মেয়রকে বাসায় অবরুদ্ধ রেখে মন্ত্রীর সফর by সুমন মোল্লা ও মনিরুজ্জামান

শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ গতকাল রোববার হরতালের মধ্যে পুলিশ ও র্যা বের বিপুলসংখ্যক সদস্য নিয়ে ১১ মাস পর নিজ জেলা নরসিংদী সফর করেছেন। এ সময় এক জনসভায় মন্ত্রী নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকারীদের বিচার চান।


তবে তাঁর ওই মঞ্চেই ছিলেন লোকমান হত্যা মামলার আসামি। এর আগে পথে পথে তোরণ নির্মাণ করে মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান একাধিক আসামি।
গতকাল মন্ত্রীর এই সফরকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন না নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের তিন সাংসদ। বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় নরসিংদী পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচার ও মন্ত্রীর আগমন ঠেকাতে দুই দিনের হরতাল ডেকেছিল ‘জনবন্ধু লোকমান সংগ্রাম পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। গতকাল ছিল হরতালের প্রথম দিন। শহরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক তৎপর থাকায় মাঠেই নামতে পারেননি প্রয়াত লোকমানের সমর্থকেরা। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেয়র কামরুজ্জামানকে সকালে পুলিশি পাহারায় শহরের বাসাইলে তাঁর বাড়িতে নেওয়া হয়। এরপর বাড়িতে বসানো হয় পুলিশের পাহারা। গণমাধ্যমের কর্মী ছাড়া বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মেয়র বা তাঁর পরিবারের কাউকে বাড়ির বাইরেও যেতে দেওয়া হয়নি।
মেয়র কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘লোকমানভক্তদের গ্রেপ্তার এবং আমাদের বাড়িতে আটকে রেখে মন্ত্রী নরসিংদী সফর করে গেছেন। র্যা ব, পুলিশ আর গাড়িবহর ছিল তাঁর সফরসঙ্গী, জনগণ নয়।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নরসিংদীতে মূল সড়কের পাশাপাশি গলি ও বহুতল ভবনের ছাদে পুলিশ ছিল। বসানো হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুই দিন আগে থেকে দেহ, ব্যাগ ও গাড়ি তল্লাশি শুরু হয়ে চলে মন্ত্রীর অনুষ্ঠান চলাকাল পর্যন্ত।
তোরণ ও গাড়িবহর: দুপুর সোয়া ১২টার দিকে নরসিংদীবাসী পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় ৫০০ মোটরসাইকেল ও ৩০০ প্রাইভেট কারের বহর নিয়ে নরসিংদী শহরে ঢোকেন মন্ত্রী রাজিউদ্দিন। তাঁকে স্বাগত জানাতে শহরে অনেক তোরণ নির্মাণ করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের হিসাবমতে, তোরণের সংখ্যা ৮২টি। শহরজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার করে শহরে ভিন্ন আবহ তৈরি করার চেষ্টা করে আয়োজনপক্ষ।
লোকমানের কবরে মন্ত্রী: নেতা-কর্মীরা জানতেন, মন্ত্রী প্রথমে আসবেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। সেখানে তিনি দলীয় কার্যালয়ের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করবেন। কিন্তু মন্ত্রী এসেই চলে যান পৌর কবরস্থানে। পুলিশ ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে লোকমানের কবরে ফুলের তোড়া দেন। পরে দোয়া করেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে লোকমানের কবর জিয়ারত করেন মন্ত্রী।
লোকমানের ভাই মেয়র কামরুজ্জামান বলেন, ‘কবর জিয়ারত করতেও মন্ত্রীকে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। আমাদের জানাননি। জানলে তাঁকে প্রতিহত করা হতো।’
লোকমানের স্ত্রী নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমি টের পাচ্ছি, লোকমানের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। কারণ তাঁরাই আমার স্বামীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।’
নুসরাত বলেন, ‘হরতালের সমর্থনে মিছিল করার জন্য সকালে কয়েক শ নারী বাসার সামনে জড়ো হন। পুলিশ তাঁদের মিছিল করতে দেয়নি। আমাদেরও বের হতে দেয়নি।’
মন্ত্রীর মঞ্চে লোকমান হত্যার তিন আসামি: ভাষণ দেওয়ার সময় মন্ত্রীর মঞ্চে ছিলেন লোকমান হত্যার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও সাবেক মেয়র মতিন সরকার, এজাহারভুক্ত আসামি শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়া ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি মিয়া মো. মঞ্জু।
অভিযোগপত্রভুক্ত আরেক আসামি শহর যুবলীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম সরকারকে মঞ্চে দেখা না গেলেও মন্ত্রীর আগমনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একাধিক তোরণ নির্মাণ করেছেন। তোরণ নির্মাণ করেছেন লোকমান হত্যা মামলার আরও কয়েকজন আসামি।
লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলেন মন্ত্রী: জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত জনসভায় মন্ত্রী রাজিউদ্দিন লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। ১৫ মিনিটের বক্তৃতার মধ্যে প্রায় পুরোটা সময় লোকমান প্রসঙ্গেই কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, ‘লোকমান আমার সৈনিক ছিল। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো আদর দিয়ে তাকে উঠিয়ে এনেছিলাম। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছি। শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ দিয়েছিলাম। ১৮ মাস জেল খেটে বের হওয়ার পর জেলখানার গেটে আমি লোকমানকে বলেছিলাম, আমি তোকে মেয়র বানাব।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখন সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারি, লোকমানের ভাই ও তার পরিবার ষড়যন্ত্রের শিকার। এখানে তৃতীয় শক্তি কাজ করছে। এই শক্তি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। তাদের পেছনে কারা আছে, তা লোকমান পরিবার বুঝতে পারছে না।’
১১ মাস নিজ জেলায় না আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তখন আমি এলে মামলার স্বাভাবিক গতিতে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠত।’
ছিলেন না তিন সাংসদ: মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন না নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ মো. নজরুল ইসলাম (বীর বিক্রম), নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আশরাফ খান, নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া। তবে বিকেলে রায়পুরা উপজেলার সেরাজনগর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন নরসিংদী-৪ (বেলাব-মনোহরদী) আসনের সাংসদ নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে কোনো সাংসদ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মন্ত্রী সর্বশেষ বিকেল সাড়ে চারটায় তাঁর নির্বাচনী এলাকা রায়পুরায় যান। সেখানে সেরাজনগর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয় উপজেলা আওয়ামী লীগ।
তিন লোকমান সমর্থক গ্রেপ্তার: হরতালের সময় জেলা সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাজিম উদ্দিন, মো. জামান ও শান্ত মিয়া নামে লোকমানের তিনজন সমর্থককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশকে লাঞ্ছিত মামলার আসামি দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে মোট ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
হরতাল প্রত্যাহার: আজ সোমবার দ্বিতীয় দিনের হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে জনবন্ধু লোকমান সংগ্রাম পরিষদ। মেয়র কামরুজ্জামন বলেন, মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আজ (গতকাল) এসে নরসিংদীবাসীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। সন্ত্রাসী মহড়া দিয়ে জেলাবাসীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছেন। ওই কষ্টের কথা বিবেচনায় এনে সোমবারের হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে লোকমান সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। নইলে আবার কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.