বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৯০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম সাহসী একমুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালের ৯ জুন মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে (পরে শেরাটন, বর্তমানে রূপসী বাংলা) দুঃসাহসিক একটি অপারেশন করেন। তখন বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল এবং পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদানকারী কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান কারগিল পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) সফরে এসেছিলেন।
তাঁদের পিলে চমকে দিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কেঁপে উঠেছিল। এর মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিস্থিতি সফলভাবে জানান দেন। অপারেশনটি করেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক), কামরুল হক {স্বপন (বীর বিক্রম)} ও হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক)।
একটি হাইজ্যাক করা নীল রঙের ডাটসান গাড়িতে করে এসে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা অপারেশনটি করেছিলেন। গাড়ি চালান বাদল নামে তাঁদের একজন সহযোগী। তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান ছিলেন। এই অপারেশনের বিশদ বর্ণনা আছে হাবিবুল আলমের ইংরেজিতে লিখিত ব্রেভ অব হার্ট বইয়ে।
৯ জুন সন্ধ্যার আগে গুলশান থেকে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীসহ মুক্তিযোদ্ধারা গাড়িটি হাইজ্যাক করেন। এরপর তাঁরা গাড়ি নিয়ে নিজেদের গোপন অবস্থানে (সিদ্দেশ্বরী) যান। সেখান থেকে গ্রেনেড নিয়ে আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ইন্টার কন্টিনেন্টালের উদ্দেশে রওনা হন।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা সিদ্দেশ্বরী থেকে হেয়ার রোড হয়ে মিন্টো রোডে ঢুকে হোটেলের সামনে যান। হোটেলের গেটে ও ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। গেটে প্রহরারতরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীসহ তিনজন গাড়ি থেকে নেমে চারটি গ্রেনেড ছোড়েন।
তখন পোর্চে দাঁড়ানো ছিল বিদেশি প্রতিনিধিদের ব্যবহূত গাড়িবহর। গাড়িগুলো দু-তিন মিনিট আগে বিদেশি প্রতিনিধিদের নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ছিল একটি শেভ্রোলেট গাড়ি। সম্ভবত এই গাড়িতেই ছিলেন কারগিল। কারণ ওই গাড়ির সামনে ও পেছনে ছিল পুলিশের গাড়ি।
প্রথম গ্রেনেড সরাসরি পড়ে শেভ্রোলেট গাড়ির সামনের দরজা ঘেঁষে। এটি ছোড়েন আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেনেড ছোড়েন যথাক্রমে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ও হাবিবুল আলম।
অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা রমনা থানার পাশ দিয়ে রওনা হন মতিঝিলে মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের উদ্দেশে। পত্রিকাটি ছিল পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রচারযন্ত্র। পথিমধ্যে তাঁরা গাড়ি ঘুরিয়ে মগবাজার কাজী অফিসের গলিতে জামায়াতের নেতা গোলাম আযমের (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক ও অভিযুক্ত) বাড়িতে একটি গ্রেনেড ছোড়েন। এরপর তাঁরা মতিঝিলে যান এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসে দুটি গ্রেনেড ছোড়েন।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করেন। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় অপারেশনেও তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪১। গেজেটে নাম মায়া।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বর্তমানে রাজনীতির (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামে। তবে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম আলী আহমেদ মিয়া, মা আকতারুন্নেছা। স্ত্রী পারভীন চৌধুরী। তাঁদের এক মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: মোফাজ্জল হোসেন চীেধুরী বীর বিক্রম, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
তাঁদের পিলে চমকে দিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কেঁপে উঠেছিল। এর মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিস্থিতি সফলভাবে জানান দেন। অপারেশনটি করেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক), কামরুল হক {স্বপন (বীর বিক্রম)} ও হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক)।
একটি হাইজ্যাক করা নীল রঙের ডাটসান গাড়িতে করে এসে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা অপারেশনটি করেছিলেন। গাড়ি চালান বাদল নামে তাঁদের একজন সহযোগী। তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান ছিলেন। এই অপারেশনের বিশদ বর্ণনা আছে হাবিবুল আলমের ইংরেজিতে লিখিত ব্রেভ অব হার্ট বইয়ে।
৯ জুন সন্ধ্যার আগে গুলশান থেকে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীসহ মুক্তিযোদ্ধারা গাড়িটি হাইজ্যাক করেন। এরপর তাঁরা গাড়ি নিয়ে নিজেদের গোপন অবস্থানে (সিদ্দেশ্বরী) যান। সেখান থেকে গ্রেনেড নিয়ে আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ইন্টার কন্টিনেন্টালের উদ্দেশে রওনা হন।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা সিদ্দেশ্বরী থেকে হেয়ার রোড হয়ে মিন্টো রোডে ঢুকে হোটেলের সামনে যান। হোটেলের গেটে ও ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। গেটে প্রহরারতরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীসহ তিনজন গাড়ি থেকে নেমে চারটি গ্রেনেড ছোড়েন।
তখন পোর্চে দাঁড়ানো ছিল বিদেশি প্রতিনিধিদের ব্যবহূত গাড়িবহর। গাড়িগুলো দু-তিন মিনিট আগে বিদেশি প্রতিনিধিদের নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ছিল একটি শেভ্রোলেট গাড়ি। সম্ভবত এই গাড়িতেই ছিলেন কারগিল। কারণ ওই গাড়ির সামনে ও পেছনে ছিল পুলিশের গাড়ি।
প্রথম গ্রেনেড সরাসরি পড়ে শেভ্রোলেট গাড়ির সামনের দরজা ঘেঁষে। এটি ছোড়েন আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেনেড ছোড়েন যথাক্রমে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ও হাবিবুল আলম।
অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা রমনা থানার পাশ দিয়ে রওনা হন মতিঝিলে মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের উদ্দেশে। পত্রিকাটি ছিল পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রচারযন্ত্র। পথিমধ্যে তাঁরা গাড়ি ঘুরিয়ে মগবাজার কাজী অফিসের গলিতে জামায়াতের নেতা গোলাম আযমের (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক ও অভিযুক্ত) বাড়িতে একটি গ্রেনেড ছোড়েন। এরপর তাঁরা মতিঝিলে যান এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসে দুটি গ্রেনেড ছোড়েন।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করেন। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় অপারেশনেও তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪১। গেজেটে নাম মায়া।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বর্তমানে রাজনীতির (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামে। তবে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম আলী আহমেদ মিয়া, মা আকতারুন্নেছা। স্ত্রী পারভীন চৌধুরী। তাঁদের এক মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: মোফাজ্জল হোসেন চীেধুরী বীর বিক্রম, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments