গোধূলির ছায়াপথে- মেঘনায় গভীর রাতে লাশের শব্দ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
শুক্রবার ভৈরবের সুমন মোল্লার লেখাটি প্রথম আলোয় পড়ার পর অনেকেই গভীর রাতে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন দিনেরাতে। আমিও। সেতুসংলগ্ন কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় মাছ ধরতে যান যাঁরা, প্রথমে ভাবেন এটি বড় মাছের ঘাই।
হ্যাঁ। বড় মাছই বটে। লাশের পর লাশ হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় গভীর রাতে মাইক্রোবাসে করে এনে সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যমুনা নদীর সেতু তৈরির সময় লাশ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল আমারই লেখা কালজানির ঢেউ উপন্যাসে:
‘নিরবধি কাল বয়ে চলেছে নদীর মতই। কালও যেমন নিজকে চেনে না, নদীও নয়। শুধু বয়ে যাওয়া। জীবনটা যেন নদীর সুতায়’।...‘যমুনার হু হু হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে শোনা যাচ্ছে অচিরেই যমুনা নদীর সেতু হবে, সোনালীদের মত কত পরিবার চিরদিনের মত সম্পত্তি হারা হয়ে যাবে, ভেসে যাবে খড়কুটার মত যমুনার প্রলয় ঝঞ্ঝায়, তার খবর কে রাখবে। নদী গ্রহণ করে চলেছে আবর্জনা থেকে লাশ, কাল কোনদিন জানতে পারবে না তাদের নাম, সেতু বানাতে গিয়ে যারা লাশ হয়েছে’।
লাশ, মরদেহ যা-ই বলুন, গত বছরের ১৫ জুলাই প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লাশের কথাই আছে, যাতে লেখা: ‘ভাসে লাশ, ডোবে মানবতা।’ লাশগুলোর খবর হয়নি, তেমনি নানা নদীতে বস্তায় ভরে লাশের যে যাত্রা শুরু, তার কোনো কিনারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো ঘৃণাহত্যা বা গণহত্যা।
আফ্রিকার অন্ধকার দেশগুলোতে কালো মানুষদের গুম হওয়া কোনো ব্যাপার নয়, যেখানে লাখ লাখ মানুষ অকারণে ঘৃণাহত্যার শিকার। সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকা খবর দিয়েছে ২০টি দেশে ঘৃণাহত্যার। মার্ক ল্যাটিমার লন্ডন থেকে ভয়েস অব আমেরিকার আফ্রিকান সার্ভিসের রিপোর্টার জো ডি ক্যাপোয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন: অসহনীয় পরিস্থিতি আফ্রিকায়, সোমালিয়ায় বা সুদানে গোত্রে গোত্রে বীভৎস দৃশ্যাবলি পৃথিবীর সামনে। মানুষ আর মানুষ নেই। পূর্ব শাদ, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে কেনিয়ায় ধর্মের নামে, গোত্রের নামে হিংসার দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে।
ল্যাটিমার আরও জানাচ্ছেন: আফ্রিকায় সংঘর্ষ ছড়াচ্ছে যেভাবে, তাতে এ কথাই বিশ্বাস করতে হয় যে এগুলো গোষ্ঠী থেকে ধর্মের দিকে অগ্রসরমাণ সংঘাত। রাজনীতিকেরা গোষ্ঠীগত সংঘাতকে আরও উসকে দিয়ে থাকেন, যার ফলে রাষ্ট্রসীমানা অতিক্রম করে সংঘাত এগিয়ে যাওয়া সহজতর। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ নিয়ে নেই কোনো মাথাব্যথা। বোঝা যাচ্ছে, আফ্রিকায় হতে চলেছে যা ঘটেছে বসনিয়ায়, যেখানে সরকারগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছিল গোষ্ঠীগতভাবে, তারপর রাষ্ট্রীয় বিভক্তি। এর ফলে সুদান থেকে একটি আমন্ত্রণ এসে অপেক্ষা করলেও এর জবাবই দিইনি। বেঘোরে কে আর প্রাণ দিতে চায়।
২০০১ সাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটছে পাকিস্তানে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে ধর্মের নামে হানাহানিতে। মসজিদে গিয়ে কেউ এবাদত করার মতো শান্তিটুকুও অর্জন করতে পারেননি, যাতে যুক্ত শিয়া-সুন্নি-আহমেদির নামে ঘৃণাহত্যা, ড্রাগ ইত্যাদি। ডক্টর ইকবালের পুত্র জাস্টিস জাভেদ ইকবালের সঙ্গে দেখা তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ও পরে তেহরানে। বললেন, ‘আর যেখানেই যাও, আমার দেশে এসো না।’ কত কষ্টে তাঁর এই উচ্চারণ।
গুয়াহাটি থেকে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) প্রধান এমপি বদরুদ্দিন আজমল জানাচ্ছেন: সম্প্রতি আসামে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, তা সাম্প্রদায়িক নয়, গোত্রগত (এথনিক)। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং বোরো ইউনিয়ন জাস্টিস ফোরাম আজমলকে দোষারোপ করেছে এই দাঙ্গাকে উসকিয়ে দিতে, যার ফলে এখানকার ছাত্ররা, এমনকি কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের ছাত্ররাও সেখান থেকে পলায়ন করছেন। আজমল বলছেন: গোত্রের সংঘাতের জন্য দায়ী ইতিহাস, ধর্ম নয়। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে সংঘাতের পেছনে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে দল ও আদর্শগত কিছু সংঘাতে প্রথম থেকেই বহুলোক প্রাণ হারিয়েছেন। এদিক থেকে আমরা খানিকটা ভালো জায়গায় আছি বলে আমার ধারণা। নদীতে লাশ বিসর্জন নিয়ে আমার অনুরোধ মাননীয় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের কাছে: ১. গুপ্তহত্যা, ঘৃণাহত্যা, গুমহত্যা তদন্তে অবিলম্বে একটি সেল প্রস্তুত করুন। সবচেয়ে সৎ ও ভালো অফিসারদের সেখানে নিয়োগ দিন। ২. যেসব জায়গায় এ হত্যা প্রবল, সেখানকার নাগরিকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সম্পৃক্ত করুন। ৩. তিন মাসের মধ্যে যাঁরা এই হত্যাগুলোর কিনারা করতে পারবেন, তাঁদের আর্থিকভাবে এবং বিশেষ করে টিভিতে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করার ব্যবস্থা করুন। ৪. এ অফিসারদের সম্মান যেন দলীয় ভিত্তিতে না হয়, বরং তাঁরা আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সব সময় চিহ্নিত থাকবেন, এই ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মস্ত এক অন্ধকার গ্রাস করে চলেছে পৃথিবীকে। এ অন্ধকারের মধ্যে পথ চলছি। গ্রন্থ লিখছে: ‘সমান নহে অন্ধ ও চক্ষুষ্মান, আর না অন্ধকার ও আলো, আর না ছায়া ও রৌদ্র। এবং সমান নহে জীবিত ও মৃত’ [৩৫: ১৯, ২০, ২১, ২২]
যদি ‘জীবিত’ হই, অপরকে সম্মান দেব না কেন? তার বেঁচে থাকার, মতামতের অধিকার হরণ করব কেন? ঘৃণায় অন্ধ, অহংকারে আত্মবিস্মৃত, আমি কি শয়তানের দোসর?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
bhatiali@mustafazamanabbasi.com
‘নিরবধি কাল বয়ে চলেছে নদীর মতই। কালও যেমন নিজকে চেনে না, নদীও নয়। শুধু বয়ে যাওয়া। জীবনটা যেন নদীর সুতায়’।...‘যমুনার হু হু হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে শোনা যাচ্ছে অচিরেই যমুনা নদীর সেতু হবে, সোনালীদের মত কত পরিবার চিরদিনের মত সম্পত্তি হারা হয়ে যাবে, ভেসে যাবে খড়কুটার মত যমুনার প্রলয় ঝঞ্ঝায়, তার খবর কে রাখবে। নদী গ্রহণ করে চলেছে আবর্জনা থেকে লাশ, কাল কোনদিন জানতে পারবে না তাদের নাম, সেতু বানাতে গিয়ে যারা লাশ হয়েছে’।
লাশ, মরদেহ যা-ই বলুন, গত বছরের ১৫ জুলাই প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লাশের কথাই আছে, যাতে লেখা: ‘ভাসে লাশ, ডোবে মানবতা।’ লাশগুলোর খবর হয়নি, তেমনি নানা নদীতে বস্তায় ভরে লাশের যে যাত্রা শুরু, তার কোনো কিনারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো ঘৃণাহত্যা বা গণহত্যা।
আফ্রিকার অন্ধকার দেশগুলোতে কালো মানুষদের গুম হওয়া কোনো ব্যাপার নয়, যেখানে লাখ লাখ মানুষ অকারণে ঘৃণাহত্যার শিকার। সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকা খবর দিয়েছে ২০টি দেশে ঘৃণাহত্যার। মার্ক ল্যাটিমার লন্ডন থেকে ভয়েস অব আমেরিকার আফ্রিকান সার্ভিসের রিপোর্টার জো ডি ক্যাপোয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন: অসহনীয় পরিস্থিতি আফ্রিকায়, সোমালিয়ায় বা সুদানে গোত্রে গোত্রে বীভৎস দৃশ্যাবলি পৃথিবীর সামনে। মানুষ আর মানুষ নেই। পূর্ব শাদ, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে কেনিয়ায় ধর্মের নামে, গোত্রের নামে হিংসার দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে।
ল্যাটিমার আরও জানাচ্ছেন: আফ্রিকায় সংঘর্ষ ছড়াচ্ছে যেভাবে, তাতে এ কথাই বিশ্বাস করতে হয় যে এগুলো গোষ্ঠী থেকে ধর্মের দিকে অগ্রসরমাণ সংঘাত। রাজনীতিকেরা গোষ্ঠীগত সংঘাতকে আরও উসকে দিয়ে থাকেন, যার ফলে রাষ্ট্রসীমানা অতিক্রম করে সংঘাত এগিয়ে যাওয়া সহজতর। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ নিয়ে নেই কোনো মাথাব্যথা। বোঝা যাচ্ছে, আফ্রিকায় হতে চলেছে যা ঘটেছে বসনিয়ায়, যেখানে সরকারগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছিল গোষ্ঠীগতভাবে, তারপর রাষ্ট্রীয় বিভক্তি। এর ফলে সুদান থেকে একটি আমন্ত্রণ এসে অপেক্ষা করলেও এর জবাবই দিইনি। বেঘোরে কে আর প্রাণ দিতে চায়।
২০০১ সাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটছে পাকিস্তানে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে ধর্মের নামে হানাহানিতে। মসজিদে গিয়ে কেউ এবাদত করার মতো শান্তিটুকুও অর্জন করতে পারেননি, যাতে যুক্ত শিয়া-সুন্নি-আহমেদির নামে ঘৃণাহত্যা, ড্রাগ ইত্যাদি। ডক্টর ইকবালের পুত্র জাস্টিস জাভেদ ইকবালের সঙ্গে দেখা তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ও পরে তেহরানে। বললেন, ‘আর যেখানেই যাও, আমার দেশে এসো না।’ কত কষ্টে তাঁর এই উচ্চারণ।
গুয়াহাটি থেকে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) প্রধান এমপি বদরুদ্দিন আজমল জানাচ্ছেন: সম্প্রতি আসামে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, তা সাম্প্রদায়িক নয়, গোত্রগত (এথনিক)। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং বোরো ইউনিয়ন জাস্টিস ফোরাম আজমলকে দোষারোপ করেছে এই দাঙ্গাকে উসকিয়ে দিতে, যার ফলে এখানকার ছাত্ররা, এমনকি কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের ছাত্ররাও সেখান থেকে পলায়ন করছেন। আজমল বলছেন: গোত্রের সংঘাতের জন্য দায়ী ইতিহাস, ধর্ম নয়। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে সংঘাতের পেছনে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে দল ও আদর্শগত কিছু সংঘাতে প্রথম থেকেই বহুলোক প্রাণ হারিয়েছেন। এদিক থেকে আমরা খানিকটা ভালো জায়গায় আছি বলে আমার ধারণা। নদীতে লাশ বিসর্জন নিয়ে আমার অনুরোধ মাননীয় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের কাছে: ১. গুপ্তহত্যা, ঘৃণাহত্যা, গুমহত্যা তদন্তে অবিলম্বে একটি সেল প্রস্তুত করুন। সবচেয়ে সৎ ও ভালো অফিসারদের সেখানে নিয়োগ দিন। ২. যেসব জায়গায় এ হত্যা প্রবল, সেখানকার নাগরিকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সম্পৃক্ত করুন। ৩. তিন মাসের মধ্যে যাঁরা এই হত্যাগুলোর কিনারা করতে পারবেন, তাঁদের আর্থিকভাবে এবং বিশেষ করে টিভিতে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করার ব্যবস্থা করুন। ৪. এ অফিসারদের সম্মান যেন দলীয় ভিত্তিতে না হয়, বরং তাঁরা আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সব সময় চিহ্নিত থাকবেন, এই ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মস্ত এক অন্ধকার গ্রাস করে চলেছে পৃথিবীকে। এ অন্ধকারের মধ্যে পথ চলছি। গ্রন্থ লিখছে: ‘সমান নহে অন্ধ ও চক্ষুষ্মান, আর না অন্ধকার ও আলো, আর না ছায়া ও রৌদ্র। এবং সমান নহে জীবিত ও মৃত’ [৩৫: ১৯, ২০, ২১, ২২]
যদি ‘জীবিত’ হই, অপরকে সম্মান দেব না কেন? তার বেঁচে থাকার, মতামতের অধিকার হরণ করব কেন? ঘৃণায় অন্ধ, অহংকারে আত্মবিস্মৃত, আমি কি শয়তানের দোসর?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
bhatiali@mustafazamanabbasi.com
No comments