সময়ের কথা-উন্নয়নের জটিল ধাঁধা ও শিকড়ের সন্ধান by অজয় দাশগুপ্ত

একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় যখন নিশ্চিত, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে তারা পিছু হটছে দেশের থানা-জেলা থেকে ঢাকার দিকে এবং ভরসা করে আছে_ বঙ্গোপসাগরে চলে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সপ্তম নৌবহরের
জাহাজগুলো থেকে নিশ্চয়ই ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান উড়ে এসে তাদের শুধু উদ্ধার করবে না, বাংলাদেশে নিষ্ঠুর কর্তৃত্বের অবস্থানও ফিরিয়ে আনবে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করতে থাকে। দেশব্যাপী তারা গণহত্যা পরিচালনা করে। ধান-পাটের ক্ষেতে কাজ করার সময় কৃষকদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। কারখানা ঘেরাও দিয়ে গুলি করা হয় শ্রমিকদের। মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করার পর সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলা এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরে তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিযানের কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়ে।
এমন অপরিমেয় ক্ষতি যে ভূখণ্ডে ঘটেছে তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে সময়ে বিশ্বের চরম দরিদ্র দেশগুলোর একটি ছিল পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি-লাহোর-পিন্ডি-ইসলামাবাদ গড়ে তোলার জন্য আমাদের সীমিত যে পাট ও অন্যান্য সম্পদ ছিল তা লুণ্ঠন করা হয়েছে একটানা ২০-২২ বছর। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার পরপরই এ দেশটির সব অভাব-অনটন ঘুচে যাবে, খাওয়া-থাকা-পরা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা থাকবে না_ এমন প্রত্যাশা করা সঠিক ছিল না।
১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আলোচনায় বসেছিলেন হোয়াইট হাউসে সে দেশের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে। এ বৈঠকের বিবরণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় যে, কিসিঞ্জার জানতে চেয়েছেন_ পূর্ব পাকিস্তানে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হবে কি? মরিস জে. উইলিয়ামস নামের একজন উত্তর দেন যে, পরের বসন্তে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। কিসিঞ্জার তখন প্রশ্ন রাখেন, যুক্তরাষ্ট্রকেই তখন বাংলাদেশকে বেইল আউট করার জন্য অনুরোধ জানানো হবে? উইলিয়ামস বলেন, ১৯৭২ সালের মার্চ মাস নাগাদ বাংলাদেশের সব ধরনের সহায়তার প্রয়োজন হবে। বৈঠকে উপস্থিত উরাল আলেক্সিস জনসন তখন বলেন, বাংলাদেশ 'আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস' হবে। হেনরি কিসিঞ্জার তখন বলেন, 'বাট নট নেসেসারিলি আওয়ার বাস্কেট কেস'।
বাস্কেট কেস বলতে সাধারণত বোঝায় এমন সব সৈনিককে, যারা যুদ্ধে চারটি হাত-পা হারিয়েছে এবং নিজে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। নৈরাশ্যজনক বা চরম হতাশার অবস্থা বোঝাতেও 'বাস্কেট কেস' ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জন্য একাত্তরে যে কঠিন সময় সৃষ্টি করেছিল তা থেকে মুক্ত হওয়া রাতারাতি সম্ভব ছিল না। কেবল কোটি কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই প্রয়োজন ছিল উন্নত দেশগুলোর খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য। ফসল-পঞ্জিকা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল ডিসেম্বর (পৌষ মাস) মাসে এবং তখন ছিল আমন ধান কাটার সময়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কারণে কৃষকরা ফসলের জমিতে যেতে পারেনি। সে সময়ে চৈত্র-বৈশাখে বোরো ধান এখনকার মতো উৎপন্ন হতো না। বর্ষায় আউশের ফলনও চাহিদার তুলনায় কম ছিল। আমাদের একটি ভালো ফলনের জন্য অপেক্ষা ছিল এক বছর পরের ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমন মৌসুমের জন্য।
জন্ম-যন্ত্রণা তো কেবল গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটেই সীমাবদ্ধ ছিল না!
এই দেশটি সম্পর্কেই ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের কোনো 'বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ' মন্তব্য করে বসলেন_ এমনকি সর্বোত্তম পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ এক জটিল উন্নয়ন সমস্যা। জনবহুল দেশের বেশিরভাগ মানুষ গরিব এবং অশিক্ষিত। সর্বত্র তারা গিজগিজ করছে। ১৯৭৬ সালে জাস্ট ফালান্ড ও পারকিনসন আরও তির্যক মন্তব্য করেন : 'যদি বাংলাদেশে উন্নয়ন সম্ভব হয়, তাহলে সন্দেহ নেই যে বিশ্বের যে কোনো স্থানে তা সম্ভব হবে। এই অর্থে বলা যায়, বাংলাদেশ হচ্ছে টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট।'
বাংলাদেশের বিজয়ের ৪১ বছর পূর্ণ হবে ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের যে তরুণ প্রজন্ম সোচ্চার হয়ে দাবি তুলেছে_ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা নেই এবং তাদের কারণেই এখন গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা কাঠগড়ায়, তাদের কাছে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন থাকবে_ বাংলাদেশ কি হোপলেস অবস্থায় রয়েছে? বাংলাদেশকে কি যথার্থই বাস্কেট কেস বা অপরের দয়ায় বেঁচে থাকা দেশ বলা যায়? অনেক সমস্যা-অপূর্ণতা রয়েছে আমাদের। কিছু লোকের দুর্নীতি-অনিয়ম সীমাহীন। ধনিকশ্রেণী প্রকৃতই লুটপাটের অর্থনীতি চালু করেছে। ক্ষমতার দণ্ড যাদের হাতে_ তা রাজনীতিবিদ হোক কিংবা সামরিক শাসনের আমলের কর্তাব্যক্তি হোক, তাদের চারপাশে থাকা অনেক লোক নিজের পকেট ভারী করার কৌশল দ্রুত রপ্ত করে ফেলে। পেশাগত কারণে অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পরিচয় ঘটেছে। তারা অকপটে স্বীকার করেন যে, অর্থনীতি বিষয়টি তারা মোটেই ভালো বোঝেন না। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখি যে, নিজের অর্থনৈতিক আখের কী দক্ষতার সঙ্গেই না তারা গুছিয়ে নিতে পারেন! সরকারের কোন প্রকল্প বা কেনাকাটা থেকে কীভাবে নিজের কিংবা দলীয় লোক বা আত্মীয়-স্বজনের জন্য ভালো পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতে হবে সেটা বোঝেন চমৎকার। প্রায়ই মনে হয়, এ বুদ্ধি যদি তারা দেশের স্বার্থে খাটাতেন!
যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের 'বাস্কেট কেসে' ফিরে যাই। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে একটি কথা চালু হয়_ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন 'বটমলেস বাস্কেট', যার বাংলা অর্থ করা হয় 'তলাবিহীন ঝুড়ি'। বলা হয়, দেশটিতে দুর্নীতি এত বেশি যে বিদেশি সাহায্য যাই ফেলা হোক না কেন ঝুড়ির যেহেতু তলা নেই, তাই সব লুটপাট হয়ে যায়। এই লুটপাট যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। দেশের ধনবানদের তালিকা হাতে নিয়ে তাদের অনেকের ইতিহাস খুঁজে দেখুন, দেখবেন ক্লিন কমই পাবেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি, সব প্রধান দলের আমলের চিত্র অভিন্ন। আর জামায়াতে ইসলামী? তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে গড়ে উঠেছে তার কার্যকর তদন্ত এখন পর্যন্ত কোনো সরকার করেনি। সাদা চোখেই দেখা যায় যে, অঢেল সম্পদ নিয়ে জামায়াত-শিবির মাঠে নেমেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য। বিশ্বের 'সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ' হিসেবে একাধিকবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে। এর পদ্ধতি সঠিক কি-না সে প্রশ্ন করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি আছে অনেক স্থানে এবং তার মাত্রা যে ব্যাপক সেটা নিয়ে সন্দেহ করার উপায় নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যে কৃষক-ক্ষেতমজুররা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে তারা কি দুর্নীতি করে? যে তৈরি পোশাকশিল্পের ৩০-৩৫ লাখ নারী শ্রমিক দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে তারা কি দুর্নীতি করে? যে ৭০-৭৫ লাখ স্বল্প শিক্ষিত মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ ও মালয়েশিয়ায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন দেশে পাঠায়, তারা কি দুর্নীতি করে? অনেক ধনবান ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ দেশের বাইরে টাকা পাচার করে বলে অভিযোগ। কিন্তু যে কৃষকের সন্তান জমিজমা বিক্রি করে সৌদি আরব বা আমিরাতে চলে গেছে এবং অনেক কষ্টে আয় করা রিয়াল-দিনার-ডলার দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তাদের কেউ তো দুর্নীতি করে না। গত দুই বছরে ক্লাস এইটের পরীক্ষায় পাস করেছে ১৪ লাখ ছাত্রী। এবারেও পরীক্ষা দিয়েছে ১০ লাখ ছাত্রী। তাদের বেশিরভাগ গ্রামের। তাদের অনেকে নানা কটু মন্তব্য গায়ে না মেখে স্কুলে যায়। আবার কেউবা অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। তারা তো দুর্নীতি করে না। তাদের কারণে তো বিদেশে দেশের বদনাম হয় না। বরং আয় বাড়ে, সুনাম হয়।
সম্প্রতি দি ইকোনমিস্ট লিখেছে : বাংলাদেশ 'আউট অব দি বাস্কেট'। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে দেশটি এক সময় খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করত, তারা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশে অর্জন উল্লেখ করার মতো। এর পেছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অবদান রয়েছে। কৃষকদের শ্রম-ঘাম রয়েছে। বাইরে গিয়ে নয়, কেবল ঘর সামলাচ্ছেন যে নারী তাকেও আমরা হিসাব থেকে বাইরে রাখতে পারি না। সবাই কমবেশি বাস্কেট থেকে দেশটিকে বাইরে নিয়ে আসায় কিছু কিছু ভূমিকা রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবেন। কিন্তু দেখুন, আমরা নিজেরা নিজেকে কীভাবে ছোট করি, বিশ্বের কাছে তুচ্ছ করি। দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো_ সবচেয়ে বেশি প্রচার যাদের। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন নিয়ে তাদের অনলাইন ডেস্ক ২ নভেম্বর লিখেছে, 'বাংলাদেশের অগ্রগতি আশ্চর্যজনক' শিরোনামে :'সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এক সময়ে বাংলাদেশকে বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি। যে দেশগুলো সবসময় বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করত, সে দেশগুলোকে কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ির তালিকায় ফেলেছিলেন। বাংলাদেশ ওই তালিকায় ছিল। কিন্তু এখন সেই তলাবিহীন ঝুড়িটিই ধীরে ধীরে উন্নয়নে ভরে উঠছে। বেরিয়ে আসছে ওই তালিকা থেকে। এখন অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত।'
কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশটিকে বাস্কেট কেস বলেছিলেন সেটি তো তখনও পাকিস্তানের অংশ! আর সেই বাস্কেট কেসের বাংলাই কেন করা হচ্ছে তলাবিহীন ঝুড়ি? ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে স্পষ্ট লেখা রয়েছে বাস্কেট কেস। নিজের গর্বিত উত্তরাধিকারকে কেন খাটো করা?
তরুণ প্রজন্ম শিকড়ের সন্ধানে সফল। প্রধানত তাদের কারণেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা কাঠগড়ায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক পথ তারা খুলে দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আয়ত্তে আসছে। আমরা যেন কেবল আবেগতাড়িত হয়ে নয়_ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজস্ব অবদান রাখতে পারি, এমন গর্বিত অবস্থানে দেশকে যে তাদেরই নিয়ে যেতে হবে এবং সেটা পারবেই। তার ভিত রচিত হয়ে আছে একাত্তরেই।

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmasil.com

No comments

Powered by Blogger.