নো ইজি ডে: পাঠ পর্যালোচনা- দেশপ্রেমের আমেরিকান মডেল by মশিউল আলম
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর নৌ, বিমান ও স্থল বিভাগের সমন্বিত দল ‘নেভি সিল’-এর ৬ নম্বর টিমের সাবেক সদস্য মার্ক ওয়েনের (প্রকৃত নাম ম্যাট বিসোনেট) সদ্য প্রকাশিত বই নো ইজি ডে অবলম্বনে সাত কিস্তির ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ কিস্তি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর।
সাত দিন ধরে লেখাগুলো প্রকাশের সময় অনলাইন সংস্করণে অনেক পাঠক মন্তব্য করেছেন, কিছু প্রশ্নও তুলেছেন। যেমন: আমি লাদেনের প্রতি বেশ সহমর্মিতা প্রকাশ করেছি, এর কারণ কী?
প্রেসিডেন্ট ওবামা লাদেন হত্যার পর প্রকাশ্যে বলেছেন, আমেরিকায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে, লাদেনকে হত্যা করার পর এখন তাদের এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায় যে, ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে (‘জাস্টিস হ্যাজ বিন ডান’)।
কিন্তু মার্ক ওয়েনের বইটি পড়ার পর স্পষ্ট মনে হয়েছে, লাদেনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়নি, বরং সেটি ছিল উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তপ্রসূত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (‘এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং’)। এ রকম অভিযোগ অবশ্য এই বইটি প্রকাশের অনেক আগেই উঠেছিল। প্রথমে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে মার্কিন কমান্ডো বাহিনী লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা না করে সরাসরি হত্যা করেছে। ঘটনার পরদিন, ২০১১ সালের ৩ মে ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্ট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক নিক গ্রিফ বলেন, লাদেন হত্যার ঘটনাকে তাঁর কাছে ‘যথাযথ আইনানুগ পন্থা ব্যতিরেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে মনে হয়। তিনি মন্তব্য করেন, লাদেনকে হয়তো জীবিত অবস্থায় আটক করা সম্ভব ছিল না...কিন্তু তাই বলে কাউকেই আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনকি নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদেরও ‘নিরপেক্ষ বিচার’ করা হয়েছে, বিনা বিচারে হত্যা করা হয়নি। ব্রিটেনের বিশিষ্ট আইনজীবী মাইকেল ম্যানসফিল্ড কিউসিও সন্দেহ প্রকাশ করেন, লাদেনকে জীবিত অবস্থায় আটক করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ন্যায়বিচার’ সমার্থকভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, ‘যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়া’র জায়গা নিতে পারে ‘প্রতিশোধ’। বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার জেওফ্রে রবার্টসন কিউসি ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লেখেন, লাদেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনের শাসনের নীতি লঙ্ঘিত হয়ে থাকতে পারে। আরও অনেকে এ রকম অভিযোগ ও প্রশ্ন সে সময় তুলেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সব অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করে ‘ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে’—এ অবস্থানে অটল থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাদেনকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে, এটা তারা স্বীকার করেনি। কারণ, আইনানুগভাবে এ কাজ তারা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে ‘প্রোহিভিশন অব অ্যাসাসিনেশন’ নামের একটি নির্বাহী আদেশ ১৯৮১ সাল থেকে বলবৎ আছে। তা ছাড়া কোনো ব্যক্তি যত বড় সন্ত্রাসী, খুনি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী বা যুদ্ধাপরাধী হোন না কেন, আইনানুগ পন্থায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই, যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাতে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। সিআইএর তৎকালীন পরিচালক লিওন প্যানেট্টা ও হোয়াইট হাউসের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ব্রেন্যান ঘটনার পরপরই বলেন, লাদেন নিহত হয়েছেন গুলিবিনিময়কালে। তারপর নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, লাদেনের বাড়িতে কেউ মার্কিন নেভি সিলের সৈন্যদের ওপর গুলি চালায়নি; শুধু মূল ভবনের পাশের অতিথিশালায় তাঁর সহযোগীর সঙ্গে গুলিবিনিময় হয়েছে এবং অভিযানের শুরুতেই সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা লেখে, তারা এ রকম ভাষ্য পেয়েছে যে লাদেনকে তাঁর বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যখন কমান্ডোরা দেখতে পান যে তাঁর হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ও একটি পিস্তল। জন ব্রেনান বলেন, লাদেন তাঁর স্ত্রীকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন, কমান্ডোরা সেই স্ত্রীর পায়ে গুলি করেছেন, হত্যা করেননি। সিআইএর পরিচালক লিওন প্যানেট্টা, হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ব্রেনান ও প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জে কারনি নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, ফক্স নিউজ, পিবিএস টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেন। তবে সব কথার মোদ্দাকথা, লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সরাসরি হত্যা করা হয়নি।
মার্ক ওয়েনের নো ইজি ডে বইটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে লাদেন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মার্কিন কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিবরণকে তা মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। অভিযানে অংশগ্রহণকারী ওয়েনের বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে অভিযানটি কোনোভাবেই ‘ক্যাপচার অপারেশন’ ছিল না, ছিল ‘কিলিং অপারেশন’। ওয়েনের বিবরণে আমরা যেন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করলাম, মার্কিন কমান্ডোরা অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িতে ঢুকেছিলেন লাদেন ও তাঁর সহযোগী পুরুষদের হত্যা করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে।
বইটির শুরুতেই ওয়েন এক জায়গায় লিখেছেন, ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্যটি যখন তিনি টেলিভিশনের পর্দায় দেখছিলেন, তখনই তাঁর ইচ্ছে করেছিল লাদেনকে হত্যা করার জন্য ছুটে যেতে। তার পর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, কবে তাঁর জীবনে সেই সুযোগ আসবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি লিখেছেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও চাইছিলেন তিনি যেন আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের ‘এ লিটল পেব্যাক’ করার জন্য আফগানিস্তানে যান। তিনি বান্ধবীকে ই-মেইল লেখেন, ‘শিগগিরই বাড়ি আসছি, যদি তার আগে বিন লাদেনকে মারতে যেতে না হয়।’
তারপর আরেক জায়গায় দেখি, অভিযানের বেশ কিছুদিন আগে, প্রশিক্ষণের সময় সিআইএর নারী কর্মকর্তা জেন, যিনি পাঁচ বছর ধরে লাদেনের পেছনে লেগে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে মার্ক ওয়েনের গল্প হচ্ছে লাদেনের লাশ নিয়ে। জেন বলছেন, তিনি লাদেনের লাশ দেখবেন না; তাঁর চাকরির যা দায়িত্ব, তার সঙ্গে রক্ত, লাশ—এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। কথা হচ্ছে লাদেনের লাশ নিয়ে, বন্দী বা আসামি লাদেনকে নিয়ে নয়। অর্থাৎ প্রশিক্ষণ চলছে লাদেন হত্যা অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে, তাঁকে আটক করার কোনো প্রসঙ্গ নেই।
একই প্রসঙ্গ লক্ষ করি বইটির আরও এক জায়গায়। প্রশিক্ষণ চালকালীন এক রাতে ওয়েন তাঁর দুই সহযোদ্ধার সঙ্গে গল্প করছেন। লাদেনকে পাওয়া গেলে তাঁর শরীরের কোন অংশে গুলি চালানো উচিত—এই হচ্ছে গল্পের বিষয়। ওয়েনের মত, গুলি যেন লাদেনের মুখমণ্ডলে না লাগে। কারণ, তাঁর চেহারাটা অক্ষত রাখা উচিত; বিশ্ববাসীকে দেখানো দরকার যে লাদেনকে খতম করা হয়েছে। এখানেও সরাসরি গুলি করার প্রসঙ্গ। লাদেনকে আটক করা বা আত্মসমর্পণ করতে বলা প্রসঙ্গে কোনো কথাই নেই। অর্থাৎ লাদেনকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প চিন্তা যে ছিল না, এ থেকে সেটাই মনে হয়।
ঘটনাটি যে সুপরিকল্পিত হত্যা অভিযান ছিল, তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় যখন লাদেনের বাড়ির অতিথিশালায় ওয়েন ও তাঁর টিমের সহযোদ্ধা উইল লাদেনের বার্তাবাহক আশরাফ খান ওরফে আল-কুয়েতির ওপর আক্রমণ চালান। মার্ক তাঁর অস্ত্রের বাঁট দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে ঘরের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি চালানোর পর ভেতরে উইল আরবি ভাষায় ডেকে ওঠেন: ‘আল-কুয়েতি, বেরিয়ে এসো।’ কিন্তু আল-কুয়েতি ততক্ষণে মৃত। শিশু কোলে তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘সে মারা গেছে। তোমরা গুলি করেছ, তোমরা তাকে মেরে ফেলেছ।’ কমান্ডোরা গুলি চালানো শুরু করার আগে আল-কুয়েতিকে আত্মসমর্পণ করতে বলেননি।
গুলিবিনিময় বলতে ওটুকুই; আল-কুয়েতির পর কমান্ডোদের ওপর আর কেউ একটি গুলিও যে ছোড়েনি। মার্ক ওয়েনের বিবরণ থেকেই আমরা তা স্পষ্ট জানতে পারলাম। কিন্তু দেখলাম, মূল বাড়িটির নিচতলায় কমান্ডোরা আল-কুয়েতির ছোট ভাই আবরার খানকে দেখামাত্র গুলি করলেন। আবরার খানের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, তিনি দরজা দিয়ে উঁকি মেরেছিলেন মাত্র, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথা লক্ষ করে গুলি চালিয়েছেন কমান্ডোদের পয়েন্টম্যান। আহত আবরার খান মেঝেতে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় তড়পাচ্ছেন, তখন আবার তাঁর ওপর গুলি চালালেন কমান্ডোরা, এই সময় আবরারের স্ত্রী বুশরা স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসে নিজেও প্রাণ হারালেন। তারপর দোতলায় লাদেনের ছেলে খালিদকে এবং তৃতীয় তলায় লাদেনকেও কমান্ডোরা হত্যা করেছেন একই পন্থায়: দেখামাত্র গুলি চালিয়ে, আত্মসমর্পণের আহ্বান না জানিয়েই। দেখামাত্র গুলি না করে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালে লাদেন ও অন্যরা কে কী করতেন, তা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু তা থেকে অন্তত এটা বোঝা যেত যে মার্কিন কমান্ডোদের ওপর জীবিত আটক করার আদেশ ছিল।
লাদেন ও তাঁর আল-কায়েদা বাহিনী বিশ্বের শান্তি বিপন্ন করেছেন, হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছেন, ইসলাম ধর্মের ভীষণ ক্ষতি করেছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় লাখ লাখ মুসলমানের জীবন-জীবিকায় সংকট সৃষ্টির কারণ হয়েছেন। তাই তাঁর প্রতি সহানুভূতি-সহমর্মিতা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই—কিছু পাঠক এ রকম মন্তব্য করেছেন। একমত হওয়া কঠিন। লাদেনের রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মপন্থাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কিন্তু আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তাঁর বিচার করার পরিবর্তে তাঁকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও আসলে সেই একই লাদেনীয় পন্থা; সভ্য, আইনানুগ, রাষ্ট্রীয় পন্থা নয়।
মার্ক ওয়েন নো ইজি ডে বইটি লিখেছেন আমেরিকান তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে: তাঁরা যেন নেভি সিলের সদস্য হয়ে আমেরিকাকে শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখেন, আমেরিকা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারী শত্রুকে জল-স্থল-অন্তরিক্ষ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে হত্যা করেন।
দেশপ্রেমের এই আমেরিকান মডেল দেশে দেশে গণতন্ত্র, মুক্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি নীতি-আদর্শের প্রচারক আমেরিকান রাষ্ট্রকে উপহাস করছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
প্রেসিডেন্ট ওবামা লাদেন হত্যার পর প্রকাশ্যে বলেছেন, আমেরিকায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে, লাদেনকে হত্যা করার পর এখন তাদের এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায় যে, ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে (‘জাস্টিস হ্যাজ বিন ডান’)।
কিন্তু মার্ক ওয়েনের বইটি পড়ার পর স্পষ্ট মনে হয়েছে, লাদেনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়নি, বরং সেটি ছিল উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তপ্রসূত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (‘এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং’)। এ রকম অভিযোগ অবশ্য এই বইটি প্রকাশের অনেক আগেই উঠেছিল। প্রথমে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে মার্কিন কমান্ডো বাহিনী লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা না করে সরাসরি হত্যা করেছে। ঘটনার পরদিন, ২০১১ সালের ৩ মে ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্ট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক নিক গ্রিফ বলেন, লাদেন হত্যার ঘটনাকে তাঁর কাছে ‘যথাযথ আইনানুগ পন্থা ব্যতিরেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে মনে হয়। তিনি মন্তব্য করেন, লাদেনকে হয়তো জীবিত অবস্থায় আটক করা সম্ভব ছিল না...কিন্তু তাই বলে কাউকেই আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনকি নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদেরও ‘নিরপেক্ষ বিচার’ করা হয়েছে, বিনা বিচারে হত্যা করা হয়নি। ব্রিটেনের বিশিষ্ট আইনজীবী মাইকেল ম্যানসফিল্ড কিউসিও সন্দেহ প্রকাশ করেন, লাদেনকে জীবিত অবস্থায় আটক করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ন্যায়বিচার’ সমার্থকভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, ‘যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়া’র জায়গা নিতে পারে ‘প্রতিশোধ’। বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার জেওফ্রে রবার্টসন কিউসি ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লেখেন, লাদেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনের শাসনের নীতি লঙ্ঘিত হয়ে থাকতে পারে। আরও অনেকে এ রকম অভিযোগ ও প্রশ্ন সে সময় তুলেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সব অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করে ‘ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে’—এ অবস্থানে অটল থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাদেনকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে, এটা তারা স্বীকার করেনি। কারণ, আইনানুগভাবে এ কাজ তারা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে ‘প্রোহিভিশন অব অ্যাসাসিনেশন’ নামের একটি নির্বাহী আদেশ ১৯৮১ সাল থেকে বলবৎ আছে। তা ছাড়া কোনো ব্যক্তি যত বড় সন্ত্রাসী, খুনি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী বা যুদ্ধাপরাধী হোন না কেন, আইনানুগ পন্থায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই, যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাতে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। সিআইএর তৎকালীন পরিচালক লিওন প্যানেট্টা ও হোয়াইট হাউসের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ব্রেন্যান ঘটনার পরপরই বলেন, লাদেন নিহত হয়েছেন গুলিবিনিময়কালে। তারপর নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, লাদেনের বাড়িতে কেউ মার্কিন নেভি সিলের সৈন্যদের ওপর গুলি চালায়নি; শুধু মূল ভবনের পাশের অতিথিশালায় তাঁর সহযোগীর সঙ্গে গুলিবিনিময় হয়েছে এবং অভিযানের শুরুতেই সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা লেখে, তারা এ রকম ভাষ্য পেয়েছে যে লাদেনকে তাঁর বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যখন কমান্ডোরা দেখতে পান যে তাঁর হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ও একটি পিস্তল। জন ব্রেনান বলেন, লাদেন তাঁর স্ত্রীকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন, কমান্ডোরা সেই স্ত্রীর পায়ে গুলি করেছেন, হত্যা করেননি। সিআইএর পরিচালক লিওন প্যানেট্টা, হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ব্রেনান ও প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জে কারনি নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, ফক্স নিউজ, পিবিএস টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেন। তবে সব কথার মোদ্দাকথা, লাদেনকে জীবিত আটক করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সরাসরি হত্যা করা হয়নি।
মার্ক ওয়েনের নো ইজি ডে বইটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে লাদেন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মার্কিন কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিবরণকে তা মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। অভিযানে অংশগ্রহণকারী ওয়েনের বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে অভিযানটি কোনোভাবেই ‘ক্যাপচার অপারেশন’ ছিল না, ছিল ‘কিলিং অপারেশন’। ওয়েনের বিবরণে আমরা যেন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করলাম, মার্কিন কমান্ডোরা অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িতে ঢুকেছিলেন লাদেন ও তাঁর সহযোগী পুরুষদের হত্যা করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে।
বইটির শুরুতেই ওয়েন এক জায়গায় লিখেছেন, ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্যটি যখন তিনি টেলিভিশনের পর্দায় দেখছিলেন, তখনই তাঁর ইচ্ছে করেছিল লাদেনকে হত্যা করার জন্য ছুটে যেতে। তার পর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, কবে তাঁর জীবনে সেই সুযোগ আসবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি লিখেছেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও চাইছিলেন তিনি যেন আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের ‘এ লিটল পেব্যাক’ করার জন্য আফগানিস্তানে যান। তিনি বান্ধবীকে ই-মেইল লেখেন, ‘শিগগিরই বাড়ি আসছি, যদি তার আগে বিন লাদেনকে মারতে যেতে না হয়।’
তারপর আরেক জায়গায় দেখি, অভিযানের বেশ কিছুদিন আগে, প্রশিক্ষণের সময় সিআইএর নারী কর্মকর্তা জেন, যিনি পাঁচ বছর ধরে লাদেনের পেছনে লেগে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে মার্ক ওয়েনের গল্প হচ্ছে লাদেনের লাশ নিয়ে। জেন বলছেন, তিনি লাদেনের লাশ দেখবেন না; তাঁর চাকরির যা দায়িত্ব, তার সঙ্গে রক্ত, লাশ—এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। কথা হচ্ছে লাদেনের লাশ নিয়ে, বন্দী বা আসামি লাদেনকে নিয়ে নয়। অর্থাৎ প্রশিক্ষণ চলছে লাদেন হত্যা অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে, তাঁকে আটক করার কোনো প্রসঙ্গ নেই।
একই প্রসঙ্গ লক্ষ করি বইটির আরও এক জায়গায়। প্রশিক্ষণ চালকালীন এক রাতে ওয়েন তাঁর দুই সহযোদ্ধার সঙ্গে গল্প করছেন। লাদেনকে পাওয়া গেলে তাঁর শরীরের কোন অংশে গুলি চালানো উচিত—এই হচ্ছে গল্পের বিষয়। ওয়েনের মত, গুলি যেন লাদেনের মুখমণ্ডলে না লাগে। কারণ, তাঁর চেহারাটা অক্ষত রাখা উচিত; বিশ্ববাসীকে দেখানো দরকার যে লাদেনকে খতম করা হয়েছে। এখানেও সরাসরি গুলি করার প্রসঙ্গ। লাদেনকে আটক করা বা আত্মসমর্পণ করতে বলা প্রসঙ্গে কোনো কথাই নেই। অর্থাৎ লাদেনকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প চিন্তা যে ছিল না, এ থেকে সেটাই মনে হয়।
ঘটনাটি যে সুপরিকল্পিত হত্যা অভিযান ছিল, তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় যখন লাদেনের বাড়ির অতিথিশালায় ওয়েন ও তাঁর টিমের সহযোদ্ধা উইল লাদেনের বার্তাবাহক আশরাফ খান ওরফে আল-কুয়েতির ওপর আক্রমণ চালান। মার্ক তাঁর অস্ত্রের বাঁট দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে ঘরের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি চালানোর পর ভেতরে উইল আরবি ভাষায় ডেকে ওঠেন: ‘আল-কুয়েতি, বেরিয়ে এসো।’ কিন্তু আল-কুয়েতি ততক্ষণে মৃত। শিশু কোলে তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘সে মারা গেছে। তোমরা গুলি করেছ, তোমরা তাকে মেরে ফেলেছ।’ কমান্ডোরা গুলি চালানো শুরু করার আগে আল-কুয়েতিকে আত্মসমর্পণ করতে বলেননি।
গুলিবিনিময় বলতে ওটুকুই; আল-কুয়েতির পর কমান্ডোদের ওপর আর কেউ একটি গুলিও যে ছোড়েনি। মার্ক ওয়েনের বিবরণ থেকেই আমরা তা স্পষ্ট জানতে পারলাম। কিন্তু দেখলাম, মূল বাড়িটির নিচতলায় কমান্ডোরা আল-কুয়েতির ছোট ভাই আবরার খানকে দেখামাত্র গুলি করলেন। আবরার খানের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, তিনি দরজা দিয়ে উঁকি মেরেছিলেন মাত্র, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথা লক্ষ করে গুলি চালিয়েছেন কমান্ডোদের পয়েন্টম্যান। আহত আবরার খান মেঝেতে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় তড়পাচ্ছেন, তখন আবার তাঁর ওপর গুলি চালালেন কমান্ডোরা, এই সময় আবরারের স্ত্রী বুশরা স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসে নিজেও প্রাণ হারালেন। তারপর দোতলায় লাদেনের ছেলে খালিদকে এবং তৃতীয় তলায় লাদেনকেও কমান্ডোরা হত্যা করেছেন একই পন্থায়: দেখামাত্র গুলি চালিয়ে, আত্মসমর্পণের আহ্বান না জানিয়েই। দেখামাত্র গুলি না করে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালে লাদেন ও অন্যরা কে কী করতেন, তা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু তা থেকে অন্তত এটা বোঝা যেত যে মার্কিন কমান্ডোদের ওপর জীবিত আটক করার আদেশ ছিল।
লাদেন ও তাঁর আল-কায়েদা বাহিনী বিশ্বের শান্তি বিপন্ন করেছেন, হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছেন, ইসলাম ধর্মের ভীষণ ক্ষতি করেছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় লাখ লাখ মুসলমানের জীবন-জীবিকায় সংকট সৃষ্টির কারণ হয়েছেন। তাই তাঁর প্রতি সহানুভূতি-সহমর্মিতা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই—কিছু পাঠক এ রকম মন্তব্য করেছেন। একমত হওয়া কঠিন। লাদেনের রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মপন্থাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কিন্তু আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তাঁর বিচার করার পরিবর্তে তাঁকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও আসলে সেই একই লাদেনীয় পন্থা; সভ্য, আইনানুগ, রাষ্ট্রীয় পন্থা নয়।
মার্ক ওয়েন নো ইজি ডে বইটি লিখেছেন আমেরিকান তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে: তাঁরা যেন নেভি সিলের সদস্য হয়ে আমেরিকাকে শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখেন, আমেরিকা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারী শত্রুকে জল-স্থল-অন্তরিক্ষ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে হত্যা করেন।
দেশপ্রেমের এই আমেরিকান মডেল দেশে দেশে গণতন্ত্র, মুক্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি নীতি-আদর্শের প্রচারক আমেরিকান রাষ্ট্রকে উপহাস করছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments