সদরে অন্দরে-একজন আলফাজউদ্দিন স্যার বনাম কোচিং বাণিজ্য by মোস্তফা হোসেইন

কুয়াশা ঠেলে বাড়ির উঠোনে উঁকি দিয়েছে শীতে ভেজা রোদ। ঘরের সামনে পাতা জলচৌকিতে বসা জনাচারেক শিশু। সামনে কাঠের বেঞ্চিতে খোলা বই। হুঁকো টানতে টানতে আলফাজউদ্দিন খান স্যার বসেন প্রায় ভাঙা একটি চেয়ারে। চশমার ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নেন ছাত্রদের খাতায়।
এক এক করে বলতে থাকেন, এভাবে নয়, ওভাবে করো অঙ্কটা। এই বানানটা ওভাবে হবে রে, ঠিক করে নে এখনই। এমনি করেই প্রতিদিন স্কুলের পাঠ্যসূচি শেষ করিয়ে দিতেন আলফাজউদ্দিন স্যার।
ক্লাসের পড়াগুলো শেষ করে নিতে নিতে সূর্য ওঠে আমগাছের ওপর। ১১টায় পৌঁছাতে হবে ক্লাসে। তাই বাড়ি ফেরার পালা। মাঝেমধ্যে স্যারের ক্ষেতের সরিষার তেলে ভাজা মুড়িও জোটে আসার সময়। খেতে খেতে বাড়ি আসা। অতঃপর ভালো ছাত্র হয়ে স্কুলে যাওয়া।
শৈশবের প্রাইভেট পড়ার চিত্র মনে আসে হালের কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে। অর্ধশত বছর আগে মাসিক দু-তিন টাকা প্রাইভেট শিক্ষকের বেতন দিলেও বাণিজ্য মনে হয়নি মোটেও। কিন্তু হালের অবস্থাটা কী? রাজধানীর একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র তুলে ধরা যাক। ছেলে এসে বলে, 'ক' স্যার ক্লাসে এসে বলেছেন তাঁর কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে। একবার, দুইবার, তিনবার নির্দেশ অমান্য করার পর ছেলের মনে সন্দেহ জাগে। মায়ের কাছে আবদার জানায়, স্যার নিশ্চিত ফেল করিয়ে ছাড়বে সামনের পরীক্ষায়।
মায়ের কথা, পরীক্ষার খাতা তো প্রভাতি শাখার কোনো শিক্ষকই দেখবেন না তোমাদের। তাহলে এত ভয় কেন? তারও দুই দিন পর ছেলের কথা- দিবা শাখার স্যারদের সঙ্গে প্রভাতি শাখার স্যারদের সমঝোতা আছে এ বিষয়ে। বিপদ হবে কোচিংয়ে ভর্তি না হলে।
অতঃপর বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে যায় মা কোচিং সেন্টারে। স্কুলের পাশেই বাড়ি ভাড়া করে কোচিং সেন্টার চালান 'ক' স্যার। গাদাগাদি করে বসে আছে ত্রিশের বেশি শিক্ষার্থী। স্কুলের মতোই ব্ল্যাকবোর্ড-বেঞ্চি সবই আছে।
পরীক্ষার আগে 'ক' স্যার সব বিষয়েই সাজেশন দেন। প্রায় ৮০ শতাংশ প্রশ্ন কমন পড়ে ছেলের। কী হচ্ছে ওখানে? বোধ করি কোচিংয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আর খুলে বলার দরকার নেই। শুধু এটুকুই বলা যায়, রাজধানীর অনেক স্কুলের শিক্ষক এখন কোটি টাকা দামের অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। গাড়ি চালান এমন শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। ২৫-৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে মাসিক ২৫ হাজার টাকা ভাড়ার বাসায় থাকেন এমন শিক্ষক তো বহু। একজন শিক্ষককে সারা জীবন আলফাজউদ্দিন স্যারদের মতো ছনের ঘরে কাটাতে হবে এটা যৌক্তিক নয়। কিন্তু বৈধ পথে রোজগার করে টাকার মালিক হলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কথিত এই শিক্ষকগণ শিক্ষাকে যখন পণ্য বানিয়ে নিতে চান তখনই বুঝতে হয়, গ্রামের সেই আলফাজউদ্দিন স্যারের উঠোনে বসিয়ে পড়ার সঙ্গে কতটা পার্থক্য আছে এই পড়ানোর মধ্যে।
'ক' স্যারের প্রসঙ্গই আবার আনতে চাই। সরকারি নীতিমালার ১৩ ধারার ঙ অনুযায়ী তিনি 'সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫'-এর অধীনে অসদাচরণ করছেন বলে স্পষ্টত গণ্য, যার সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু 'ক' স্যার গত ২০ জুন এই নীতিমালার নির্দেশ জারির পর ছয় মাস ধরে কোচিং চালিয়ে অর্থাৎ চাকরিচ্যুতির মতো অসদাচরণ করে এলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। আর এ কাজটি যে শুধু 'ক' স্যারই করছেন তা কিন্তু নয়। তাঁর মতো অসংখ্য শিক্ষক দেশের আনাচে-কানাচে এহেন কাজ করে চলেছেন।
শহরের অলিগলিতে মুদি দোকানের মতোই রয়েছে এসব কোচিং সেন্টার। শিক্ষা বাণিজ্যে লিপ্ত শিক্ষকদের সর্বনাশা কাণ্ড নিয়ে সোচ্চার সচেতন সমাজ। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের শুরুটা আমাদের নতুন করে বিশ্লেষণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। সুযোগটা এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২-এর কারণে। সেই সুবাদে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ১৬ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গৃৃহীত ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সেখানকার ১৬ কোচিংবাজ শিক্ষকের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশ্যই এই পদক্ষেপ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তার পরও কথা থেকে যায়, প্রায় অর্ধসহস্র শিক্ষকের মধ্যে এই ১৬ জনই কি কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত? ওই স্কুলেরই একজন শিক্ষক সহমত পোষণ করলেন। এখনো অনেকেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আংশিক কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট যদি এই ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তার পরও বলতে হবে, সরকারের গৃহীত নীতিমালার ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী শাস্তি প্রদান শুরু হয়েছে এখন থেকে। হাজার হাজার শিক্ষক যেখানে এই কাজে জড়িত, সেখানে মাত্র ১৬ জন শাস্তি পেলেন- তাও ছয় মাসে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে এই সরকারের কত বছর লেগে যেতে পারে।
সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের পর কোচিং বাণিজ্যে নিয়োজিত শিক্ষকরা ভিন্নপথে এখন কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সেদিকেও নজর দিতে হবে। তাঁদের কোচিং সেন্টারগুলো ইদানীং রাতারাতি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বদলে যেতে শুরু করেছে। কিছু আবার ইতিমধ্যে স্কুলের সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দিয়েছে। শিক্ষকের স্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়কে কাগজে-কলমে ওই শিক্ষায়তনের প্রধান বানিয়ে দিব্যি চলছে কোচিং বাণিজ্য। এটা হচ্ছে বেশির ভাগই শহর এলাকায়। গ্রাম এলাকায় পরিবর্তন এসেছে স্কুল ঘরে। আগে স্কুল শিক্ষকরা স্কুল ঘরকেই তাঁদের কোচিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এখন তাঁরা স্কুলের বাইরে শহরের কোচিং সেন্টারের মতো সেন্টার বানিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রায় প্রতিটি স্কুলের কাছাকাছিই রীতিমতো স্কুলের মতো স্কুল বসে সকাল-বিকেল। সেসব স্থানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে অনুপস্থিত থেকে কোচিং সেন্টারে নিয়মিত থাকছে।
কোচিং বাণিজ্যের কুফল থাকলেও কোচিং বন্ধ করার কাজটি সহজ নয়। তা প্রমাণ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বাধ্য হওয়া দেখে। কিছু কোচিং সেন্টারের প্রবল সাংগঠনিক শক্তির জোরে সরকার পরীক্ষা নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন থেকে যদি পাবলিক পরীক্ষার ফলকে ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাইরের কোচিং বাণিজ্যগুলো বন্ধ হবে। কিন্তু কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার পর শিক্ষার্থীদের অবস্থা কী দাঁড়াবে সেদিকে কি সরকার দৃষ্টি দিয়েছে? স্কুলগুলো বছরে পাঁচ-ছয় মাসের বেশি ক্লাস করাতে পারে না নানা কারণে। কোনো স্কুলেই শিক্ষার্থীর সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদান শেষ করা সম্ভব হয় না সংগত কারণেই। তাহলে তারা সেই শিক্ষার সুযোগটি পাবে কোথায়?
সিলেবাস শেষ করতে না পারার পেছনে কাজ করছে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ। সবার চোখের সামনে এবং সরকারের জ্ঞাতসারে প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীকে স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরে চার থেকে ছয়টি বই পড়তে বাধ্য করা হয়, যা শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের পরিবর্তে তাদের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে। অতিরিক্ত বই কেন পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয়, সেদিকে কোনো দৃষ্টিই দেওয়া হয় না। যেহেতু স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বই পড়ার জন্য প্রণয়ন করে থাকে, তাই এটাই সঠিক বলে গণ্য, ঠিক ওই পরিমাণ বই-ই শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য। আর সেই বইগুলোই যদি পড়ানো হয়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত দিন ক্লাস হয় তার মধ্যেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সিলেবাস শেষ হয়ে যাবে। আর শিক্ষার্থীও সীমিত পরিমাণ বই পড়ার মাধ্যমে নিজের সৃজনশীলতা প্রমাণে সক্ষম হবে। শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করার জন্য দায়ী কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে হলে এখনই বাড়তি বইয়ের চাপ কমিয়ে আনতে হবে। পাঠক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, তা যাতে তাঁরা কঠোরভাবে মেনে চলেন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। গ্রামের স্কুলগুলোর কোন কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য চালাচ্ছেন, তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পক্ষে না জানার কোনো কারণ নেই। তাঁরা যদি আন্তরিক হন, তাহলে কোনো শিক্ষকই অপতৎপরতা চালাতে পারবে না। সবার আগে চাই আন্তরিকতাপূর্ণ শিক্ষাদান কর্মসূচি, যা একজন প্রকৃত শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.