। অনেক পরিবারে প্রতিদিন রুটি খাওয়া হয়। তাছাড়া বিস্কুট-পাউরুটিসহ অনেক ধরনের উপাদেয় খাদ্য তৈরি করতে চাই আটা। ময়দা-সুজির চাহিদাও বাড়ছে ক্রমাগত। এ জন্য ৪০ লাখ টন গমের চাহিদার মাত্র ১০-১২ লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে : ২০১০ সালের প্রথম দিকের তুলনায় ২০১১ সালের প্রথম দিকে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব পড়বে, এ তো জানা কথা। তবে এই সময়ে চালের দাম মোটামুটি একই রয়েছে। কিন্তু আমাদের ভরসার জায়গা তো কৃষকরা। এখন দেশের বাজারে চাল রয়েছে প্রচুর। বোরো উঠলে বাজারে ঘাটতি থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুটি : এক. যারা চাল কিনে খায় তারা কৃষকের দিকটা দেখতে কম আগ্রহী থাকে না। সরকারও চায় যে বাজারে চালের দাম কম থাকুক। এতে কৃষকের যে ক্ষতি হতে পারে কিংবা লাভের অঙ্ক কম হয় সেটা তারা হিসাবে নিতে চায় না। দুই. বাজারে এমন কিছু লোকের কর্তৃত্ব থাকে যাদের অসাধু বলে আখ্যায়িত করা হয়। এদের দমনে সরকার ব্যর্থ হয় দুটি কারণে : এক. বড় বড় দলে ব্যবসায়ীদের প্রচুর আধিপত্য ও খবরদারি। শহর ও গ্রাম সর্বত্রই এটা দেখা যায়। মুনাফার ওপর হাত পড়ে এমন কিছু সরকার করতে গেলেই তারা হৈচৈ করে ওঠে। দুই. মুক্তবাজার অর্থনীতি মেনে নিলে সরকার বাজারের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ যা-ই হোক, বাজার অস্থির হলে সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ বাড়ে। তারা বিশ্ববাজার বুঝতে চায় না। সরকারে যারা থাকে তারা যুক্তি দেয়, অন্যান্য দেশে সয়াবিন তেল, চাল, ডাল, চিনি এবং এ ধরনের অনেক জিনিসের দাম বাড়ছে। দেশের বাজারে তাই বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু যখন সিন্ডিকেট করে বা জোট বেঁধে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, সেটাও জনগণ বুঝতে পারে। তাই বিশ্ববাজারের ওপর দায় চাপানোর সরকারের যুক্তি তারা ঠিক মেনে নিতে পারে না।
এবারে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের কারণে কিন্তু বলতে পারি যে, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সতর্কবার্তার পরও খাদ্যশস্য বিশেষ করে চাল নিয়ে বাংলাদেশের খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ আমাদের চালের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান আসবে দেশের কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান থেকে। এখন সরকারের জন্য অবশ্যকরণীয় হচ্ছে : অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন কৃষক-ক্ষেতমজুরদের কৃতিত্বকে নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাজারে অতিমাত্রায় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারে। অতিমাত্রায় শব্দ এ কারণেই ব্যবহার করলাম যে, ব্যবসায়ীরা কিছু মুনাফা করবেই। এতে দোষের কিছু নেই। কৃষি কিংবা শিল্প যেখানেই উৎপাদন হোক তা বাজারে বিক্রি করে আরেক দল লোক, যাদের ব্যবসায়ী বলা হয়। তাদের না হলে অর্থনীতি চলে না। তাদের নানা ধরনের উৎসাহ দিতে হয় এবং সেটা সরকারের কাজ।
আমাদের কৃষির এই সম্ভাবনা আরও কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা শুধু সরকারকে নয়, কৃষির সঙ্গে যুক্ত অন্যদেরও ভাবতে হবে। বোরো ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকায় বাজারে চালের জোগান বেড়েছে। বিশ্ববাজারের অস্থিরতার মুখেও এ কারণে আমরা কিছুটা নিশ্চিত থাকতে পারছি। তবে বোরো ধান চাষে প্রচুর পানি দরকার হয় এবং তাতে মাটির নিচে পানির স্তরে সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাছাড়া সেচের জন্য দরকার হয় প্রচুর ডিজেল ও বিদ্যুৎ। সর্বোপরি রয়েছে রাসায়নিক সার। এর দাম প্রচুর এবং দেশে উৎপাদনে ব্যবহার করতে হয় মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস। এর পরিবর্তে আমন মৌসুমে ধানের ফলন বাড়ানোর ওপর আমাদের জোর দেওয়া উচিত। আমন মৌসুমের মূল সমস্যা হচ্ছে বন্যা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কয়েক ধরনের ধানবীজ উদ্ভাবন করেছে যাতে বন্যা হলেও ধানের চারার ক্ষতি কম হয়। বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকায় লবণাক্ততা সহ্য করেও ফলন দেয় এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসবই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এ ধরনের আরও বৈজ্ঞানিক সাফল্য আমাদের দরকার। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এসবের প্রয়োগ। বাংলাদেশের কৃষকরা ভালো কিছু পেলে তা সহজেই লুফে নেয়। খাদ্যের জোগান বাড়াতে তারা ধানের চাষ বাড়িয়েছে। তবে খাদ্য তালিকায় কেবল ভাত হলে চলে না। সুষম খাদ্যের জন্য চাই নানা ধরনের সবজি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলসহ অনেক কিছু। এসবের উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রেও চাই কৃষকদের সহায়তা। সরকারকে এ জন্য অর্থের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোকে কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য খাতে ঋণ দিতে হবে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতেই বেশি আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ক্রমাগত চাপে তারা কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও এসব প্রাইভেট ও বিদেশি ব্যাংকের ঋণের সিংহভাগ দেওয়া হয় শিল্প স্থাপন ও ব্যবসা খাতে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে কৃষি থেকে আমরা আরও সুফল পেতে পারব।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের মুখেও বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ নেই। এর পেছনে যে শক্তি কাজ করছে আমরা কি তার যথাযথ পরিচর্যা করব না? কথায় বলে, সাধের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দিতে নেই। আমাদের কৃষি খাত হচ্ছে এমনই এক সম্পদ। তার প্রতি অবহেলা করা হলে কিন্তু প্রকৃতির এমন প্রতিশোধ নেমে আসতে পারে যা সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments