দুর্নীতির তদন্ত ও সেতুর কাজ একসঙ্গে চলবে
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা-ও নতুন করে ঠিক করা হবে। এ জন্য দাতাদের একটি প্রতিনিধিদল কাল বা পরশুর মধ্যেই ঢাকা আসছে।পদ্মা সেতু নির্মাণে নতুন করে চুক্তি করতে হবে কি না, তা-ও ঠিক করবে দাতাদের ওই কমিটি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ইকবাল মাহমুদ গতকাল রোববার বলেছেন, নির্মাণ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সহ-অর্থায়নকারীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে সরকার। তিনি আরও জানান, অচিরেই বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান উন্নয়ন সংস্থা জাইকার প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটন, ম্যানিলা ও টোকিও থেকে ঢাকায় আসবেন। তাঁরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করবেন।
ইকবাল মাহমুদ জানান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার দুই রকম মিশন আসছে। একটি মিশন কাজ করবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে, আর অপর মিশনটি দুদকের সঙ্গে তদন্তকাজে থাকবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নতুন করে তদন্তকাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য দুদক থেকে বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান চিঠি লেখার কথা প্রথম আলোকে জানিয়ে বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সঙ্গে বসার পরই তদন্তের পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়া নিয়ে গতকালই সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেছে। ইআরডি সচিব এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘যদি এই শর্ত পূরণ না হতো, তবে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার প্রশ্নই উঠত না।’
এ ছাড়া গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পুনর্গঠন নিয়ে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন মসিউর রহমান এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে এই দুজনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন এবং ছুটিতে যান মসিউর রহমান। কমিটিতে মন্ত্রিসভায় নতুন দায়িত্ব পাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটির তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর। আর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বহালের ঘোষণা দিয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর।
গত শনিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এক দিন পর (রোববার) বিকেল পাঁচটায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিবৃতি দেবেন। এ জন্য গতকাল বিকেলে সাংবাদিকেরা উপস্থিত হলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ইআরডি সচিব একটি বিবৃতি দেবেন। দাতাদের সঙ্গে সাহায্য নিয়ে সব ধরনের যোগাযোগের দায়িত্ব ইআরডির।
পরে বিকেলে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত একটি বিবৃতি দেন ইআরডি সচিব ইকবাল মাহমুদ। এ সময় অর্থায়নের সিদ্ধান্তের জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অর্থায়নকারী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল ও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে ইআরডি সচিব বলেন, প্রকল্পে ফিরে আসতে বিশ্বব্যাংক নতুন কোনো শর্ত দেয়নি, সবই পুরোনো শর্ত। নতুন করে ঋণচুক্তি করতে হবে কি না, এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি জানান, এটি চলমান প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে এটা নিশ্চিত, এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন-পদ্ধতি ঠিক করা হবে। তিনি আরও জানান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার দুই রকম মিশন আসছে। একটি মিশন কাজ করবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে, আর অপর মিশনটি দুদকের সঙ্গে তদন্তকাজে থাকবে। দুটি কাজই একসঙ্গে চলবে। এসব প্রক্রিয়ায় সরকারই থাকবে চালকের ভূমিকায়। তবে এসব কাজ করতে কত সময় লাগবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে জানিয়ে ইআরডি সচিব আরও বলেন, কত দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, সেটাই এখন বড় বিষয়।
ইতিমধ্যে প্রকল্পের ঋণচুক্তির কার্যকারিতার মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোসংক্রান্ত জাইকার চিঠি পেয়েছে ইআরডি। তবে এডিবির কাছ থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি এখনো পাওয়া যায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর এডিবির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
ইআরডি সচিব তাঁর লিখিত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ক্ষেত্রে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য ও চীন সরকারের গঠনমূলক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ, দক্ষ ও কার্যকর কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গত ১২ মাসে গৃহীত সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে পুনঃ অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, দুর্নীতি দমনের বিষয়ে সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সরকার দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে। সরকারের এই দৃঢ়তায় বিশ্বব্যাংক তার পূর্ববর্তী নীতি (সড়ক যোগাযোগ খাতে অর্থায়ন স্থগিত) পরিবর্তন করে দেশের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। সরকার তার ঘোষিত নীতিতে অটল রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প এমনভাবে বাস্তবায়ন করবে যেন তা একটি অনুকরণীয় প্রকল্প হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ইতিমধ্যে প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র’ অনুমোদন করেছে বলেও লিখিত বক্তব্যে বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার অর্থায়নের পুনঃ প্রতিশ্রুতি ছাড়াও ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা প্রদানের বিষয়টিও অনুমোদিত হয়েছে।
ইকবাল মাহমুদ লিখিত বক্তব্যে আরও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। ১৬ জেলার মেলবন্ধন হিসেবে প্রায় ছয় কোটি মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সারা দেশের জিডিপি প্রায় দশমিক ৬ শতাংশ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।
দুদকের কার্যক্রম: বিশ্বব্যাংকের শর্তের বিষয়টি মাথায় রেখে দুই সপ্তাহ আগে অনুসন্ধান কমিটি পুনর্গঠন করেছে দুদক। পুনর্গঠিত তদন্ত দল পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধান করবে। এ জন্য দুদকের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করবে দাতারা। এর ফলে তদন্তের সব ধরনের তথ্য দাতা প্রতিনিধিরা জানতে পারবেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সবাইকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। তদন্ত যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে দুদক। কেননা, দুদকের তদন্তে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকায় বিশ্বব্যাংক আপত্তি তুলেছিল। ফলে নতুন করে তদন্ত শুরু করে তা সম্পন্ন করাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ, বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত না হলে আবারও সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এ বিষয়ে গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করতে পারি না। সে জায়গা থেকে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে। একইভাবে বিশ্বব্যাংকেরও দুদকের বিষয়ে আস্থার সংকট থাকতে পারে। তবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পদ্মা সেতুর পরার্শক প্রাক্-যাচাইয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে দুদক।’ দুদকের প্রতি কেন আস্থার সংকট, এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ যা ধারণা বা চিন্তা করে, তার প্রতিফল না হলে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার সংকট কমে যায়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, তাঁরা চাইলে দুদকের বর্তমান কমিটির পরিধি বাড়ানো বা কমানো হতে পারে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার নাম আসায় তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক চাইলে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনসহ অন্যদেরও আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ইকবাল মাহমুদ জানান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার দুই রকম মিশন আসছে। একটি মিশন কাজ করবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে, আর অপর মিশনটি দুদকের সঙ্গে তদন্তকাজে থাকবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নতুন করে তদন্তকাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য দুদক থেকে বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান চিঠি লেখার কথা প্রথম আলোকে জানিয়ে বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সঙ্গে বসার পরই তদন্তের পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়া নিয়ে গতকালই সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেছে। ইআরডি সচিব এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘যদি এই শর্ত পূরণ না হতো, তবে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার প্রশ্নই উঠত না।’
এ ছাড়া গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পুনর্গঠন নিয়ে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন মসিউর রহমান এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে এই দুজনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন এবং ছুটিতে যান মসিউর রহমান। কমিটিতে মন্ত্রিসভায় নতুন দায়িত্ব পাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটির তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর। আর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বহালের ঘোষণা দিয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর।
গত শনিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এক দিন পর (রোববার) বিকেল পাঁচটায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিবৃতি দেবেন। এ জন্য গতকাল বিকেলে সাংবাদিকেরা উপস্থিত হলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ইআরডি সচিব একটি বিবৃতি দেবেন। দাতাদের সঙ্গে সাহায্য নিয়ে সব ধরনের যোগাযোগের দায়িত্ব ইআরডির।
পরে বিকেলে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত একটি বিবৃতি দেন ইআরডি সচিব ইকবাল মাহমুদ। এ সময় অর্থায়নের সিদ্ধান্তের জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অর্থায়নকারী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল ও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে ইআরডি সচিব বলেন, প্রকল্পে ফিরে আসতে বিশ্বব্যাংক নতুন কোনো শর্ত দেয়নি, সবই পুরোনো শর্ত। নতুন করে ঋণচুক্তি করতে হবে কি না, এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি জানান, এটি চলমান প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে এটা নিশ্চিত, এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন-পদ্ধতি ঠিক করা হবে। তিনি আরও জানান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার দুই রকম মিশন আসছে। একটি মিশন কাজ করবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে, আর অপর মিশনটি দুদকের সঙ্গে তদন্তকাজে থাকবে। দুটি কাজই একসঙ্গে চলবে। এসব প্রক্রিয়ায় সরকারই থাকবে চালকের ভূমিকায়। তবে এসব কাজ করতে কত সময় লাগবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে জানিয়ে ইআরডি সচিব আরও বলেন, কত দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, সেটাই এখন বড় বিষয়।
ইতিমধ্যে প্রকল্পের ঋণচুক্তির কার্যকারিতার মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোসংক্রান্ত জাইকার চিঠি পেয়েছে ইআরডি। তবে এডিবির কাছ থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি এখনো পাওয়া যায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর এডিবির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
ইআরডি সচিব তাঁর লিখিত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ক্ষেত্রে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য ও চীন সরকারের গঠনমূলক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ, দক্ষ ও কার্যকর কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গত ১২ মাসে গৃহীত সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে পুনঃ অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, দুর্নীতি দমনের বিষয়ে সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সরকার দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে। সরকারের এই দৃঢ়তায় বিশ্বব্যাংক তার পূর্ববর্তী নীতি (সড়ক যোগাযোগ খাতে অর্থায়ন স্থগিত) পরিবর্তন করে দেশের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। সরকার তার ঘোষিত নীতিতে অটল রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প এমনভাবে বাস্তবায়ন করবে যেন তা একটি অনুকরণীয় প্রকল্প হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ইতিমধ্যে প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র’ অনুমোদন করেছে বলেও লিখিত বক্তব্যে বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার অর্থায়নের পুনঃ প্রতিশ্রুতি ছাড়াও ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা প্রদানের বিষয়টিও অনুমোদিত হয়েছে।
ইকবাল মাহমুদ লিখিত বক্তব্যে আরও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। ১৬ জেলার মেলবন্ধন হিসেবে প্রায় ছয় কোটি মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সারা দেশের জিডিপি প্রায় দশমিক ৬ শতাংশ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।
দুদকের কার্যক্রম: বিশ্বব্যাংকের শর্তের বিষয়টি মাথায় রেখে দুই সপ্তাহ আগে অনুসন্ধান কমিটি পুনর্গঠন করেছে দুদক। পুনর্গঠিত তদন্ত দল পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধান করবে। এ জন্য দুদকের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করবে দাতারা। এর ফলে তদন্তের সব ধরনের তথ্য দাতা প্রতিনিধিরা জানতে পারবেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সবাইকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। তদন্ত যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে দুদক। কেননা, দুদকের তদন্তে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকায় বিশ্বব্যাংক আপত্তি তুলেছিল। ফলে নতুন করে তদন্ত শুরু করে তা সম্পন্ন করাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ, বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত না হলে আবারও সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এ বিষয়ে গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করতে পারি না। সে জায়গা থেকে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে। একইভাবে বিশ্বব্যাংকেরও দুদকের বিষয়ে আস্থার সংকট থাকতে পারে। তবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পদ্মা সেতুর পরার্শক প্রাক্-যাচাইয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে দুদক।’ দুদকের প্রতি কেন আস্থার সংকট, এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ যা ধারণা বা চিন্তা করে, তার প্রতিফল না হলে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার সংকট কমে যায়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, তাঁরা চাইলে দুদকের বর্তমান কমিটির পরিধি বাড়ানো বা কমানো হতে পারে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার নাম আসায় তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক চাইলে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনসহ অন্যদেরও আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
No comments