বাল্যবিয়ে-শাপমোচনের জন্য আর কত অপেক্ষা?
সামাজিক-অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শুধু দেশের মানুষই নয়; দেশের বাইরের নানা সংস্থার গবেষণাতেও এ বিষয়গুলো নিয়মিত স্বীকৃত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা বিস্ময়কর।
অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ সামাজিক কাঠামো সত্ত্বেও নারীস্বাস্থ্য ও প্রজনন খাতেও আমাদের অর্জন সন্তোষজনক। প্রসূতি মা ও শিশুমৃত্যু রোধে আমরা তো বিশ্ব স্বীকৃতিই পেয়েছি। সবাই স্বীকার করেন, সাম্প্রতিক অতীতে সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। আগে যা ছিল দুঃসাধ্য; আজ তা-ই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গার্মেন্ট, ক্ষুদ্রঋণের মতো অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা তৎপরতাও সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি, গণমাধ্যমের বিকাশ_ সর্বোপরি আধুনিক ও সর্বসাম্প্রতিক তথ্যপ্রযুক্তি পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। এসব ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও কিছু কিছু নেতিবাচক সংবাদ মাঝেমধ্যেই আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়। বাল্যবিয়ে, যৌতুক বা ফতোয়া নিয়ে প্রকাশিত নানা খবর মনে করিয়ে দেয়_ এখনও দেশের বহু অঞ্চল মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার। এমনই দুটি বেদনাদায়ক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে শুক্রবারের সমকালে। একটি খবর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার। সেখানে বরাইদ ইউনিয়নের সাভার গ্রামে একের পর এক বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। গ্রামটিকে কোনোভাবে প্রত্যন্ত গ্রাম বলা চলে না। রাজধানীর নিকটবর্তী এ গ্রামে শহরের অনেক সুযোগ-সুবিধাই পেঁৗছে গেছে। যাতায়াত ব্যবস্থাও দুর্গম নয়। এমন একটি গ্রামে শিক্ষা ও সচেতনতার আলো না পেঁৗছানো বিস্ময়কর। এ গ্রামে গত তিন মাসে বেশ কয়েকটি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিয়েতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ, ইউপি সদস্যরা যাচাই-বাছাই না করেই সনদ দিয়েছেন। অন্যদিকে ইউপি সদস্যরা বলছেন, মেয়েকে গার্মেন্টে কাজে পাঠানোর নাম করে জন্মসনদ চাওয়ায় তারা দিয়েছেন। কিন্তু সে সনদ বিয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। যেভাবেই ঘটনাগুলো ঘটুক, তা দুঃখজনক। বাল্যবিয়ে দিয়ে কার্যত এই মেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবন হুমকির মুখে শুধু নয়, সম্ভাবনাময় জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়েতে মোটা অঙ্কের যৌতুক প্রদানের ঘটনাও জানা যাচ্ছে। এসব ঘটনার দায় মেয়েদের পরিবার তো বটেই, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন কিছুতেই এড়াতে পারে না। ফলে, এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবতে হবে। শুক্রবারের সমকালেই জানা গেল ময়মনসিংহের নান্দাইলের আরেক ঘটনা। সেখানকার পাঁচানি গ্রামে সপ্তম শ্রেণী পড়ূয়া একটি মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে। মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মতের মূল্য না দিয়ে প্রকারান্তরে জোর করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন চলছে। আমরা আশা করি, এ বিয়ে যে কোনো মূল্যে রোধ করা হবে। গ্রামে গ্রামে বাল্যবিয়ে রোধ করার জন্য অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্যোগ দরকার। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। অন্যথায় বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজ কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারবে না। আমরা এই অগ্রগতির সময়ে মধ্যযুগীয় পিছুটান চাই না। সেজন্য সমাজের ভেতর থেকে সচেতনতামূলক জাগরণ দরকার। সেটি সম্ভব হোক, বাল্যবিয়ের শাপমোচন হোক।
No comments