কোরীয় প্রতিষ্ঠানের ১৭ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এনা- সাংসদের প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা by শরিফুল হাসান
সাংসদ এনামুল হকের প্রতিষ্ঠান এনা প্রপার্টিজের আর্থিক প্রতারণার কারণে রাজধানীর উত্তরার সরকারি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প থমকে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মাণপ্রতিষ্ঠান ডোঙ্গা এ এইচ অভিযোগ করেছে, প্রতারণা করে তাদের যৌথ ব্যাংক হিসাব থেকে ২১ লাখ মার্কিন ডলার (১৭ কোটি টাকা) তুলে নিয়েছে এনা।
এই প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করছে এনা ও ডোঙ্গা। শুধু টাকা তুলে নেওয়া নয়, ডোঙ্গার কর্মকর্তাদের বিদেশে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে এনার বিরুদ্ধে। এনা টাকা তুলে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এখন কিস্তিতে তা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব কারণে কাজের গতি থমকে আছে। ৩০ মাসের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও ১১ মাস চলে গেছে। কিন্তু কাজ এগোচ্ছে না।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে কোনো সাংসদ ব্যবসা করতে পারেন না। তার পরও দুই সাংসদ সরকারের এত বড় প্রকল্পে যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তা ছাড়া নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে নেওয়া এই প্রকল্প এখন পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’ হয়ে গেছে। কাজ এগিয়ে নিতে রাজউক ও মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।
রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে সম্প্রতি তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন ডোঙ্গা এ এইচ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট বু কুন লি। ওই চিঠির অনুলিপি গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসেও দেওয়া হয়েছে।
উত্তরার সম্প্রসারিত ১৮ নম্বর সেক্টরে তিন শ্রেণীতে মোট ২০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য মোট খরচ হবে নয় হাজার ৩০ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে ‘এ’ শ্রেণীতে ৭৯টি ভবন (সাড়ে ছয় হাজার ফ্ল্যাট) তৈরির জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি ভবনের কাজ পেয়েছে এনা-ডোঙ্গা-ডিডিজে। বাকি ১৮টি ভবনের মধ্যে ১৬টির কাজ পেয়েছেন সরকারি দলের আরেক সাংসদ ও রিহ্যাবের সভাপতি নসরুল হামিদ।
এনার বিরুদ্ধে ডোঙ্গার যত অভিযোগ: রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া চিঠিতে ডোঙ্গার প্রেসিডেন্ট বু কুন লি বলেন, ‘এনার খামখেয়ালির কারণে আমরা কিছু জটিল সমস্যায় পড়েছি। এনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, দরপত্র এবং অগ্রিম যত টাকা লাগে, কাজের যত পুঁজি লাগে, সেগুলো যৌথভাবে দেওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে। এসবের ভিত্তিতেই যৌথ কোম্পানি হয় এবং উত্তরা প্রকল্পে যুক্ত হই। কিন্তু এনা কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখেনি।’
চিঠিতে বলা হয়, এত কিছুর পরও প্রকল্পের স্বার্থে এবং প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও সম্মান বজায় রাখতে ডোঙ্গা এই প্রকল্প থেকে সরে যায়নি।
বরং কাজ এগিয়ে নিতে ৪০ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল হিসেবে (পারফরম্যান্স বন্ড) জমা রাখে যৌথ ব্যাংক হিসাবে। ওই হিসাব থেকে যৌথ স্বাক্ষরে টাকা তোলার কথা থাকলেও এনা একাই ২১ লাখ মার্কিন ডলার তুলে নেয়। এই টাকা তুলতে তারা ডোঙ্গা প্রতিনিধির সই নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, ওই টাকা তারা প্রকল্পে ব্যবহার না করে নিজেদের স্বার্থে খরচ করেছে।
চিঠিতে বলা হয়, ‘এই প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা বাংলাদেশের আদালতে যেতে পারতাম এবং বিচার চাইতে পারতাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এড়াতে আমরা আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চেয়েছি। আমরা এনাকে ওই টাকা ফেরত দিতে বলেছি। আর ভবিষ্যতে যেন এ সমস্যা না হয়, সে জন্য আমরা এককভাবে টাকা তোলার ক্ষমতা চাই। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছি।’
চিঠিতে আরেকটি অভিযোগে বলা হয়, গত অক্টোবরে ডোঙ্গার চারজন প্রতিনিধি কোরিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকা ছাড়তে চাইলে বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের যেতে বাধা দেয় এনা। এ ছাড়া জুলাই মাসে এনার লোকজন ডোঙ্গার প্রতিনিধিদের উত্তরায় প্রকল্প এলাকায় যেতেও বাধা দেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এই অবস্থায় সরকারের কাছে নিরাপত্তা চায় ডোঙ্গা।
রাজধানীর প্রাইম ব্যাংকের একটি শাখায় এনা-ডোঙ্গার যৌথ হিসাব ছিল। যোগাযোগ করা হলে ওই শাখার ব্যবস্থাপক ওমর কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এ বছরের জানুয়ারির দিকে তাদের একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়েছিল। ঝামেলা হওয়ার পর তারা আলাদা হিসাব চালু করেছে।
এনা প্রপার্টিজের পক্ষে এই প্রকল্পের সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধান করছেন পরিচালক সামিউল আলম। ডোঙ্গার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ডোঙ্গার কী নিয়ে দ্বন্দ্ব, সেটা আমি আপনাকে বলতে যাব কেন?’ এনার চিঠি এবং প্রতারণা করে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি তো সবই জানেন। আমাকে কেন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন? আমি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলব না। আপনি যা লেখার লিখতে পারেন।’
এ বিষয়ে ডোঙ্গা কোম্পানির বাংলাদেশি ব্যবস্থাপক হং জিন কিয়ো প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয় কোরিয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজউককে জানিয়েছে।
ডোঙ্গার অভিযোগ ও প্রতারণা করে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি দলের সাংসদ এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই চিঠির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আর একটি কাজের শুরুতে অনেক ঝামেলা থাকে। এখন কোনো সমস্যা নেই। কাজ চলছে।’
কাজে অগ্রগতি নেই: গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, এখনো মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। এলোমেলোভাবে কিছু যন্ত্র ও নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে। সেখানে কথা হয় ডোঙ্গার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এনার সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যা হওয়ার কারণে কাজে অগ্রগতি নেই। তা ছাড়া বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্র আনার কথা ছিল, সেগুলো আনা হয়নি। স্থানীয়ভাবে কিছু যন্ত্র ধার করে আনা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বছরের মার্চে সরকারের আনুষ্ঠানিক চুক্তি হলেও আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে তাদের কাজ শুরু করতে হয়। ৩০ মাসে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ১১ মাসে কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ভিত খননই (টেস্ট পাইলিং) চলছে। দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য মন্ত্রণালয় ও রাজউকের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও কাজে গতি নেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। জুলাইয়ের শেষে সাংসদ এনামুল হক চুক্তিবহির্ভূতভাবে ৪০ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করেন। তবে রাজউক তা দিতে রাজি হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনা ও ডোঙ্গার মধ্যে অনেক বিষয়েই দ্বন্দ্ব ছিল। তবে সেসব দ্বন্দ্ব তারা মিটিয়ে ফেলেছে বলে আমাদের জানিয়েছে।’ নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমরা তাদের বারবার তাগাদা দিচ্ছি। তারা নতুন করে কাজের পরিকল্পনা দিয়েছে। নির্ধারিত সময়েই তো কাজ শেষ করতে হবে।’
এদিকে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর রাজউকে আবেদন করেছেন ছয় হাজার ১০০ প্রার্থী। তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আবেদনপত্রের সঙ্গে তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট পেলে তাঁদের আরও অন্তত ৫৬ লাখ টাকা দিতে হবে। তবে কত বছর পর তাঁরা ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন, তা কেউ বলতে পারছেন না।
প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প: মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বি সি—এই শ্রেণীতে উত্তরায় মোট ২০ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হবে। ‘এ’ শ্রেণীতে ৭৯টি ভবন তৈরি হবে। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রতিটি ভবন হবে ১৬ তলা। বেজমেন্ট ও কার পার্কিংয়ের জন্য দুটি তলা হবে। বাকি ১৪ তলার একেকটিতে ছয়টি করে মোট ৮৪টি ফ্ল্যাট থাকবে। ৭৯টি ভবনে ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট হবে। রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তর যৌথভাবে এই নির্মাণকাজ তদারক করছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনগুলোর নকশা তৈরি করছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, একই প্রকল্পে ‘বি’ শ্রেণীতে মোট ৭২টি এবং ‘সি’ শ্রেণীতে আরও ৭২টি ভবন তৈরি করা হবে। এ জন্য সেপ্টেম্বর মাসের শেষে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৪৪টি ভবন তৈরির কাজ পেতে সাংসদ এনামুল হকের এনা, সাংসদ নসরুল হামিদের হামিদ কনস্ট্রাকশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৪৫টি দরপত্র কিনলেও কেবল ডোঙ্গা-এসকর্ন-শিকদার যৌথ কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে। বর্তমানে গণপূর্ত, রাজউক ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের ছয় সদস্যের কমিটি দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়ন করছে।
অভিযোগ উঠেছে, ডোঙ্গা-এসকর্ন-শিকদার যৌথ কোম্পানিকে কাজ দিতে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। রিহ্যাবের সভাপতি সাংসদ নসরুল হামিদ চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তৎপর বলে জানা গেছে। তবে এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছেন নসরুল হামিদ।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে কোনো সাংসদ ব্যবসা করতে পারেন না। তার পরও দুই সাংসদ সরকারের এত বড় প্রকল্পে যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তা ছাড়া নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে নেওয়া এই প্রকল্প এখন পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’ হয়ে গেছে। কাজ এগিয়ে নিতে রাজউক ও মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।
রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে সম্প্রতি তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন ডোঙ্গা এ এইচ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট বু কুন লি। ওই চিঠির অনুলিপি গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসেও দেওয়া হয়েছে।
উত্তরার সম্প্রসারিত ১৮ নম্বর সেক্টরে তিন শ্রেণীতে মোট ২০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য মোট খরচ হবে নয় হাজার ৩০ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে ‘এ’ শ্রেণীতে ৭৯টি ভবন (সাড়ে ছয় হাজার ফ্ল্যাট) তৈরির জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি ভবনের কাজ পেয়েছে এনা-ডোঙ্গা-ডিডিজে। বাকি ১৮টি ভবনের মধ্যে ১৬টির কাজ পেয়েছেন সরকারি দলের আরেক সাংসদ ও রিহ্যাবের সভাপতি নসরুল হামিদ।
এনার বিরুদ্ধে ডোঙ্গার যত অভিযোগ: রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া চিঠিতে ডোঙ্গার প্রেসিডেন্ট বু কুন লি বলেন, ‘এনার খামখেয়ালির কারণে আমরা কিছু জটিল সমস্যায় পড়েছি। এনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, দরপত্র এবং অগ্রিম যত টাকা লাগে, কাজের যত পুঁজি লাগে, সেগুলো যৌথভাবে দেওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে। এসবের ভিত্তিতেই যৌথ কোম্পানি হয় এবং উত্তরা প্রকল্পে যুক্ত হই। কিন্তু এনা কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখেনি।’
চিঠিতে বলা হয়, এত কিছুর পরও প্রকল্পের স্বার্থে এবং প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও সম্মান বজায় রাখতে ডোঙ্গা এই প্রকল্প থেকে সরে যায়নি।
বরং কাজ এগিয়ে নিতে ৪০ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল হিসেবে (পারফরম্যান্স বন্ড) জমা রাখে যৌথ ব্যাংক হিসাবে। ওই হিসাব থেকে যৌথ স্বাক্ষরে টাকা তোলার কথা থাকলেও এনা একাই ২১ লাখ মার্কিন ডলার তুলে নেয়। এই টাকা তুলতে তারা ডোঙ্গা প্রতিনিধির সই নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, ওই টাকা তারা প্রকল্পে ব্যবহার না করে নিজেদের স্বার্থে খরচ করেছে।
চিঠিতে বলা হয়, ‘এই প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা বাংলাদেশের আদালতে যেতে পারতাম এবং বিচার চাইতে পারতাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এড়াতে আমরা আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চেয়েছি। আমরা এনাকে ওই টাকা ফেরত দিতে বলেছি। আর ভবিষ্যতে যেন এ সমস্যা না হয়, সে জন্য আমরা এককভাবে টাকা তোলার ক্ষমতা চাই। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছি।’
চিঠিতে আরেকটি অভিযোগে বলা হয়, গত অক্টোবরে ডোঙ্গার চারজন প্রতিনিধি কোরিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকা ছাড়তে চাইলে বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের যেতে বাধা দেয় এনা। এ ছাড়া জুলাই মাসে এনার লোকজন ডোঙ্গার প্রতিনিধিদের উত্তরায় প্রকল্প এলাকায় যেতেও বাধা দেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এই অবস্থায় সরকারের কাছে নিরাপত্তা চায় ডোঙ্গা।
রাজধানীর প্রাইম ব্যাংকের একটি শাখায় এনা-ডোঙ্গার যৌথ হিসাব ছিল। যোগাযোগ করা হলে ওই শাখার ব্যবস্থাপক ওমর কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এ বছরের জানুয়ারির দিকে তাদের একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়েছিল। ঝামেলা হওয়ার পর তারা আলাদা হিসাব চালু করেছে।
এনা প্রপার্টিজের পক্ষে এই প্রকল্পের সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধান করছেন পরিচালক সামিউল আলম। ডোঙ্গার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ডোঙ্গার কী নিয়ে দ্বন্দ্ব, সেটা আমি আপনাকে বলতে যাব কেন?’ এনার চিঠি এবং প্রতারণা করে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি তো সবই জানেন। আমাকে কেন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন? আমি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলব না। আপনি যা লেখার লিখতে পারেন।’
এ বিষয়ে ডোঙ্গা কোম্পানির বাংলাদেশি ব্যবস্থাপক হং জিন কিয়ো প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয় কোরিয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজউককে জানিয়েছে।
ডোঙ্গার অভিযোগ ও প্রতারণা করে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি দলের সাংসদ এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই চিঠির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আর একটি কাজের শুরুতে অনেক ঝামেলা থাকে। এখন কোনো সমস্যা নেই। কাজ চলছে।’
কাজে অগ্রগতি নেই: গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, এখনো মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। এলোমেলোভাবে কিছু যন্ত্র ও নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে। সেখানে কথা হয় ডোঙ্গার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এনার সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যা হওয়ার কারণে কাজে অগ্রগতি নেই। তা ছাড়া বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্র আনার কথা ছিল, সেগুলো আনা হয়নি। স্থানীয়ভাবে কিছু যন্ত্র ধার করে আনা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বছরের মার্চে সরকারের আনুষ্ঠানিক চুক্তি হলেও আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে তাদের কাজ শুরু করতে হয়। ৩০ মাসে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ১১ মাসে কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ভিত খননই (টেস্ট পাইলিং) চলছে। দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য মন্ত্রণালয় ও রাজউকের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও কাজে গতি নেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। জুলাইয়ের শেষে সাংসদ এনামুল হক চুক্তিবহির্ভূতভাবে ৪০ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করেন। তবে রাজউক তা দিতে রাজি হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনা ও ডোঙ্গার মধ্যে অনেক বিষয়েই দ্বন্দ্ব ছিল। তবে সেসব দ্বন্দ্ব তারা মিটিয়ে ফেলেছে বলে আমাদের জানিয়েছে।’ নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমরা তাদের বারবার তাগাদা দিচ্ছি। তারা নতুন করে কাজের পরিকল্পনা দিয়েছে। নির্ধারিত সময়েই তো কাজ শেষ করতে হবে।’
এদিকে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর রাজউকে আবেদন করেছেন ছয় হাজার ১০০ প্রার্থী। তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আবেদনপত্রের সঙ্গে তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট পেলে তাঁদের আরও অন্তত ৫৬ লাখ টাকা দিতে হবে। তবে কত বছর পর তাঁরা ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন, তা কেউ বলতে পারছেন না।
প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প: মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বি সি—এই শ্রেণীতে উত্তরায় মোট ২০ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হবে। ‘এ’ শ্রেণীতে ৭৯টি ভবন তৈরি হবে। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রতিটি ভবন হবে ১৬ তলা। বেজমেন্ট ও কার পার্কিংয়ের জন্য দুটি তলা হবে। বাকি ১৪ তলার একেকটিতে ছয়টি করে মোট ৮৪টি ফ্ল্যাট থাকবে। ৭৯টি ভবনে ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট হবে। রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তর যৌথভাবে এই নির্মাণকাজ তদারক করছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনগুলোর নকশা তৈরি করছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, একই প্রকল্পে ‘বি’ শ্রেণীতে মোট ৭২টি এবং ‘সি’ শ্রেণীতে আরও ৭২টি ভবন তৈরি করা হবে। এ জন্য সেপ্টেম্বর মাসের শেষে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৪৪টি ভবন তৈরির কাজ পেতে সাংসদ এনামুল হকের এনা, সাংসদ নসরুল হামিদের হামিদ কনস্ট্রাকশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৪৫টি দরপত্র কিনলেও কেবল ডোঙ্গা-এসকর্ন-শিকদার যৌথ কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে। বর্তমানে গণপূর্ত, রাজউক ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের ছয় সদস্যের কমিটি দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়ন করছে।
অভিযোগ উঠেছে, ডোঙ্গা-এসকর্ন-শিকদার যৌথ কোম্পানিকে কাজ দিতে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। রিহ্যাবের সভাপতি সাংসদ নসরুল হামিদ চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তৎপর বলে জানা গেছে। তবে এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছেন নসরুল হামিদ।
No comments