নাসরীন হক এবং আমাদের নারী আন্দোলন by মাহবুবুল হক রিপন
স্বাধীনতা-পরবর্তী নারী আন্দোলনের যে কয়েক সংগঠক তাদের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং নারীমুক্তির সংগ্রাম সামনে নিয়ে গিয়েছেন, নাসরীন হক তাদের একজন। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকার অভিজাত পরিবারে। পড়াশোনা মার্কিন মুলুকের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু সেসব কিছুকে একপাশে রেখে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য। তার মত্যুর পর আজ পাঁচ বছর হতে চলছে। ইতিমধ্যে তাকে সরকার মরণোত্তর 'বেগম রোকেয়া' নারী পদক দিয়ে মনোনীত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখার শিরোনাম নাসরীন হক এবং নারী আন্দোলন কেন? সেই প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি ইভ টিজিংয়ের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে নারীরা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত এবং নির্যাতিত হচ্ছে কন্যা-জায়া-জননী সবাই। কোথাও মাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে কন্যার সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য, কোথাও স্বামীকে কিংবা শিক্ষককে প্রাণ দিতে হচ্ছে ছাত্রীর ইজ্জত রক্ষার জন্য। এ সামাজিক ব্যাধির উৎস কোথায়? সেটি মোকাবেলা করার জন্য আইন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এটিই একমাত্র দাওয়াই নয়। সমাজের গভীরে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিকারগ্রস্ততা, পাশাপাশি শক্তিশালী ও কার্যকর নারী আন্দোলনের অনুপস্থিতি। এখন যে কোনো সমাবেশ এবং মিছিলে নারীর অংশগ্রহণ যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। রাজপথের যে কোনো লড়াইয়ে নারীর অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু নারীমুক্তির আন্দোলন-সংগ্রাম সে মাত্রায় লক্ষণীয় নয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, গত শতকের আশির দশকে মহিলা পরিষদ কিংবা নারীপক্ষ_ তাদের লড়াই-সংগ্রাম যতটা তীব্র ছিল, এখন সে জায়গাটি দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে দাতানির্ভর এনজিওজীবী কিছু নারী সংগঠন। ফলে নারীমুক্তির সংগ্রামের চেয়ে নারীনেত্রী এবং তাদের সংগঠনের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পেলেও দেশের অভ্যন্তরে সেই বরগুনার দশমিনার চরাঞ্চলে এখনও নারীদের যৌনদাসীর জীবনযাপন করতে হয় চর দখলদার হাতে। শিক্ষিত নামধারী স্ট্রিট রেমিওদের উৎপাতে মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্রী উত্ত্যক্ততার খবর সংবাদপত্রে ভেসে ওঠে। সে সম্পর্কে একটি সমাবেশ আর হাল আমলের 'মানববন্ধন' একেবারেই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সাম্প্রতিক নারী আন্দোলন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বড়জোর প্রেস ক্লাব, জাতীয় জাদুঘর অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গাছতলায় মানববন্ধনের বেশি নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, আন্দোলন-সংগ্রামে নারী কর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে সেটি ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারীমুক্তির ব্যাপারটা তাদের চিন্তা এবং কর্মের মধ্যে নেই। নাসরীন হক ছিলেন নারীমুক্তি-সংগ্রামের সংগঠক। যেখানেই নারী নির্যাতন সেখানেই ছিল নাসরীনের উপস্থিতি। এসিডসন্ত্রাসে দগ্ধ হয় একটি মেয়ে। কিন্তু সেই মামলা আর চিকিৎসা খরচ জোটাতে সর্বনাশ হয় একটি পরিবার। সেই পরিবার এবং এসিড সারভাইভর মেয়েটিকে নিয়ে দিনের পর দিন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে যাওয়া, আদালতের বারান্দায় ঘোরা, উকিল-মোক্তারদের কাছে ধরনা দেওয়া ন্যায়বিচারের জন্য। একজন মানুষ এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। সেটি হচ্ছেন নাসরীন হক। আজ যে এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন গড়ে উঠেছে তার অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠন ছিলেন তিনি। আজ এসিডদগ্ধ নারীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য খবরের কাগজ থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা_ সবই পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কেন সম্ভব নয় ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা? এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ওই যে দাতানির্ভর ফ্রেমে বাঁধানো আন্দোলন। তা কোনোদিনই নারীকে মুক্তি দেবে না। নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব সেখানে থেকে সাময়িক সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদি কঠোর সংগ্রামের ধারাটা ক্রমেই ভোঁতা হয়ে যায়। নাসরীন হক সেখানে ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠক।
অর্থের বিনিময়ে টিভিতে 'টক শো' কিংবা খবরের কাগজে ক্রোড়পত্র ছাপিয়ে নারীমুক্তির কথা প্রচারে নাসরীন হক ছিলেন ঘোরবিরোধী। বিত্তবান পরিবারে বেড়ে উঠেও পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে অতি সাধারণ জীবনযাপনে তার কোনো অনভ্যস্ততা ছিল না। এখনও তার হাতে গড়ে ওঠা এসিডদগ্ধদের গানের দল 'পঞ্চম সুর' নিয়মিত রিহার্সাল করছে তারই বাসায়। ফলে এসব মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ কখনও হারিয়ে যায় না। পাওয়া যায় তাদের কাজের মধ্যে। নারী আন্দোলনের এ ক্রান্তিকালে নাসরীন হকের মতো একজন সংগঠকের বড্ড অভাব আমরা বোধ করছি। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আজ ২৪ এপ্রিল পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে।
mahbubulh@gmail.com
এ শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখার শিরোনাম নাসরীন হক এবং নারী আন্দোলন কেন? সেই প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি ইভ টিজিংয়ের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে নারীরা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত এবং নির্যাতিত হচ্ছে কন্যা-জায়া-জননী সবাই। কোথাও মাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে কন্যার সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য, কোথাও স্বামীকে কিংবা শিক্ষককে প্রাণ দিতে হচ্ছে ছাত্রীর ইজ্জত রক্ষার জন্য। এ সামাজিক ব্যাধির উৎস কোথায়? সেটি মোকাবেলা করার জন্য আইন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এটিই একমাত্র দাওয়াই নয়। সমাজের গভীরে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিকারগ্রস্ততা, পাশাপাশি শক্তিশালী ও কার্যকর নারী আন্দোলনের অনুপস্থিতি। এখন যে কোনো সমাবেশ এবং মিছিলে নারীর অংশগ্রহণ যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। রাজপথের যে কোনো লড়াইয়ে নারীর অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু নারীমুক্তির আন্দোলন-সংগ্রাম সে মাত্রায় লক্ষণীয় নয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, গত শতকের আশির দশকে মহিলা পরিষদ কিংবা নারীপক্ষ_ তাদের লড়াই-সংগ্রাম যতটা তীব্র ছিল, এখন সে জায়গাটি দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে দাতানির্ভর এনজিওজীবী কিছু নারী সংগঠন। ফলে নারীমুক্তির সংগ্রামের চেয়ে নারীনেত্রী এবং তাদের সংগঠনের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পেলেও দেশের অভ্যন্তরে সেই বরগুনার দশমিনার চরাঞ্চলে এখনও নারীদের যৌনদাসীর জীবনযাপন করতে হয় চর দখলদার হাতে। শিক্ষিত নামধারী স্ট্রিট রেমিওদের উৎপাতে মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্রী উত্ত্যক্ততার খবর সংবাদপত্রে ভেসে ওঠে। সে সম্পর্কে একটি সমাবেশ আর হাল আমলের 'মানববন্ধন' একেবারেই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সাম্প্রতিক নারী আন্দোলন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বড়জোর প্রেস ক্লাব, জাতীয় জাদুঘর অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গাছতলায় মানববন্ধনের বেশি নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, আন্দোলন-সংগ্রামে নারী কর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে সেটি ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারীমুক্তির ব্যাপারটা তাদের চিন্তা এবং কর্মের মধ্যে নেই। নাসরীন হক ছিলেন নারীমুক্তি-সংগ্রামের সংগঠক। যেখানেই নারী নির্যাতন সেখানেই ছিল নাসরীনের উপস্থিতি। এসিডসন্ত্রাসে দগ্ধ হয় একটি মেয়ে। কিন্তু সেই মামলা আর চিকিৎসা খরচ জোটাতে সর্বনাশ হয় একটি পরিবার। সেই পরিবার এবং এসিড সারভাইভর মেয়েটিকে নিয়ে দিনের পর দিন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে যাওয়া, আদালতের বারান্দায় ঘোরা, উকিল-মোক্তারদের কাছে ধরনা দেওয়া ন্যায়বিচারের জন্য। একজন মানুষ এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। সেটি হচ্ছেন নাসরীন হক। আজ যে এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন গড়ে উঠেছে তার অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠন ছিলেন তিনি। আজ এসিডদগ্ধ নারীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য খবরের কাগজ থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা_ সবই পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কেন সম্ভব নয় ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা? এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ওই যে দাতানির্ভর ফ্রেমে বাঁধানো আন্দোলন। তা কোনোদিনই নারীকে মুক্তি দেবে না। নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব সেখানে থেকে সাময়িক সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদি কঠোর সংগ্রামের ধারাটা ক্রমেই ভোঁতা হয়ে যায়। নাসরীন হক সেখানে ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠক।
অর্থের বিনিময়ে টিভিতে 'টক শো' কিংবা খবরের কাগজে ক্রোড়পত্র ছাপিয়ে নারীমুক্তির কথা প্রচারে নাসরীন হক ছিলেন ঘোরবিরোধী। বিত্তবান পরিবারে বেড়ে উঠেও পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে অতি সাধারণ জীবনযাপনে তার কোনো অনভ্যস্ততা ছিল না। এখনও তার হাতে গড়ে ওঠা এসিডদগ্ধদের গানের দল 'পঞ্চম সুর' নিয়মিত রিহার্সাল করছে তারই বাসায়। ফলে এসব মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ কখনও হারিয়ে যায় না। পাওয়া যায় তাদের কাজের মধ্যে। নারী আন্দোলনের এ ক্রান্তিকালে নাসরীন হকের মতো একজন সংগঠকের বড্ড অভাব আমরা বোধ করছি। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আজ ২৪ এপ্রিল পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে।
mahbubulh@gmail.com
No comments