এক বীরপ্রতীকের স্বপ্ন by কেয়া চৌধুরী

কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা হারিয়ে গেলে বোঝা যায় তার উপস্থিতি সময়ের দাবিতে কত প্রয়োজনীয়। মূল্যায়নের মাপকাঠিতে এমনই এক ব্যক্তি ছিলেন ইনামুল হক চৌধুরী (বীরপ্রতীক)। গত ১৬ সেপ্টেম্বর এক বছর পূর্ণ হলো তার চলে যাওয়ার।


সকলের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার। যতটা মনে পড়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা সিলেটে, কোনো একটা আলোচনা সভায়। মেজর জেনারেল সি আর দত্ত (বীরউত্তম) কাকা বাবার নাম ধরে (কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর মেয়ে) বলায় ইনামুল হক চাচা যেন চমকে গেলেন। প্রথম দেখায় একজন পরিচ্ছন্ন ও দরাজ মানুষ বলেই মনে হয়েছিল তাকে আমার। এরপর যতবার দেখেছি ততবার মুগ্ধ হয়েছি। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সংগঠনের বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে ইনামুল হক চৌধুরীর সাংগঠনিক ক্ষমতায় কত দক্ষ এক ব্যক্তি। নিজের চেনা-জানা মানুষগুলোর কাছে স্বল্পভাষী, প্রচারবিমুখ অথচ খুবই সাহসী মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত হতেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসৈনিক ইনামুল হক চৌধুরী ( বীরপ্রতীক)।
সিলেটের বালাগঞ্জের গৌহরপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালে পিতা বশিরুল হক ও মাতা ছাবেরা খানমের ঘরে জন্ম ইনামুল হকের। ইনামুল হক চৌধুরীর শিক্ষাজীবন শুরু সিলেটের সরকারি পাইলট স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হন সিলেট এমসি কলেজে। পরে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য তিনি মদনমোহন কলেজে। সেখানে তার ছাত্ররাজনীতি পূর্ণাঙ্গতা পায়। তার রাজনীতি ছিল শুদ্ধ রাজনীতি। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন প্রকৃত রাজনৈতিক, জনগণের সেবক। মদনমোহন কলেজে নির্বাচিত ভিপি হিসেবে ইনামুল ১৯৬৬-৬৭ সালে শেখ মুজিবুরের ৬ দফা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। পরে দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৬৮-৬৯ সালে মদনমোহন কলেজের নির্বাচিত ভিপি হয়ে ছাত্রসমাজ দ্বারা পরিচালিত ১১ দফা আন্দোলন সিলেটের ছাত্রদের মাঝে তুলে ধরে আন্দোলনকে বেগবান করতে সংগ্রাম করেন তিনি।
মহান মুক্তিযুুদ্ধে ইনামুল হক চৌধুরীর বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড তাকে স্মরণীয় করে রাখবে ইতিহাসে। ভারতে ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। পাঁচ নম্বর সেক্টরে তিনি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেন। পরে তার দক্ষতা দেখে তাকে এই সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর মহান মুক্তিযুদ্ধে তার এই অবদানের জন্য ইনামুল হক চৌধুরীকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ইনামুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭৯ সালে সিলেটের বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮৬ সালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে অসুস্থ অবস্থায় ও বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ থেকে বিনা প্রচারণায় জনগণের বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। তার নির্বাচনী এলাকায় তিনি ছিলেন একজন দক্ষ, সৎ ও জনপ্রিয় নেতা। ইনামুল হকের জীবনে সর্বদাই অর্থের অনটন ছিল; কিন্তু তবুও তার কাছ থেকে কেউ সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফেরেননি। রাজনীতি মানেই তার কাছে ছিল জনগণের সেবা।
২০১১ সালে তার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে তিনি রোগের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অর্থের অনটনে কলকাতায় সম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষ করতে পারেননি তিনি।
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সিলেটের মাটিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্কমুক্ত করতে, সেই চেষ্টাই ছিল তার সার্বক্ষণিক। সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ কাজে তাগিদ দিতেন সবসময়। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন প্রতিটি বাঙালির আজ ব্যক্তিগত দায় এটা হবে যে, আমি আমার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব এর সপক্ষে কাজ করে যাব। ইনামুল হক চৌধুরী বীরপ্রতীকের মতো বীর সন্তানরা আমাদের সম্পদ। ইনামুল হক চৌধুরী (বীরপ্রতীক) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

কেয়া চৌধুরী :তথ্য, প্রচার সম্পাদক সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম
kchowdhury71@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.