উপমহাদেশ-নীতি নেই, দুর্নীতি আছে by অমিত বসু

সংস্কৃত শব্দে লোষ্ট্র মানে চোরাই মাল। এত ভারী শব্দ জিভের সহ্য হয়নি। গলতে গলতে লোত, তারপর লোত। সেখান থেকে হাতেনাতে। আজকাল হাতেনাতে কথাটার ব্যবহারও দুর্লভ। দোষটা শব্দের নয়, সিস্টেমের। দুর্নীতি হাতেনাতে ধরার সাধ্য কার।


চুরির পর বুদ্ধি বাড়ে। তদন্ত কমিটির টনক নড়ে। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের ডায়ালগ কপি করে বলে, চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, চোর চাই, চোর চাই, চোর পাওয়া অত সহজ নয়। চোরকে চিনলেও প্রমাণ ছাড়া কাউকে চোর সাব্যস্ত করা যায় কি? চন্দ্রগুপ্তের অর্থমন্ত্রী চাণক্য বলেছিলেন, মন্ত্রীরা অর্থের দরিয়ায় মাছের মতো সাঁতার কাটে। পানি তো খাবেই। কখন খাচ্ছে তাও বোঝা অসম্ভব। তার চেয়ে দেখ, মন্ত্রী কতটা কাজের। সৎ-দক্ষ লোক পেলে ভালো। না পেলে অসৎ দক্ষ লোক দিয়ে কাজ চালাতে হবে। একমাত্র অসৎ-অদক্ষদের ঘাড় ধরে তাড়ানো দরকার। চাণক্যনীতি একালেও বাতিল হয়নি। বিশেষ করে রাজনীতিতে অসৎ দক্ষ লোকের জায়গার অভাব হয় না। তফাত একটাই। তখনকার রাজারা ইচ্ছা করলে চুরিচামারি ধামাচাপা দিতে পারতেন। এখনকার গণতন্ত্রে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা অসম্ভব। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া ছাড়বে কেন? সরকারকে শপথ করার দায়িত্ব তাদের। চোর গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া না পর্যন্ত নিস্তার নেই।
বিশ্বে এমন কোনো দেশ আছে কি, যেখানে দুর্নীতি নেই। আছে, সব দেশেই আছে। মাত্র কমবেশি হতে পারে। জাপানের মতো উন্নত দেশের কৃষিমন্ত্রীকেও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ বিচারে, দুর্নীতি কোনো রাষ্ট্রকেই রেয়াত করে না। শত প্রতিষেধকেও মশার মতো জেঁকে ধরে। মশক বংশ ধ্বংস করার মতোই দুর্নীতি রোধ দুরূহ। মশার কামড় আর দুর্নীতির দাঁত থেকে রেহাই পেতে আরও সতর্কতা নিলেও সফল হওয়া কঠিন।
সমস্যাটা আমেরিকাকে নিয়ে। তাদের ধারণা, দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব একমাত্র বাংলাদেশ-ভারতের মতো রাষ্ট্রের। সেখানে দুর্নীতির গন্ধ পেলেই লাফঝাঁপ শুরু করে। মিডিয়ার পোয়াবারো। 'নিউইয়র্ক টাইমস' ও 'ওয়াশিংটন পোস্ট'-এর প্রথম পাতায় রসিয়ে রসিয়ে সেই খবর। যেন অন্যায়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা সব ধোয়া তুলসী পাতা। বাংলাদেশের মুক্তির এক বছর পর ১৯৭২ সালে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা তারা ভুলে যায় কী করে! অভিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের কালো-করুণ মুখচ্ছবি কি তাদের মনে নেই? তারপর অজস্র দুর্নীতি দানা বেঁধেছে। টাকা-পয়সা তছরুপ শুধু নয়, যৌন কেলেঙ্কারিতেও তারা এগিয়ে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কর্ণধার যৌন অপরাধে অভিযুক্ত। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির কাহিনী এতদিনেও ফুরোয়নি। অত্যাচারিতায় মনিকা লিউনস্কি নতুন করে প্রতিশোধ নিতে চান। তাকে লেখা ক্লিনটনের প্রেমপত্র কাটছাঁট না করেই ছাপাচ্ছে মনিকা। তাতে সাবেক রাষ্ট্রপতিকে জব্দ করার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনও হবে আকাশছোঁয়া। প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম পেয়েছেন এক কোটি ১০ লাখ ডলার।
আমেরিকায় এটাই সুবিধা। ন্যায়-অন্যায় সবকিছুই বিক্রয়যোগ্য। অবাধে বাজারে বিকোয়। পকেট ভরে নিমেষে। শেষে টাকাতেই সব কাটাকুটি হয়ে যায়। ৫ সেপ্টেম্বর 'দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট' ৫২৩ শব্দের প্রতিবেদনে লিখল_ 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ট্র্যাজিক চরিত্র। বসে আছেন একটি চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের মাথায়।' ১০ দিন পর মনমোহন যখন মার্কিন সরকারের প্রস্তাবিত এফডিআই বা খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ মেনে নিলেন, মার্কিন মিডিয়ার সে কী উল্লাস। দুর্নীতির কলঙ্ক মুছে তাকে মহামান্য-মহাপুরুষ সাজাতে ব্যস্ত। আজ বলে নয়, মনমোহন বরাবরই সংস্কারপন্থি। ১৯৯২ সালে যখন নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী, মনমোহন তখন অর্থমন্ত্রী। কংগ্রেস সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। দুর্বল সরকারের প্রতিনিধি হয়েও সংস্কারের রাস্তা ছাড়েননি। বাজেটে ব্যাপক সংস্কারের ছাপ রেখেছিলেন। বিলম্বীকরণের মাত্রা বাড়িয়েছিলেন। লাভজনক সরকারি শিল্পকেও বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সংস্কারের সূত্র এটাই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাদ। সবটাই চলে যাক বাজারের হাতে। শিল্পপতিরা যা ভালো বুঝে তাই করুক। সরকার কিছু দেখবে না। শিল্প পরিচালনার অনেক ঝঞ্ঝাট। তার থেকে মুক্তি দরকার। জনমতের বিরোধিতায় অনেকটা এগিয়ে-পিছিয়ে আসতে হয়েছিল মনমোহনকে। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আবার সেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেন তিনি। আমেরিকার দাবি মেনে ১২৩ পরমাণু চুক্তি করেন তাদের সঙ্গে। বিরোধিতায় বাম শরিকরা সরকার ছাড়ে। অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সরকার বেঁচে যায়। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং ২০০৯ সালে। পাশে শরিক হিসেবে পান বামদের জায়গায় তৃণমূলকে।
সরকার সমর্থনের প্রশ্নে তৃণমূল আর বামফ্রন্টের নীতিগত পথ ছিল ভিন্ন। বামফ্রন্ট সাংসদরা মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। বাইরে থেকে সমর্থন করেছেন। তারা বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকাতেই কংগ্রেস সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন। সরকার জনবিরোধী কাজ করলে তার সঙ্গে থাকবেন না। বামদের চাপে বাজার অর্থনীতির রাস্তায় যেতে পারেনি কংগ্রেস। পরমাণু চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধে কংগ্রেস আর বামদের মধ্যে। বাম আপত্তি অস্বীকার করে কংগ্রেস চুক্তি সই করার সিদ্ধান্ত নিতেই বামফ্রন্ট কংগ্রেস সঙ্গ ত্যাগ করে।
এ প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিতে ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলায়। ভোটে বামফ্রন্টের ক্ষতি হয়। অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। কংগ্রেস অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় না করলেও তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে। ২০০৪ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের আসন ছিল মাত্র একটি। ২০০৯ সালে বামফ্রন্টবিরোধী হওয়ায় তারা পান ১৯টি আসন। সেটাও গতবারের বামফ্রন্টের চেয়ে অনেক কম। ২০০৪ সালে বামফ্রন্টের আসন ছিল ৬২। বামদের মন্ত্রিত্বের লোভ ছিল না। তৃণমূল মন্ত্রিত্বকেই পাখির চোখ করে এগোতে থাকে। দীর্ঘ দরকষাকষির পর রেল মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দখল করে। মনমোহন তাদের তিনটি পূর্ণ মন্ত্রীর পদ দিতে চেয়েছিলেন। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে রেলমন্ত্রী হয়ে বাকি ছয়টি প্রতিমন্ত্রীর পদ নেন। দলের অন্য কেউ পূর্ণ মর্যাদার মন্ত্রী হন তা তিনি চাননি।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে হারিয়ে তৃণমূল সরকার গঠন করে। রেল মন্ত্রিত্ব ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাতে যান তিনি। সর্বত্রই নো পাওয়ার প্রয়োগ করতে থাকেন। মনমোহনের সব কাজেই, না। তিস্তা চুক্তি? না। ছিটমহল সমাধান? না। এ বিরোধিতা বামফ্রন্টের কারও নীতিগত ছিল না। শুধু ছিল মনমোহনকে হেনস্তা করে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ফন্দি। রাজ্যে শিল্প নেই, কর্মসংস্থান বন্ধ। সর্বত্র অরাজকতা। তৃণমূলের মধ্যে তীব্র গোষ্ঠী কোন্দল। কলকাতা পৌরসভায় দুর্নীতির অভিযোগ। মমতার জনপ্রিয়তা ক্রমেই নিম্নগামী। বিপদ থেকে বাঁচতে, ভাবমূর্তি ফেরাতে কংগ্রেস বিরোধিতা। মনমোহন পেট্রো পণ্যে ভর্তুকি ছেঁটে, খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের পারমিট দিতেই মমতার হাতে চাঁদ। কংগ্রেসের সঙ্গ ছেড়ে তাদের বিরোধিতায় নামার পথ পরিষ্কার। বিষয়টা নীতির নয়, নিজেকে বাঁচানোর। মনমোহনের সিদ্ধান্ত উপলক্ষ মাত্র। নীতির নামে দুর্নীতি করে কংগ্রেসকে ফাঁসালেন মমতা। মনমোহন অন্য সমর্থন নিয়ে সরকার বাঁচালেন এবং মমতাকে চিনলেন নতুন করে।

অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.