কসোভোর কথা by ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর
২০১২-এর জুলাই ২ থেকে ৫ পর্যন্ত আমি ও সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল ইউরোপের বলকান এলাকার কসভো প্রজাতন্ত্র ব্যক্তিগত পরিবৃত্তে সফর করি। কসভো ১০৯০৮ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের একটি ভূমিবদ্ধ ছোট দেশ। পূর্ব ইউরোপের দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় এর অবস্থান।
এর চারদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা; দক্ষিণে ম্যাসিডোনিয়া, পশ্চিমে আলবেনিয়া, উত্তর-পূর্বে মন্টিনেগ্রো এবং পূর্বে সার্বিয়া। ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত। দক্ষিণ-পশ্চিমে কসভো সমতল এবং উত্তর-পূর্বে ভুকাজিনী উপত্যকা। শ্বেত ড্রিন নদী কসভোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আড্রিয়াটিক সাগরে নেমে গেছে। ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এটি একটি পৃথক রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে অস্তিত্বমান। কসভোর বর্তমান লোকসংখ্যা ১.৮ মিলিয়ন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯৩% ইসলাম ধর্মাবলম্বী, ভাষা সর্বাংশে আলবেনিয়ান। সমকালীন মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ৬৬০০ ডলার। দেশটি কয়লা ও লিগনাইটসহ মূল্যবান খনিজে সম্পদশালী। কৃষিকাজ বিস্তৃত ও আধুনিকায়িত। দেশের ৫২% ভূমি কৃষিতে প্রযুক্ত এবং ৩৯% বনায়িত। প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য গম, ভুট্টা, আঙ্গুর ও অন্যান্য নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফলফলাদি। রেলপথ ও সড়কপথ দিয়ে দেশটি পার্শ্ববর্তী সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও আলবেনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। কসভোর কোন সমুদ্র উপকূল নেই। আলবেনিয়ার তিরানা এর আমদানি-রফতানির মূল বন্দর হিসেবে কাজ করে আসছে। কসভোর রাজধানী প্রিস্টিনা থেকে সড়ক পথে তিরানা যেতে ঘণ্টা দু’য়েক লাগে। আলবেনিয়ার সঙ্গে কসভোর সম্পর্ক ভ্রাতৃসম। বর্তমানে আলবেনিয়ার তিরানার (বন্দর) সঙ্গে প্রিস্টিনার (রাজধানী) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী প্রেজিরিনার সড়ক যোগাযোগ উন্নত ও বিস্তৃত করার কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে।
মধ্যযুগে দার্দানিয়া এলাকা কসভো নামে পরিচিত ছিল। কসভোর জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আলবেনীয় জাতি-উপজাতি উদ্ভুত। সার্বদের সঙ্গে সময়ান্তরীণ জাতিগত বিবাদ ও সংঘর্ষের মাঝে কিয়দংশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সার্বরা এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৮৭৭-১৯১২ সালে তুর্কীরা কসভো ভিলায়েত নামে এই এলাকা শাসন করেছিল। তুর্কী সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ করে ১৯১৮ সালে পত্তন হয় যুগোসøাভিয়ার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রথমে ইতালিয়ানরা ও পরে জার্মানরা কসভো এলাকা দখল করে রাখে। এর পরে মার্শাল টিটুর নেতৃত্বে কসভো সমাজতান্ত্রিক যুগোসøাভিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। মার্শাল টিটু সার্বদের মাধ্যমে আলবেনীয় বংশোদ্ভূত কসোভারদের দৃঢ় শাসনের শিকলে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে যান। মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর যুগোসøাভিয়া দ্রুত একক ও অভিন্ন দেশ হিসেবে ভেঙ্গে যেতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে কসভো এলাকায় পাশের এলাকার সার্বরা প্রাধান্য ও প্রভুত্ব অর্জন এবং বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। সার্বদের নেতা সোলবদান মিলেনসেভিচ ১৯৮৯ সালে কসভোর জনগণের ওপর সাম্প্রদায়িক শুদ্ধি অভিযানের মোড়কে অত্যাচার ও নির্যাতনের হীন প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে আসেন। সার্বদের এরূপ হীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কসভোর জনগণ প্রথমে অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং পরে (আলবেনীয় বংশোদ্ভূত) অস্ত্র ধারণ করেন। এই সংগ্রামে রাশিয়া সার্বদের সমর্থন করে। ১৯৯০ সালে কসভো স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিগত সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেটনে সম্পাদিত এক চুক্তির আওতায় বসনিয়ান যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু কসভোতে কসভারদের সঙ্গে সার্বদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ কসভোর জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। ১৯৯৯-এর জুনে এই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জাতিসংঘের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশের তরফ থেকেও শান্তি রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী (১২৫ জন) কসভোতে ৯ মাস ধরে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে। মিত্রভিকা এলাকায় বাঙালী পুলিশ বাহিনীর অদম্য সাহস ও কর্তব্যনিষ্ঠা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করে। ফলত কসভোর কতিপয় এলাকার সার্ব আগ্রাসীরা কসভোর স্থানীয় জনসাধারণের ওপর শাসন ও প্রভূত্বের করদ চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত পুলিশ বাহিনী কসভোর জনগণকে রক্ষা করার জন্য বীরত্বপূর্ণ, ফলপ্রসূ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়। শেষ পর্যায়ে ন্যাটোর মোড়কে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতিতে (২৪ মার্চ ১৯৯৯) রুশ সাহায্যপুষ্ট সার্ব বাহিনী কসভো থেকে হটে যেতে বাধ্য হয় এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কসভো পৃথক দেশ হিসেবে (১৯৯৯-এর ১২ জুন) তারিখে আত্মপ্রকাশ করে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কসভোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারিক আদালত ২০১০ সালের ২২ জুলাই কসভোর স্বাধীনতা ঘোষণাকে সমর্থনীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। এখন পর্যন্ত কসভোকে রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ৯১টি দেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ রাষ্ট্র কসভোকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করেছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া কসভোকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়া ও চীন কসভোকে এরূপ স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত না দিলেও তারা পার্শ্ববর্তী স্বীকৃত দেশ থেকে কসভোতে বাণিজ্য অফিস পরিচালনা করছে। কসভোর বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো আলবেনীয়া। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো রাশিয়া। তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো চীন। ভারত ও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কসভোকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তথাপি আলবেনিয়া ও তুরস্কের মাধ্যমে কসভোতে ভারতীয় পণ্যসামগ্রী রফতানি হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে কসভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সে দেশে তাদের কার্যক্রম প্রযুক্ত করেছে।
আমরা কসভোতে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে (১) বাণিজ্য বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রধান মন্ত্রী (বেহেজগেত পাকোলী), পার্লামেন্টের স্পীকার (ড. জাকুপ ক্রাশনিকি) ও পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান (আলবীন কুরেতী), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী (পেট্রি সেলিমী) এবং প্রিজিরিনার (কসভোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর) মেয়রের (অধ্যাপক রামাদান মোজা) সঙ্গে দেখা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। তেমনি বাণিজ্য প্রসারণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে কসভোর শিল্প ও বাণিজ্য সংঘের প্রধান (সাফেত জেরাকসালিও) এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে। আমরা কসভোর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নায়ক আদম জাশেরী ও তার ২২ সদস্যের পরিবারের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে (প্রিজিরিনা) অবারিত নীল আকাশের পটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী জনগণের শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করেছি।
কসভোর স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক আদম জাশেরী শত্রুর মোকাবেলায় নিশ্চিত মৃত্যুকে সামনে রেখে তার সহযোগী ও সংগ্রামী দেশবাসীকে বলেছিলেন ‘এখন হলো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়’। সর্বকালে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামের প্রতীতিভিত্তিক উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটেছে আদম জাশেরীর এই ভয়-বিজয়ী উচ্চারণ। প্রিস্টিনার বিমানবন্দরকে আদম জাশেরীর নামে নামকরণ করে কসভোর জনসাধারণ এই ভয়-বিজয়ী উচ্চারণকে সে দেশের সকল মানুষের পথে ধরে রাখতে চেয়েছেন। একই উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কসভোর নাগরিকগণ তুর্কী সাম্প্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক শতাব্দী আগে সংগ্রাম করেছিলেন। ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আব্দিল ফরাসিরি এবং পরে সুলেজমান হকসি স্বাধীনচেতা কসভো এলাকার আলবেনীয় বা কসভারদের তরফ থেকে স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণকে আদর্শিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সুলেজমান হকসির দল ১৮৭৮ সালে কসভোর তৎকালীন তুর্কী শাসক মেহমেত আলী পাশাকে হত্যা করেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর কসভোতে তুর্কী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু স্বাধীন সত্তায় বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে কসভারদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। সার্ব নেতা মিলোসেভিচ কর্তৃক আরোপিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কসভারদের সংগ্রামের ইতিহাসে এই স্বাধীন সত্তার বিকশিত হওয়ার সামষ্টিক আর্তি ধ্বনিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালের মে থেকে সাবেক যুগোসøাভিয়ার আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালত (এ দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদলে দেড় যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত) কসভো যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ হাতে নিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় ৯ জন সার্বিয়ান ও যুগোসøাভ নেতা ও সেনানায়কদের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক যুগোসøাভ প্রেসিডেন্ট কসভোর কসাই নামে কুখ্যাত সালবোদান মিলোসেভিচ। এদের মধ্যে ৫ জনকে ১৫ থেকে ২৭ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে, একজন আত্মহত্যা করেছে এবং মিলোসেভিচ বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এদের বিরুদ্ধে ১ থেকে ৯৩ বছরের ৯১৯ জন কসভারকে হত্যা করার দায় উত্থাপিত হয়েছিল।
অন্যদিকে কসভো এলাকায় সম্প্রদায়গত সহিংসতাকে পুঁজি করে মানব অঙ্গ আহরণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। নির্যাতিত ও অসহায় শিশু ও নারীদের ভিন্নতর শরীরে প্রতিস্থাপনীয় অঙ্গাদি সহিংসতার মাধ্যমে সংস্থাপন করে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পাচার করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি জেলে অন্তরীণাবদ্ধ যুবক-যুবতীরাও এই তথাকথিত মানব অঙ্গের ফসল কাটার অসভ্য প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পায়নি। অভিযোগ রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাও এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কসভোর গৃহযুদ্ধের সময় এই মানব অঙ্গকে ফসল হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ থেকে কোন পক্ষই মুক্ত ছিলেন না বলে বলা হয়েছে। এই জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদালতে চিকিৎসকসহ ৭ ব্যক্তির বিচার চলছে। অভিযোগে এও প্রকাশ পেয়েছে যে, নির্যাতিতকে জীবিত রেখে তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে এই ধরনের অমানবিক ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। এই ব্যবসায়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে কসভোর নিরপরাধ ও অসহায় যুবতীদের ঠেলে দেয়ার অভিযোগ স্থান পেয়েছে।
কসভো থেকে ফিরে এসে তিনটি বিষয়ে সচেতনতা আমাদের দু’জনের অনুভূতিকে শাণিত করেছে। এক, জাতীয় স্বাতন্ত্র্যর চেতনা এবং এ চেতনা উৎসারিত স্বাধীনতার সংগ্রাম জাতিকে সব দেশেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। এ চেতনা বোধই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অগ্রণী ও বিজয়ী হতে সন্দিপীত করেছে। এ চেতনা বোধই কালক্রমে আমাদেরকে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি অর্জন করার পথে নিয়ে যাবে ও জয়ী করবে। দুই, অত্যাচার, নির্যাতন ও সন্ত্রাস দিয়ে কোন জাতির স্বাতন্ত্র্য বোধকে দমিয়ে রাখা যায় না। কসভারদিগের ওপর ক্রমান্বয়ে তুর্কী, সার্ব ও নাৎসীদের অত্যাচার ও নির্যাতন তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, যেমন পারেনি ২৩ বছর ধরে আমাদেরকে দমিয়ে রাখতে পাকিস্তানীদের অত্যাচার ও নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের চিরন্তনী কথা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’ আমাদেরকে ১৯৭১-এর পরবর্তী সময়ে কসভোর জনগণের রক্তাক্ত ত্যাগের পূর্বে ও সমসারি করে আমাদের মানুষকে জন্ম থেকে জন্মে প্রদীপ্ত রাখে। তিন, কসভোতে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সকল তদন্ত ও দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার বিচার ও শাস্তি প্রদান আমাদেরকেও এ দেশের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের শনাক্ত ও বিচার করার সর্বজনীন আইনের ভিত্তিতে স্বীকৃত অধিকার ও দায়িত্ব দুইই প্রদান করে। স্মর্তব্য, দেড় যুগেরও আগে কসভো এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারার্থে আন্তর্জাতিক আদালত স্থাপন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানে (২৫ অনুচ্ছেদ) আমাদেরকে জাতি হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র মানবাধিকার সংরক্ষণ ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া আছে। এই দায়িত্ব সম্পাদনকালে মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে সংঘটিত অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। কসভোর আদম জাশেরীর স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ উৎসারিত উক্তি দুঃসময় ও দুঃশাসন পরাজিত করার লক্ষ্যে চরম ত্যাগস্বীকার এমন কি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমাদেরকেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী দুঃশাসন ও স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রতিকূলে চিরায়ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিকতার গৌরব অর্জন ও রক্ষাকরণে একনিষ্ঠ ও অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের পথে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রেরণা জোগায়।
লেখক : মাননীয় মন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মধ্যযুগে দার্দানিয়া এলাকা কসভো নামে পরিচিত ছিল। কসভোর জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আলবেনীয় জাতি-উপজাতি উদ্ভুত। সার্বদের সঙ্গে সময়ান্তরীণ জাতিগত বিবাদ ও সংঘর্ষের মাঝে কিয়দংশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সার্বরা এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৮৭৭-১৯১২ সালে তুর্কীরা কসভো ভিলায়েত নামে এই এলাকা শাসন করেছিল। তুর্কী সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ করে ১৯১৮ সালে পত্তন হয় যুগোসøাভিয়ার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রথমে ইতালিয়ানরা ও পরে জার্মানরা কসভো এলাকা দখল করে রাখে। এর পরে মার্শাল টিটুর নেতৃত্বে কসভো সমাজতান্ত্রিক যুগোসøাভিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। মার্শাল টিটু সার্বদের মাধ্যমে আলবেনীয় বংশোদ্ভূত কসোভারদের দৃঢ় শাসনের শিকলে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে যান। মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর যুগোসøাভিয়া দ্রুত একক ও অভিন্ন দেশ হিসেবে ভেঙ্গে যেতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে কসভো এলাকায় পাশের এলাকার সার্বরা প্রাধান্য ও প্রভুত্ব অর্জন এবং বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। সার্বদের নেতা সোলবদান মিলেনসেভিচ ১৯৮৯ সালে কসভোর জনগণের ওপর সাম্প্রদায়িক শুদ্ধি অভিযানের মোড়কে অত্যাচার ও নির্যাতনের হীন প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে আসেন। সার্বদের এরূপ হীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কসভোর জনগণ প্রথমে অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং পরে (আলবেনীয় বংশোদ্ভূত) অস্ত্র ধারণ করেন। এই সংগ্রামে রাশিয়া সার্বদের সমর্থন করে। ১৯৯০ সালে কসভো স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিগত সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেটনে সম্পাদিত এক চুক্তির আওতায় বসনিয়ান যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু কসভোতে কসভারদের সঙ্গে সার্বদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ কসভোর জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। ১৯৯৯-এর জুনে এই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জাতিসংঘের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশের তরফ থেকেও শান্তি রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী (১২৫ জন) কসভোতে ৯ মাস ধরে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে। মিত্রভিকা এলাকায় বাঙালী পুলিশ বাহিনীর অদম্য সাহস ও কর্তব্যনিষ্ঠা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করে। ফলত কসভোর কতিপয় এলাকার সার্ব আগ্রাসীরা কসভোর স্থানীয় জনসাধারণের ওপর শাসন ও প্রভূত্বের করদ চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত পুলিশ বাহিনী কসভোর জনগণকে রক্ষা করার জন্য বীরত্বপূর্ণ, ফলপ্রসূ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়। শেষ পর্যায়ে ন্যাটোর মোড়কে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতিতে (২৪ মার্চ ১৯৯৯) রুশ সাহায্যপুষ্ট সার্ব বাহিনী কসভো থেকে হটে যেতে বাধ্য হয় এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কসভো পৃথক দেশ হিসেবে (১৯৯৯-এর ১২ জুন) তারিখে আত্মপ্রকাশ করে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কসভোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারিক আদালত ২০১০ সালের ২২ জুলাই কসভোর স্বাধীনতা ঘোষণাকে সমর্থনীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। এখন পর্যন্ত কসভোকে রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ৯১টি দেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ রাষ্ট্র কসভোকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করেছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া কসভোকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়া ও চীন কসভোকে এরূপ স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত না দিলেও তারা পার্শ্ববর্তী স্বীকৃত দেশ থেকে কসভোতে বাণিজ্য অফিস পরিচালনা করছে। কসভোর বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো আলবেনীয়া। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো রাশিয়া। তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যের অংশীদার রাষ্ট্র হলো চীন। ভারত ও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কসভোকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তথাপি আলবেনিয়া ও তুরস্কের মাধ্যমে কসভোতে ভারতীয় পণ্যসামগ্রী রফতানি হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে কসভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সে দেশে তাদের কার্যক্রম প্রযুক্ত করেছে।
আমরা কসভোতে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে (১) বাণিজ্য বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রধান মন্ত্রী (বেহেজগেত পাকোলী), পার্লামেন্টের স্পীকার (ড. জাকুপ ক্রাশনিকি) ও পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান (আলবীন কুরেতী), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী (পেট্রি সেলিমী) এবং প্রিজিরিনার (কসভোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর) মেয়রের (অধ্যাপক রামাদান মোজা) সঙ্গে দেখা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। তেমনি বাণিজ্য প্রসারণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে কসভোর শিল্প ও বাণিজ্য সংঘের প্রধান (সাফেত জেরাকসালিও) এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে। আমরা কসভোর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নায়ক আদম জাশেরী ও তার ২২ সদস্যের পরিবারের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে (প্রিজিরিনা) অবারিত নীল আকাশের পটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী জনগণের শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করেছি।
কসভোর স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক আদম জাশেরী শত্রুর মোকাবেলায় নিশ্চিত মৃত্যুকে সামনে রেখে তার সহযোগী ও সংগ্রামী দেশবাসীকে বলেছিলেন ‘এখন হলো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়’। সর্বকালে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামের প্রতীতিভিত্তিক উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটেছে আদম জাশেরীর এই ভয়-বিজয়ী উচ্চারণ। প্রিস্টিনার বিমানবন্দরকে আদম জাশেরীর নামে নামকরণ করে কসভোর জনসাধারণ এই ভয়-বিজয়ী উচ্চারণকে সে দেশের সকল মানুষের পথে ধরে রাখতে চেয়েছেন। একই উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কসভোর নাগরিকগণ তুর্কী সাম্প্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক শতাব্দী আগে সংগ্রাম করেছিলেন। ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আব্দিল ফরাসিরি এবং পরে সুলেজমান হকসি স্বাধীনচেতা কসভো এলাকার আলবেনীয় বা কসভারদের তরফ থেকে স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণকে আদর্শিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সুলেজমান হকসির দল ১৮৭৮ সালে কসভোর তৎকালীন তুর্কী শাসক মেহমেত আলী পাশাকে হত্যা করেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর কসভোতে তুর্কী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু স্বাধীন সত্তায় বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে কসভারদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। সার্ব নেতা মিলোসেভিচ কর্তৃক আরোপিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কসভারদের সংগ্রামের ইতিহাসে এই স্বাধীন সত্তার বিকশিত হওয়ার সামষ্টিক আর্তি ধ্বনিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালের মে থেকে সাবেক যুগোসøাভিয়ার আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালত (এ দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদলে দেড় যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত) কসভো যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ হাতে নিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় ৯ জন সার্বিয়ান ও যুগোসøাভ নেতা ও সেনানায়কদের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক যুগোসøাভ প্রেসিডেন্ট কসভোর কসাই নামে কুখ্যাত সালবোদান মিলোসেভিচ। এদের মধ্যে ৫ জনকে ১৫ থেকে ২৭ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে, একজন আত্মহত্যা করেছে এবং মিলোসেভিচ বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এদের বিরুদ্ধে ১ থেকে ৯৩ বছরের ৯১৯ জন কসভারকে হত্যা করার দায় উত্থাপিত হয়েছিল।
অন্যদিকে কসভো এলাকায় সম্প্রদায়গত সহিংসতাকে পুঁজি করে মানব অঙ্গ আহরণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। নির্যাতিত ও অসহায় শিশু ও নারীদের ভিন্নতর শরীরে প্রতিস্থাপনীয় অঙ্গাদি সহিংসতার মাধ্যমে সংস্থাপন করে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পাচার করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি জেলে অন্তরীণাবদ্ধ যুবক-যুবতীরাও এই তথাকথিত মানব অঙ্গের ফসল কাটার অসভ্য প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পায়নি। অভিযোগ রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাও এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কসভোর গৃহযুদ্ধের সময় এই মানব অঙ্গকে ফসল হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ থেকে কোন পক্ষই মুক্ত ছিলেন না বলে বলা হয়েছে। এই জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদালতে চিকিৎসকসহ ৭ ব্যক্তির বিচার চলছে। অভিযোগে এও প্রকাশ পেয়েছে যে, নির্যাতিতকে জীবিত রেখে তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে এই ধরনের অমানবিক ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। এই ব্যবসায়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে কসভোর নিরপরাধ ও অসহায় যুবতীদের ঠেলে দেয়ার অভিযোগ স্থান পেয়েছে।
কসভো থেকে ফিরে এসে তিনটি বিষয়ে সচেতনতা আমাদের দু’জনের অনুভূতিকে শাণিত করেছে। এক, জাতীয় স্বাতন্ত্র্যর চেতনা এবং এ চেতনা উৎসারিত স্বাধীনতার সংগ্রাম জাতিকে সব দেশেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। এ চেতনা বোধই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অগ্রণী ও বিজয়ী হতে সন্দিপীত করেছে। এ চেতনা বোধই কালক্রমে আমাদেরকে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি অর্জন করার পথে নিয়ে যাবে ও জয়ী করবে। দুই, অত্যাচার, নির্যাতন ও সন্ত্রাস দিয়ে কোন জাতির স্বাতন্ত্র্য বোধকে দমিয়ে রাখা যায় না। কসভারদিগের ওপর ক্রমান্বয়ে তুর্কী, সার্ব ও নাৎসীদের অত্যাচার ও নির্যাতন তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, যেমন পারেনি ২৩ বছর ধরে আমাদেরকে দমিয়ে রাখতে পাকিস্তানীদের অত্যাচার ও নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের চিরন্তনী কথা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’ আমাদেরকে ১৯৭১-এর পরবর্তী সময়ে কসভোর জনগণের রক্তাক্ত ত্যাগের পূর্বে ও সমসারি করে আমাদের মানুষকে জন্ম থেকে জন্মে প্রদীপ্ত রাখে। তিন, কসভোতে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সকল তদন্ত ও দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার বিচার ও শাস্তি প্রদান আমাদেরকেও এ দেশের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের শনাক্ত ও বিচার করার সর্বজনীন আইনের ভিত্তিতে স্বীকৃত অধিকার ও দায়িত্ব দুইই প্রদান করে। স্মর্তব্য, দেড় যুগেরও আগে কসভো এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারার্থে আন্তর্জাতিক আদালত স্থাপন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানে (২৫ অনুচ্ছেদ) আমাদেরকে জাতি হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র মানবাধিকার সংরক্ষণ ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া আছে। এই দায়িত্ব সম্পাদনকালে মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে সংঘটিত অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। কসভোর আদম জাশেরীর স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ উৎসারিত উক্তি দুঃসময় ও দুঃশাসন পরাজিত করার লক্ষ্যে চরম ত্যাগস্বীকার এমন কি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমাদেরকেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী দুঃশাসন ও স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রতিকূলে চিরায়ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিকতার গৌরব অর্জন ও রক্ষাকরণে একনিষ্ঠ ও অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের পথে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রেরণা জোগায়।
লেখক : মাননীয় মন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
No comments