গাজীপুর-৪ উপনির্বাচন- শক্ত অবস্থানে নেই ইসি by তানভীর সোহেল ও মাসুদ রানা

গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) উপনির্বাচনে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আচরণবিধি মেনে প্রার্থীকে প্রচারণা চালাতে বাধ্য করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা, সব প্রার্থীর জন্য সমান পরিবেশ তৈরি—কোনোটাই করতে পারছে না তারা।


কমিশনের ‘নরম’ ভূমিকায় সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন ভোটাররা।
এ পরিস্থিতিতে আজ সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ কাপাসিয়া আসছেন। তিনি নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। কথা বলবেন প্রার্থীদের সঙ্গেও। বর্তমান কমিশনের অধীনে এটা প্রথম নির্বাচন।
জানা গেছে, নিরাপত্তার অভাবে কাপাসিয়ায় প্রার্থীদের নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ২৬ সেপ্টেম্বরের সভাটি বাতিল করা হয়েছে। সুজনের স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, এই সভায় প্রার্থীদের মুখোমুখি করার কথা। কিন্তু পুলিশের পর্যাপ্ত লোকবল না থাকার কথা তাঁদের জানানো হয়েছে। সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে সামাল দেওয়া যাবে না। সুজন এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী সভায় আসতে অপারগতার কথা জানিয়েছেন। গত শনিবার প্রচার চালানোর সময় হামলার শিকার ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী গতকাল রোববার এলাকাতেই যাননি।
সুজনের কাপাসিয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হায়দার বলেছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর ভোট গ্রহণ। কিন্তু নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়নি। কমিশনের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী কাপাসিয়া পরিদর্শনকালে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আরেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ এই নির্বাচনকে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রমাণের ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করেন।
কয়েক দিন নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সামনে প্রতিদিনই ঘটছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা। সরকারি দলের প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আফসারউদ্দীন আহমদের প্রচারণায় বাধা দেওয়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। সরকার-সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী আইন মানায় অনীহা দেখা যাচ্ছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এলাকায় থাকলেও তাদের গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেই। অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালত শুধু মোটরসাইকেলের কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন।
নির্বাচনী প্রচারের সময় মিছিল না করা, মোটরসাইকেলের বহর না রাখার বিধান থাকলেও সরকারি দলের প্রার্থীকে সে ব্যাপারে সতর্ক করার কেউ নেই। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশের কাছে জমা হওয়া অভিযোগগুলোর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তদন্ত চলছে বলেই দায়িত্ব শেষ করছে কাপাসিয়া থানা ও নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়। প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আটটি তথ্য প্রচারের কাজও শুরু করা হয়নি। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা দিয়ে তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়নি। প্রার্থীদের কর্মকাণ্ড রেকর্ড করার জন্য ভিডিও ক্যামেরাম্যান রাখা হলেও তাঁরা সার্বক্ষণিক থাকছেন না।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে। পরিবেশ তৈরি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, নির্বাচন উপলক্ষে অস্ত্র উদ্ধার বা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তাই কাউকে গ্রেপ্তার বা অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।
প্রার্থীরা যা বলছেন: সরকারি দলের প্রার্থী সিমিন হোসেন বলেছেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। এগুলোকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। তাঁর দলের কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারে বাধা দিচ্ছেন—এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ওই প্রার্থী প্রচারণার সময় হয়তো কটু কথা বলেছেন। এ জন্য কর্মীরা প্রতিবাদ করেছেন। তিনি নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আফসারউদ্দীন বলেছেন, এই নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ কমিশন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর প্রচার নির্বিঘ্ন হয়নি। আরেক প্রার্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আসাদুল্লাহ বাদল সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই দুই প্রার্থী কমিশনের নরম মনোভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা আজ সিইসির কাছে অভিযোগ জানাবেন বলে জানিয়েছেন।
যে কারণে শঙ্কা: কাপাসিয়া বাজারে মাইক ভাড়ার ব্যবসা করেন মো. জাহাঙ্গীর। আফসারউদ্দীনের কর্মীরা প্রচারের জন্য সেখান থেকে মাইক ভাড়া নেন। জাহাঙ্গীর কেন মাইক ভাড়া দিলেন, সে জন্য তাঁকে হুমকি দিয়েছেন সরকারদলীয় ব্যক্তিরা। ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর দোকানের সামনে রাখা একটি মাইক ভেঙে ফেলেন তাঁরা।
জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি কারও লোক নন, এলাকার একজন ভোটার। তার পরও তাঁর ক্ষতি হয়ে গেছে। পরিস্থিতি ভালো না হলে তিনি ভোট দিতে যাবেন না বলে জানালেন।
আফসারউদ্দীনের পোস্টার লাগানোর কাজ করছিলেন মো. জুয়েল ও বোরহানউদ্দিন নামের দুই যুবক। এঁদের প্রথমে হুমকি, পরে গত বৃহস্পতিবার মারধর করেন সরকার-সমর্থকেরা।
আফসারউদ্দীনকে কাপাসিয়া বাজারে প্রচারণা চালাতে দেওয়া হয়নি। গত শনিবার তরগাঁও থেকে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে এনেছেন।
তরগাঁও বাজারের মো. শাজাহান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রার্থীদের নিরাপত্তা নেই। ভোটকেন্দ্রে যাওয়া তো কঠিন হবে। ঘাগটিয়া বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, ‘সরকারদলীয়রা বলে বেড়াচ্ছে, ভোট যাকেই দিই না কেন, জিতবে তাদের প্রার্থী।’
গতকাল পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঁচটি অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রার্থী আফসারউদ্দীন ও আসাদুল্লাহ কমিশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.