নাগরিক অধিকার খর্ব করবেন না by কামাল লোহানী
কাগজে খবর পড়লাম, কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইলেই এখন আর নিজেদের মতো পুরস্কার, সম্মাননা বা পদক দিতে পারবে না। যে নামে পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়া হবে, সে নাম আগে থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। সরকার এ অনুমোদন দেবে।
কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা সরকারের অনুমোদন না নিয়ে পুরস্কার বা সম্মাননা দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার।
প্রকাশিত সংবাদটিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে। জারি করা প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকার প্রদত্ত কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা অথবা পদকের নাম যেন সরকার প্রদত্ত নামের অনুরূপ না হয়। আবার বলা হয়েছে, পুরস্কার, পদক ও সম্মাননার নাম নির্ধারণের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নাম অনুমোদন করাতে হবে। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা পুরস্কার বা সম্মাননা দেবেন, তাঁদেরও নাম নাকি তাঁদের দেওয়া সম্মাননাতে উল্লেখ করতে হবে। এসব সরকারি নির্দেশ অমান্য করা হলে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এ ধরনের পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তি সরকারি আদলে এমনকি একই নামে এই পদক, পুরস্কার বা সম্মাননা যেন না দেওয়া হয়, তার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।... খুব ভালো কথা। এ ধরনের নির্দেশনা অনেক আগেই বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকারের দেওয়া উচিত ছিল। তা তারা দেয়নি। এখন কেন হঠাৎ করে টনক নড়ল, এর রহস্য বুঝতে পারছি না।
মান্যবর সরকার এবং আমলাতন্ত্র, আপনাদের কাছে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, তা হলো- জাতীয় সংগীত। আমরা জাতীয় সংগীত যেভাবে গাই, তা কি আদৌ সংগ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যার যেমন খুশি গেয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এই যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবমাননা, এটা বর্তমান সরকারও বুঝতে চাইছে না কেন? মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পার হয়ে গেছে, জাতীয় সংগীতের সুর আজও শুদ্ধতার সঙ্গে গাওয়া হয় না। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর আমলে একটি সুর এবং তার স্বরলিপিও সরকারের অনুমোদিত হয়েছিল, সেটি গেল কোথায়? সরকার কি অনুগ্রহ করে সেই স্বরলিপিভিত্তিক জাতীয় সংগীত সর্বত্র গাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে না? কেবল সরকারি অনুষ্ঠান বাণীবদ্ধ বা বাহিনী ব্যান্ডে যা বাজানো হয়, তা-ই শুদ্ধ হলে তো হবে না, সাধারণ মানুষ গাইবে এ গান। এ তো জাতীয় সংগীত। শিল্পী নন যাঁরা, তাঁরাও গাইবেন এ গান। এর শুদ্ধতা নিশ্চিত করা কিন্তু প্রয়োজন সবার আগে। অথচ ৪০ বছরেও তা নির্দিষ্ট হয়নি, এমনকি কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মোৎসবেও নয়।
একটি জাতির গর্ব ও পরিচয়ের সুরধ্বনি জাতীয় সংগীত। ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতনির্বিশেষে যে গানটি গাইতে হয়। যার জন্ম হয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, তার সঠিক সুর কেন মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সরকার নির্ধারণ করবে না? অন্যদের কাছে তো জনগণ আশাই করে না। কেবল সরকার শুদ্ধ সুর বানাচ্ছে বা গাওয়াচ্ছে, সে কথা বললে তো চলবে না। এ গান সবাইকে গাইতে হবে। স্কুল, কলেজ কিংবা জেলা, উপজেলা- সর্বত্র নানা অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত অবশ্যই গাইতে হয়। এ শুদ্ধতা সে কারণে আরো বেশি প্রয়োজন।
জাতীয় সংগীতের শুদ্ধ সুর নির্ধারিত থাকলে, তার ভিত্তিতে শিল্পকলা একাডেমী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সঠিক ও শুদ্ধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সর্বত্র জাতীয় সংগীত একইভাবে গাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এর ব্যত্যয়ের অর্থ জাতিকে অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রাহ্য করা। এর যথার্থ মর্যাদা বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন, 'জাতীয় সংগীত' হিসেবে 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে নির্ধারণ করে। আমরা কেন অনীহা কিংবা গাফিলতি দেখাচ্ছি জাতীয় সংগীতের প্রতি? এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পদক, পুরস্কার ও সম্মাননার নামকরণ, সরকারি অনুমোদন কি খুব বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা? দেশে বোধ হয় সাধারণ নিয়মের বিধানই আছে, সরকারি নামকরণে আসলে কোনো প্রতিষ্ঠানেরও নাম রাখা যায় না। সাধারণত সাধারণ মানুষও এ কথা জানে। তারা কিন্তু এমন ভুল খুব একটা করে না। করেন যাঁরা, তাঁদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। অথবা তাঁদের উদ্দেশ্য, সরকারের বিপরীতে কিছু একটা করা। তাই বলে কিছু উদ্দেশ্য সন্ধানী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারণে গোটা দেশবাসীর আবেগ ও অধিকার খর্ব করা যায় না। দেশের সব নাগরিক অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন, তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, বংশধরদের সেভাবে তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে। ব্যতিক্রমটাকেই সার্বিক ভেবে এমন বিধান জারি করা কি আদৌ সমীচীন বলে মনে হয়েছে আপনাদের? কিছু প্রতিষ্ঠান এমন কাজ করতে পারে, তাদের সতর্ক করে দেওয়া যায়। সব সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক, সংস্থা, সংগঠনকে ওদের সঙ্গে এক কাতারে ফেললে চলবে না।... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো তাঁর আমলেই 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র'-এর উদ্যোগী-সাহসী ১০ জনকে পুরস্কৃত করার সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সরকারও বিবেচনায় নেয়নি। কেন? সেদিন যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রগতিশীল বেতারকর্মী এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের প্রতি কতটা কর্তব্য আমরা পালন করতে পেরেছি? ইতিমধ্যে তাঁদের ১০ জনের মধ্যে চারজনই মারা গেছেন, চারজন গুরুতর অসুস্থ, তার পরও কি তাঁদের সম্মান জানাতে পেরেছি সরকারিভাবে? তাঁদের একজনকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়েছে, অথচ চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে ট্রান্সমিটার উঠিয়ে যে তরুণ ও সহযোগীরা অন্য জায়গায় বসিয়ে প্রচার অব্যাহত রেখেছিলেন, তাঁদের কি সম্মান দিয়েছে সরকার বা রাষ্ট্র?
সামরিক বাহিনীর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কৃতিত্বের জন্য নানা ধরনের খেতাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে যাঁরা দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কি কোনো সম্মানে ভূষিত করেছে সরকার? তাঁরা কি খোলামকুচি? মুক্তিযুদ্ধ তো একদিন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এ তো দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল। দু-চারজনের মাথায় যে ওই আদর্শিক চেতনা ছিল না, তা বলব না। তাঁদের কেউ কেউ পাকিস্তানি দাসত্বের নিগঢ় থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা সেনাবাহিনীতে থেকেও করতেন। যেমন তাহের, মঞ্জুর, খালেদ তো বটেই। এমনকি কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অবসরে গিয়েও। তাঁরা ব্যতিক্রম। বহু অফিসারও ছিলেন তাঁদের মতো। কিন্তু সবাই ছিলেন না। সেটা তো ক্যু-পাল্টা ক্যু থেকেই সহজে অনুমেয়।
এসব বিবেচনা করে দেখলে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধকালের আন্তরিকতা, আনুগত্য, সাহসিকতা ইত্যাদি কিন্তু সব ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়নি এই সম্মাননা দেওয়ার প্রশ্নে। সেখানে যদি কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করে, তাতে আপত্তি কেন? নাম অনুমোদন করতে হবে কেন? এ তো সেই পাকিস্তান আমলের নিয়মের মতো। শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব- এমন সব নামেও যদি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি কোনো পুরস্কার-সম্মাননা দিতে চায় কাউকে, তাতে আপত্তি করার কী আছে? এ তার মৌলিক অধিকার, এটা রাষ্ট্রীয় সংবিধান দিয়েছে, একে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে কর্তন বা খর্ব করতে পারে না। হ্যাঁ, নির্দিষ্টভাবে কোনো জাতীয় পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক- এমন কোনো পুরস্কারের একই নামে কোনো সচেতন নাগরিক বা দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান-সংগঠন কোনো পুরস্কার প্রবর্তন করবে বলে মনে হয় না। সরকারের মধ্যে এই ধারণা কেন হলো, বুঝতে পারলাম না। মানুষ যখন নিগৃহীত, উপেক্ষিত; তখন যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে- বরেণ্য, কীর্তিমান, স্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া নয়, উৎসাহিত করা সরকারের উচিত।
সরকার কেন ভাবছে, তারা যে নির্দেশ দিয়ে যাবে, তা-ই থাকবে, অন্য কেউ এলে এর ব্যবহার 'কুৎসিতভাবে' সরকারি পর্যায়েও তো হতে পারে। এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার বা সংশোধিত আকারে প্রচার করা উচিত।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
প্রকাশিত সংবাদটিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে। জারি করা প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকার প্রদত্ত কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা অথবা পদকের নাম যেন সরকার প্রদত্ত নামের অনুরূপ না হয়। আবার বলা হয়েছে, পুরস্কার, পদক ও সম্মাননার নাম নির্ধারণের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নাম অনুমোদন করাতে হবে। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা পুরস্কার বা সম্মাননা দেবেন, তাঁদেরও নাম নাকি তাঁদের দেওয়া সম্মাননাতে উল্লেখ করতে হবে। এসব সরকারি নির্দেশ অমান্য করা হলে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এ ধরনের পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তি সরকারি আদলে এমনকি একই নামে এই পদক, পুরস্কার বা সম্মাননা যেন না দেওয়া হয়, তার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।... খুব ভালো কথা। এ ধরনের নির্দেশনা অনেক আগেই বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকারের দেওয়া উচিত ছিল। তা তারা দেয়নি। এখন কেন হঠাৎ করে টনক নড়ল, এর রহস্য বুঝতে পারছি না।
মান্যবর সরকার এবং আমলাতন্ত্র, আপনাদের কাছে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, তা হলো- জাতীয় সংগীত। আমরা জাতীয় সংগীত যেভাবে গাই, তা কি আদৌ সংগ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যার যেমন খুশি গেয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এই যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবমাননা, এটা বর্তমান সরকারও বুঝতে চাইছে না কেন? মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পার হয়ে গেছে, জাতীয় সংগীতের সুর আজও শুদ্ধতার সঙ্গে গাওয়া হয় না। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর আমলে একটি সুর এবং তার স্বরলিপিও সরকারের অনুমোদিত হয়েছিল, সেটি গেল কোথায়? সরকার কি অনুগ্রহ করে সেই স্বরলিপিভিত্তিক জাতীয় সংগীত সর্বত্র গাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে না? কেবল সরকারি অনুষ্ঠান বাণীবদ্ধ বা বাহিনী ব্যান্ডে যা বাজানো হয়, তা-ই শুদ্ধ হলে তো হবে না, সাধারণ মানুষ গাইবে এ গান। এ তো জাতীয় সংগীত। শিল্পী নন যাঁরা, তাঁরাও গাইবেন এ গান। এর শুদ্ধতা নিশ্চিত করা কিন্তু প্রয়োজন সবার আগে। অথচ ৪০ বছরেও তা নির্দিষ্ট হয়নি, এমনকি কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মোৎসবেও নয়।
একটি জাতির গর্ব ও পরিচয়ের সুরধ্বনি জাতীয় সংগীত। ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতনির্বিশেষে যে গানটি গাইতে হয়। যার জন্ম হয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, তার সঠিক সুর কেন মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সরকার নির্ধারণ করবে না? অন্যদের কাছে তো জনগণ আশাই করে না। কেবল সরকার শুদ্ধ সুর বানাচ্ছে বা গাওয়াচ্ছে, সে কথা বললে তো চলবে না। এ গান সবাইকে গাইতে হবে। স্কুল, কলেজ কিংবা জেলা, উপজেলা- সর্বত্র নানা অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত অবশ্যই গাইতে হয়। এ শুদ্ধতা সে কারণে আরো বেশি প্রয়োজন।
জাতীয় সংগীতের শুদ্ধ সুর নির্ধারিত থাকলে, তার ভিত্তিতে শিল্পকলা একাডেমী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সঠিক ও শুদ্ধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সর্বত্র জাতীয় সংগীত একইভাবে গাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এর ব্যত্যয়ের অর্থ জাতিকে অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রাহ্য করা। এর যথার্থ মর্যাদা বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন, 'জাতীয় সংগীত' হিসেবে 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে নির্ধারণ করে। আমরা কেন অনীহা কিংবা গাফিলতি দেখাচ্ছি জাতীয় সংগীতের প্রতি? এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পদক, পুরস্কার ও সম্মাননার নামকরণ, সরকারি অনুমোদন কি খুব বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা? দেশে বোধ হয় সাধারণ নিয়মের বিধানই আছে, সরকারি নামকরণে আসলে কোনো প্রতিষ্ঠানেরও নাম রাখা যায় না। সাধারণত সাধারণ মানুষও এ কথা জানে। তারা কিন্তু এমন ভুল খুব একটা করে না। করেন যাঁরা, তাঁদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। অথবা তাঁদের উদ্দেশ্য, সরকারের বিপরীতে কিছু একটা করা। তাই বলে কিছু উদ্দেশ্য সন্ধানী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারণে গোটা দেশবাসীর আবেগ ও অধিকার খর্ব করা যায় না। দেশের সব নাগরিক অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন, তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, বংশধরদের সেভাবে তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে। ব্যতিক্রমটাকেই সার্বিক ভেবে এমন বিধান জারি করা কি আদৌ সমীচীন বলে মনে হয়েছে আপনাদের? কিছু প্রতিষ্ঠান এমন কাজ করতে পারে, তাদের সতর্ক করে দেওয়া যায়। সব সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক, সংস্থা, সংগঠনকে ওদের সঙ্গে এক কাতারে ফেললে চলবে না।... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো তাঁর আমলেই 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র'-এর উদ্যোগী-সাহসী ১০ জনকে পুরস্কৃত করার সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সরকারও বিবেচনায় নেয়নি। কেন? সেদিন যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রগতিশীল বেতারকর্মী এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের প্রতি কতটা কর্তব্য আমরা পালন করতে পেরেছি? ইতিমধ্যে তাঁদের ১০ জনের মধ্যে চারজনই মারা গেছেন, চারজন গুরুতর অসুস্থ, তার পরও কি তাঁদের সম্মান জানাতে পেরেছি সরকারিভাবে? তাঁদের একজনকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়েছে, অথচ চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে ট্রান্সমিটার উঠিয়ে যে তরুণ ও সহযোগীরা অন্য জায়গায় বসিয়ে প্রচার অব্যাহত রেখেছিলেন, তাঁদের কি সম্মান দিয়েছে সরকার বা রাষ্ট্র?
সামরিক বাহিনীর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কৃতিত্বের জন্য নানা ধরনের খেতাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে যাঁরা দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কি কোনো সম্মানে ভূষিত করেছে সরকার? তাঁরা কি খোলামকুচি? মুক্তিযুদ্ধ তো একদিন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এ তো দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল। দু-চারজনের মাথায় যে ওই আদর্শিক চেতনা ছিল না, তা বলব না। তাঁদের কেউ কেউ পাকিস্তানি দাসত্বের নিগঢ় থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা সেনাবাহিনীতে থেকেও করতেন। যেমন তাহের, মঞ্জুর, খালেদ তো বটেই। এমনকি কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অবসরে গিয়েও। তাঁরা ব্যতিক্রম। বহু অফিসারও ছিলেন তাঁদের মতো। কিন্তু সবাই ছিলেন না। সেটা তো ক্যু-পাল্টা ক্যু থেকেই সহজে অনুমেয়।
এসব বিবেচনা করে দেখলে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধকালের আন্তরিকতা, আনুগত্য, সাহসিকতা ইত্যাদি কিন্তু সব ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়নি এই সম্মাননা দেওয়ার প্রশ্নে। সেখানে যদি কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করে, তাতে আপত্তি কেন? নাম অনুমোদন করতে হবে কেন? এ তো সেই পাকিস্তান আমলের নিয়মের মতো। শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব- এমন সব নামেও যদি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি কোনো পুরস্কার-সম্মাননা দিতে চায় কাউকে, তাতে আপত্তি করার কী আছে? এ তার মৌলিক অধিকার, এটা রাষ্ট্রীয় সংবিধান দিয়েছে, একে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে কর্তন বা খর্ব করতে পারে না। হ্যাঁ, নির্দিষ্টভাবে কোনো জাতীয় পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক- এমন কোনো পুরস্কারের একই নামে কোনো সচেতন নাগরিক বা দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান-সংগঠন কোনো পুরস্কার প্রবর্তন করবে বলে মনে হয় না। সরকারের মধ্যে এই ধারণা কেন হলো, বুঝতে পারলাম না। মানুষ যখন নিগৃহীত, উপেক্ষিত; তখন যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে- বরেণ্য, কীর্তিমান, স্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া নয়, উৎসাহিত করা সরকারের উচিত।
সরকার কেন ভাবছে, তারা যে নির্দেশ দিয়ে যাবে, তা-ই থাকবে, অন্য কেউ এলে এর ব্যবহার 'কুৎসিতভাবে' সরকারি পর্যায়েও তো হতে পারে। এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার বা সংশোধিত আকারে প্রচার করা উচিত।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments