কালের পুরাণ- বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনেছেন, জনগণের শর্ত মানবেন কি? by সোহরাব হাসান
অবশেষে এক বছরের টানাপোড়েন, ঝগড়া-বিবাদ পেছনে ফেলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে রাজি হয়েছে। এটি শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি সুসংবাদ। বাংলাদেশের মানুষের জন্যও।
কেননা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের অভাবে পদ্মা সেতু না হলে সরকার বড় ধরনের লজ্জায় পড়ত এবং দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হতো। নীতিগতভাবে কোনো সরকার যদি বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তা না নিয়ে দেশীয় অর্থে চারটি পদ্মা সেতু করত, আমাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু দুর্নীতির কালিমা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থ না নেওয়ার বালখিল্য ঘোষণা কিংবা দেশপ্রেম জাগানোর চেষ্টার মধ্যে বাহাদুরি নেই। শেষাবধি সরকারের সুমতি ফিরে এসেছে, এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে সরকারের ভেতরে থাকা সেই সব ব্যক্তিকে মুর্দাবাদ জানাই, যাঁরা এই সেতুটিকে তাঁদের আয়-উন্নতি এবং ফাউ কামানোর উসিলা হিসেবে দেখেছিলেন। সব দেশে এ ধরনের ফাউ খাওয়ার লোক আছে। আমাদের দেশে খানিকটা বেশি।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে সম্মতি জানিয়ে যে বিবৃতিটি দিয়েছে, গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে তার কিছু অংশ তুলে ধরছি: ‘বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত শাখা এর আগে এই প্রকল্পে আমাদের অর্থায়নসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্যাদির কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল। এই প্রকল্পের সঙ্গে বিশ্বব্যাংককে যুক্ত রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে বলা হয়, এগুলো পূরণে সরকার ব্যর্থ হয়।...আমাদের ঋণচুক্তি বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার এই চার শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
‘...এসব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানায়। নতুন করে ঋণচুক্তির ব্যাপারে সরকার পূর্বশর্ত হিসেবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন করে ক্রয় নীতিমালা করা, যার মধ্যে জোরালো নজরদারি থাকবে; সেতুর নির্মাণকাজ হবে নির্ভেজাল এবং এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; সেতুর বিষয়ে তদন্তের বিষয় হবে পুরোপুরি নিরপেক্ষ, সরকারের তদন্ত কাজ পর্যালোচনা করতে একটি স্বাধীন বৈদেশিক প্যানেলকে অনুমতি দিতে হবে, যারা বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন দেবে। বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের সম্মত হওয়া শর্তগুলোর সন্তোষজনক বাস্তবায়নের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতুতে পুনরায় অর্থায়নের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।’
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে জড়িয়ে দুর্নীতির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয় এবং প্রতিকার দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রথমে সেই অভিযোগ আমলে নেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে পদ্মায় অনেক পানি গড়ালেও সেতু নির্মাণের দাতাদের ঋণসহায়তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে এককভাবে বিশ্বব্যাংকেরই দেওয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার। অন্যদের মধ্যে এডিবি ৬১ কোটি ডলার, জাইকা ৪১ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার। যেহেতু এই ঋণ ছিল একটি সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় এবং বিশ্বব্যাংক সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল, সে কারণে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করায় এডিবি ও জাইকাও পিছিয়ে যায়। এই দুটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি বাতিল না করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য যথাক্রমে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ফিরে আসায় এখন জাইকা ও এডিবির ঋণ পেতে আর কোনো সমস্যা থাকল না।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ঝগড়ায় শেষ পর্যন্ত সংস্থাটিরই জিত হয়েছে। তারা যেসব শর্ত বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল, সেসব শর্ত পূরণ করেই চুক্তি নবায়ন করতে হয়েছে। এতে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ অনেক পিছিয়ে গেল। সরকারের দাবি অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হলেও তা তিন-চার বছরের আগে শেষ হবে না। এর মাধ্যমে সরকার বিশ্বব্যাংকের ভাবমূর্তিই শুধু উজ্জ্বল করেনি, তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপকেও বৈধতা দিয়েছে, যা আখেরে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
এই ঘটনায় প্রমাণিত হলো, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল, তা মোটেই ভিত্তিহীন ছিল না। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে সম্মতি দেওয়ার পর এখন সরকারেরই উচিত উত্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করে যাদের কারণে দেশের এত বড় ক্ষতি হচ্ছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘দুই পক্ষই কিছু কিছু ছাড় দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আসতে রাজি হয়েছে।’ কিন্তু কাদের কারণে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে হলো, তা জনগণকে জানাতে হবে। বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো কারও কারও জন্য বেদনাদায়ক হলেও দেশ ও জনগণের জন্য খুব ক্ষতিকর হয়নি বলেই আমাদের বিশ্বাস। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দাবি করা অন্যায় নয়।
সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে না গিয়েও মোটা দাগে যে কথাটি বলা যায় তা হলো, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি তাদের ভাষায়, বাংলাদেশ সরকার ভঙ্গ করেছিল কিংবা ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল বলেই সংস্থাটি ঋণচুক্তি বাতিল করেছিল। এর দায় তো সরকারকেই নিতে হবে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কেন নেবে?
এ প্রসঙ্গে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার যে চুক্তিটি করেছিল, তার কতটা পালন করেছে, কতটা পালন করতে পারেনি, সেই প্রশ্নটি করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। সে সময়ে জনগণের সঙ্গে তাদের যেমন একটা অলিখিত চুক্তি ছিল, তেমনি ছিল লিখিত চুক্তিও। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সাংসদদের বক্তৃতা-বিবৃতি ছিল অলিখিত চুক্তি। আর লিখিত চুক্তিটি হলো ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহার, যা দিনবদলের সনদ নামে পরিচিত।
সরকারের মেয়াদ পৌনে চার বছর হয়ে গেছে। চুক্তির প্রথম পক্ষ জনগণ কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরই চুক্তির সব শর্ত পূরণ করেছে। সরকারকে তাদের আর কিছুই দেওয়ার নেই। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি আসন তাদের দিয়েছে। কিন্তু চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ সরকার জনগণকে যেসব ওয়াদা করেছিল, তা কি পূরণ করেছে? নির্বাচনী ইশতেহারের ‘অঙ্গীকার ঘোষণা ও কর্মসূচি’ অংশে আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট ওয়াদা ছিল, ‘আমরা ২০২০ সাল নাগাদ এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে সম্ভাব্য উচ্চতম প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম একটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা। একটি প্রকৃত অংশীদারমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র। এই ভিশন ও রূপকল্পের আলোকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করবে উপযুক্ত কৌশলপত্র, যার মূলে থাকবে দিনবদলের অঙ্গীকার। (নির্বাচনী ইশতেহার, ২০০৮, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)
নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের পাঁচটি অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান কৌশল হবে কৃষি ও পল্লি জীবনে গতিশীলতা আনয়ন। ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা শতকরা ২৫-এ নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য কমানোর ব্যাপারে শুরুতে সরকারের যে চেষ্টা ছিল, পরবর্তী সময়ে তাতে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাময়িক প্রতিকার হিসেবে কুইক রেন্টাল সাফল্য দেখালেও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো ঠিকমতো এগোয়নি। বন্ধ হয়নি চুরি, দুর্নীতি ও অপচয়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের যেসব অঙ্গীকার ছিল, তা হলো: সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গিবাদ দমন ছাড়া কোনো ব্যাপারেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এটাই সুশাসনের একমাত্র মাপকাঠি নয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও এখন নির্বাচন নিয়েই মহাপ্রলয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইশতেহারে সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে জাতীয় সংসদ এখন অগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেখানে বিরোধী দল যায় না, সরকারি দল গেলেও জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা বলা হলেও এখন জনপ্রশাসন সচিবের ‘হাইকোর্ট’ দেখানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী যদি তাঁর সম্পদের বিবরণ নিজস্ব ওয়েবসাইটে দিতে পারেন, অন্যদের অসুবিধা কোথায়?
নির্বাচনী ইশতেহারে আরও যেসব অঙ্গীকার ছিল, যেমন—দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে, তার কোনোটাই প্রতিপালিত হয়নি। অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে সরকারের যে চুক্তি ছিল, তার শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে।
সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো পূরণ করে পদ্মা সেতুতে দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন নিশ্চিত করেছে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে সই করা চুক্তির শর্তাবলি কবে পূরণ করবে? আদৌ পূরণ করবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে সম্মতি জানিয়ে যে বিবৃতিটি দিয়েছে, গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে তার কিছু অংশ তুলে ধরছি: ‘বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত শাখা এর আগে এই প্রকল্পে আমাদের অর্থায়নসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্যাদির কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল। এই প্রকল্পের সঙ্গে বিশ্বব্যাংককে যুক্ত রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে বলা হয়, এগুলো পূরণে সরকার ব্যর্থ হয়।...আমাদের ঋণচুক্তি বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার এই চার শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
‘...এসব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানায়। নতুন করে ঋণচুক্তির ব্যাপারে সরকার পূর্বশর্ত হিসেবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন করে ক্রয় নীতিমালা করা, যার মধ্যে জোরালো নজরদারি থাকবে; সেতুর নির্মাণকাজ হবে নির্ভেজাল এবং এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; সেতুর বিষয়ে তদন্তের বিষয় হবে পুরোপুরি নিরপেক্ষ, সরকারের তদন্ত কাজ পর্যালোচনা করতে একটি স্বাধীন বৈদেশিক প্যানেলকে অনুমতি দিতে হবে, যারা বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন দেবে। বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের সম্মত হওয়া শর্তগুলোর সন্তোষজনক বাস্তবায়নের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতুতে পুনরায় অর্থায়নের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।’
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে জড়িয়ে দুর্নীতির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয় এবং প্রতিকার দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রথমে সেই অভিযোগ আমলে নেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে পদ্মায় অনেক পানি গড়ালেও সেতু নির্মাণের দাতাদের ঋণসহায়তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে এককভাবে বিশ্বব্যাংকেরই দেওয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার। অন্যদের মধ্যে এডিবি ৬১ কোটি ডলার, জাইকা ৪১ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার। যেহেতু এই ঋণ ছিল একটি সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় এবং বিশ্বব্যাংক সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল, সে কারণে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করায় এডিবি ও জাইকাও পিছিয়ে যায়। এই দুটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি বাতিল না করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য যথাক্রমে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ফিরে আসায় এখন জাইকা ও এডিবির ঋণ পেতে আর কোনো সমস্যা থাকল না।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ঝগড়ায় শেষ পর্যন্ত সংস্থাটিরই জিত হয়েছে। তারা যেসব শর্ত বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল, সেসব শর্ত পূরণ করেই চুক্তি নবায়ন করতে হয়েছে। এতে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ অনেক পিছিয়ে গেল। সরকারের দাবি অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হলেও তা তিন-চার বছরের আগে শেষ হবে না। এর মাধ্যমে সরকার বিশ্বব্যাংকের ভাবমূর্তিই শুধু উজ্জ্বল করেনি, তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপকেও বৈধতা দিয়েছে, যা আখেরে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
এই ঘটনায় প্রমাণিত হলো, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল, তা মোটেই ভিত্তিহীন ছিল না। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে সম্মতি দেওয়ার পর এখন সরকারেরই উচিত উত্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করে যাদের কারণে দেশের এত বড় ক্ষতি হচ্ছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘দুই পক্ষই কিছু কিছু ছাড় দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আসতে রাজি হয়েছে।’ কিন্তু কাদের কারণে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে হলো, তা জনগণকে জানাতে হবে। বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো কারও কারও জন্য বেদনাদায়ক হলেও দেশ ও জনগণের জন্য খুব ক্ষতিকর হয়নি বলেই আমাদের বিশ্বাস। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দাবি করা অন্যায় নয়।
সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে না গিয়েও মোটা দাগে যে কথাটি বলা যায় তা হলো, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি তাদের ভাষায়, বাংলাদেশ সরকার ভঙ্গ করেছিল কিংবা ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল বলেই সংস্থাটি ঋণচুক্তি বাতিল করেছিল। এর দায় তো সরকারকেই নিতে হবে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কেন নেবে?
এ প্রসঙ্গে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার যে চুক্তিটি করেছিল, তার কতটা পালন করেছে, কতটা পালন করতে পারেনি, সেই প্রশ্নটি করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। সে সময়ে জনগণের সঙ্গে তাদের যেমন একটা অলিখিত চুক্তি ছিল, তেমনি ছিল লিখিত চুক্তিও। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সাংসদদের বক্তৃতা-বিবৃতি ছিল অলিখিত চুক্তি। আর লিখিত চুক্তিটি হলো ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহার, যা দিনবদলের সনদ নামে পরিচিত।
সরকারের মেয়াদ পৌনে চার বছর হয়ে গেছে। চুক্তির প্রথম পক্ষ জনগণ কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরই চুক্তির সব শর্ত পূরণ করেছে। সরকারকে তাদের আর কিছুই দেওয়ার নেই। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি আসন তাদের দিয়েছে। কিন্তু চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ সরকার জনগণকে যেসব ওয়াদা করেছিল, তা কি পূরণ করেছে? নির্বাচনী ইশতেহারের ‘অঙ্গীকার ঘোষণা ও কর্মসূচি’ অংশে আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট ওয়াদা ছিল, ‘আমরা ২০২০ সাল নাগাদ এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে সম্ভাব্য উচ্চতম প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম একটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা। একটি প্রকৃত অংশীদারমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র। এই ভিশন ও রূপকল্পের আলোকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করবে উপযুক্ত কৌশলপত্র, যার মূলে থাকবে দিনবদলের অঙ্গীকার। (নির্বাচনী ইশতেহার, ২০০৮, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)
নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের পাঁচটি অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান কৌশল হবে কৃষি ও পল্লি জীবনে গতিশীলতা আনয়ন। ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা শতকরা ২৫-এ নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য কমানোর ব্যাপারে শুরুতে সরকারের যে চেষ্টা ছিল, পরবর্তী সময়ে তাতে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাময়িক প্রতিকার হিসেবে কুইক রেন্টাল সাফল্য দেখালেও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো ঠিকমতো এগোয়নি। বন্ধ হয়নি চুরি, দুর্নীতি ও অপচয়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের যেসব অঙ্গীকার ছিল, তা হলো: সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গিবাদ দমন ছাড়া কোনো ব্যাপারেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এটাই সুশাসনের একমাত্র মাপকাঠি নয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও এখন নির্বাচন নিয়েই মহাপ্রলয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইশতেহারে সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে জাতীয় সংসদ এখন অগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেখানে বিরোধী দল যায় না, সরকারি দল গেলেও জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা বলা হলেও এখন জনপ্রশাসন সচিবের ‘হাইকোর্ট’ দেখানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী যদি তাঁর সম্পদের বিবরণ নিজস্ব ওয়েবসাইটে দিতে পারেন, অন্যদের অসুবিধা কোথায়?
নির্বাচনী ইশতেহারে আরও যেসব অঙ্গীকার ছিল, যেমন—দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে, তার কোনোটাই প্রতিপালিত হয়নি। অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে সরকারের যে চুক্তি ছিল, তার শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে।
সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো পূরণ করে পদ্মা সেতুতে দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন নিশ্চিত করেছে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে সই করা চুক্তির শর্তাবলি কবে পূরণ করবে? আদৌ পূরণ করবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments