শিক্ষক কর্মচারীদের দাবি পূরণ

দেশব্যাপী শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষক-কর্মচারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে বহু বছরের দাবি ১০০ টাকার বদলে সম্মানজনক বাড়িভাড়া ও মেডিক্যাল ভাতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।


প্রথমবারের মতো হচ্ছে কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা। আবার শুরু হচ্ছে শূন্য পদে বন্ধ হওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও প্রদান কার্যক্রম। বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনগুলোর তিনটি বৃহৎ জোটের সঙ্গে বৈঠকে রবিবার এ ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এছাড়া বৈঠকে বেসরকারী শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে একটি তৃতীয় বিভাগকে বৈধতা দেয়াসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর আগে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষকরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষকরা পাচ্ছিলেন না এ ছুটি।
সকাল ১১টায় নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শিক্ষক সগঠনগুলোর ২৭ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব এসএম গোলাম ফারুক। শিক্ষক নেতাদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, সমন্বয়কারী অধ্যাপক আসাদুল হক, মোহাম্মদ আজিজুল ইমলাম, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ, বাংলাদেশ কারিগরি কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ এমএ সাত্তার, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক নেতা শাহজাহান আলম সাজু ও আতিয়ার রহমান, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (কামরুজ্জামান) সভাপতি অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক বিলকিস জামান প্রমুখ। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশব্যাপী হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের ফলে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষকরা আন্দোলনে থাকায় সঙ্কট বাড়তেই থাকে। সম্প্রতি বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের পর বেতন বৈষম্য দূর করাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সরকার সমর্থক বলে পরিচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরা। আন্দোলনে আছে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (কামরুজ্জামান)। দুই সংগঠনের লাগাতার আন্দোলনের পর বৃহস্পতিবার শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের লক্ষ্যে ঘোষিত ২১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (কামরুজ্জামান)। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে এ আল্টিমেটাম দিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘট পালনসহ আরও কঠোর কর্মসূচীর ডাক দেয়া হবে। এর আগেই সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে বেতন-ভাতা বৈষম্য দূর করাসহ ১৭ দফা দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করে বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। তাদের দাবির মধ্যে আছে- চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারী-বেসরকারী বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের সমপরিমাণ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা ও মেডিক্যাল ভাতা প্রদান করা এবং শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছরে উন্নীত করা ইত্যাদি। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষামন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত দুদিন ধরেই খবর ছড়িয়ে পরে সরকার শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ১০০ টাকার বাড়িভাড়া বাড়িয়ে ৫০০ টাকা ও মেডিক্যাল এলাউন্স ১৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করতে যাচ্ছে। আর দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকা শূন্য পদের এমপিও চালুর ঘোষণাও দেয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার সকালে আবার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। এরপর সকাল ১১টা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে শুরু হয় শিক্ষা মন্ত্রীর বৈঠক। বৈঠকে সন্তোষজনক আলোচনার পর সরকার বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়। কত টাকা বাড়ানো হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনাক্রমে এ বিষয়ে শীঘ্রই সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়ার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী।
দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বেসরকারী শিক্ষকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যেই সার্কুলার জারি হবে। ধরে নেন আজ থেকেই এটি কার্যকর হবে। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষকরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষকদের জন্য এ ছুটি নির্ধারিত ছিল না। সভায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে এসব ভাতা বাড়ানো হবে। মন্ত্রী বলেন, শিক্ষক সংগঠনগুলো আলাদা আলাদা দাবি উপস্থাপন করলেও অনেক দাবিই কমন। আমরা প্রতিটি দাবির বিষয়ে আলোচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, গত ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা সংশোধিত ‘জনবল কাঠামোতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনে কোন ৩য় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়’Ñ এই পরিপত্রটি সংশোধন করে একটি ৩য় বিভাগ/শ্রেণী প্রাপ্তরাও গ্রহণযোগ্য করা হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। শীঘ্রই এ সংক্রান্ত পরিপত্রও জারি করা হবে। কর্মচারীদের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এমপিওভুক্ত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চাকরি বিধিমালা শীঘ্রই চূড়ান্ত করা হবে। শিক্ষক নেতারে অন্যান্য দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মহাসমাবেশ স্থগিতের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বলেন, চাকরি জাতীয়করণের দাবিসহ অন্যান্য দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেছেন, বৈঠকের ফলাফল নিয়ে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জেলা উপজেলা প্রতিনিধিদের সভায় মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার আগে সরকারের প্রস্তাব ও আহ্বানের পক্ষে-বিপক্ষে জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে কোন মতামত প্রদান করা হবে না। ১৯৯১ সালের পর প্রথমবারের মতো বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি ঘোষণা, মাতৃত্বকালীন ছুটি চালুসহ অন্যান্য ঘোষণায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা অধ্যক্ষ সাজাহান আলম সাজু। এদিকে অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিরপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য জোট নেতারা বলেছেন, চাকরি জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সরকার তার পালিত শিক্ষক নেতাদের নিয়ে রবিবার বৈঠক করেছেন। অন্যদিকে সরকারের ঘোষণায় খুশি সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীরা। সকালে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরই পত্রিকা অফিসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ফোন করে সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

No comments

Powered by Blogger.