ভিন্নমত-পাবলিক অফিস হোল্ড করার বিপদ by আবু আহমেদ

ড. মসিউর রহমান একজন সজ্জন। গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে ঝগড়া করার লোক উনি নন। সরকারের মধ্যে যে কয়জন লোক লেখাপড়া জানেন, উনি তাঁদের অন্যতম। আমার জানা মতে, উনি এখনো লেখাপড়া করেন, যেখানে অনেকেই চাকরিতে ঢুকে বা অবসরে যাওয়ার পর পড়ালেখা করাটা ছেড়েই দেন।


মসিউর রহমান তাঁর ক্যারিয়ারটা শুরু করেছেন সিভিল ব্যুরোক্রেসি দিয়ে। আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে উনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য। চাকরি জীবনের শুরুতে শিক্ষকতা করলেও করতে পারেন। লোকে উনাকে ইআরডির সাবেক সচিব এবং আইআরডি বা রেভিনিউ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবেও জানে। উনার সঙ্গে সেমিনার-ওয়ার্কশপে আমার অনেক দেখাশোনা হতো। উনাকে আমিই প্রথম সালাম দিতাম। সেই ড. মসিউর রহমান সম্ভবত আরো দেশ সেবার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং যে কয়জন লোক এ দলের হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক কিছু উপস্থাপন করেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সেই সরকারের উপদেষ্টাও হন। উপদেষ্টা হওয়ায় তাঁর দেশসেবার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপ দিতে সুবিধাই হলো। তবে মসিউর রহমানের মতো সফল ব্যুরোক্রেটসরা আওয়ামী লীগে যোগদান না করে অন্য বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিতেও যোগদান করতে পারতেন। তেমন করে অন্য অনেক প্রথিতযশা সাবেক ব্যুরোক্রেটস এখন বিএনপির অগ্রভাগে আছেন। অনেক সমীকরণ তাঁদেরকে এদিক থেকে ওই দিকে নিয়ে যায়, যে সমীকরণ সম্বন্ধে আমরা মোটেই জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এক ধরনের শিক্ষক-রাজনীতি চলে। একজন অধ্যাপককে দেখলাম তিনি সরকারদলীয় শিক্ষকদের সঙ্গে আছেন। অথচ তাঁর বিশ্বাস ও চালচলন বলে তিনি বিরোধী দলের শিক্ষকদের সঙ্গে থাকার কথা। পরে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম তাঁর অমুক কলিগ বা সহকর্মী বিরোধী দলের সঙ্গে আছেন আর যেহেতু তাঁর সঙ্গে উনার বনিবনা নেই, তাই উনি সরকারি দলে থাকাটাকে পছন্দ করে নিয়েছেন। মসিউরদের মতো লোকদেরও অনেক সমীকরণ, পছন্দ ও অপছন্দ থাকতে পারে রাজনৈতিক দল চয়নের ক্ষেত্রে। সেটা দোষের কিছু নয়। আর আওয়ামী লীগও একটা বড় দল, কখনো বৃহত্তম দল, কখনো দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। সুতরাং সাবেক সিভিল ব্যুরোক্রেটসরা বড় দুদলের মধ্যে যেকোনো একটা দলকে পছন্দ করে নেবেন। তবে বিপরীত দিকে দেখা যায় অবসরপ্রাপ্ত অন্য অনেক কৃতী ব্যুরোক্রেটস কোনো রাজনীতিতেই প্রবেশ করেননি। তাঁরা তাঁদের পরিবার নিয়ে শান্তিপূর্ণ অবসর জীবন যাপন করছেন। এটাও একটা ভালো পথ। ড. মসিউর জানতেন কি না জানি না, বিখ্যাত হওয়ার বিপদও আছে। বিশ্বে কত লোক শুধু বিখ্যাত হতে গিয়ে হেনস্তা হয়েছেন। তাঁরা সিনে বা দৃশ্যে না এলে শেষদিকে এসে হেনস্তা হতেন না। কী কী কারণে লোক পথ থেকে দূরে চলে যায় সেটাও মসিউরের জানার কথা। আর বিখ্যাত লোকেরাই খবরের হেডলাইন হয়- চাই সেটা ভালো কাজ করার সময়ে অথবা স্ক্যান্ডাল বা কেলেঙ্কারি ঘটানোর পর। ড. মসিউর কতটা ভালো কাজ করেছেন, সেটা সেভাবে প্রকাশিত হয়নি। উনার ভালো কাজের ভালো পাবলিসিটি দেওয়ার উপায়ও ছিল না। তবে উনার দুটো মন্তব্যকে আমাদের মতো লোকের ভয়ানক অপছন্দ হয়েছে। একটা হলো উনি যখন বললেন, ভারতের কাছে ট্রানজিটের ফি বা মাসুল চাওয়া অসভ্যতার কাজ হবে। আমার দেশ বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা-রেলপথ বানাল, আর সেটা ভারত প্রায় বিনা মূল্যে ব্যবহার করবে? অবশ্য মসিউর তাঁর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা কোনো দিনই দেননি। এরপর থেকে ড. মসিউরকে লোকেরা মনে করে ক্যাবিনেটের মধ্যে ভারতেরই একজন লোক। লোকের এই ভাবনা যেমন এসে গেল, তখন মানুষের চোখে উনার ওজন অনেক কমে গেল। অথচ আমাদের জানামতে ভারত সাবেক পাকিস্তান সিভিল ব্যুরোক্রেসির সদস্যদেরই তাদের স্বার্থের প্রয়োজনের বিপক্ষ শক্তি মনে করত। আর যখন মসিউরের মতো একজন ঝানু সাবেক আমলা থেকে ভারতকে বিনা মূল্যে ট্রানজিট দেওয়ার কথা শুনলাম, সেই দিন আহতই হলাম। অন্য মন্তব্যটি করেছিলেন উনি শেয়ারবাজারের লোকদের স্প্রিড ও অজ্ঞতা নিয়ে। ওই ভাবনা যদি সঠিকও হয়, তাহলেও সেটা উনার প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। অজ্ঞতা তো একটা উপাদান ছিল বটে। তবে উনার সরকার কি অন্যতম প্রটেকশনটুকু শেয়ারবাজারের লোকদের দিতে পেরেছিল? উনার তো এসইসির ব্যর্থতার জন্য উঁচু গলায় কথা বলা উচিত ছিল। অন্য কথায় আসি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু যখন হবে শুনলাম, আর উনাকে সার্বিক দিকগুলো বিশেষ করে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সচ্ছতা দেখার জন্য স্থানীয় ইনটিগ্রিটি অ্যাডভাইজার করা হলো, তখন আমরা খুশি হলাম এই ভেবে যে একজন উপযুক্ত লোককে ব্যয়ের বিষয়টা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্তত যিনি বিশ্বব্যাংকের কাজকর্মের ধরন বোঝেন। সেই মসিউরের বিরুদ্ধে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ তুলল, তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভাবলাম মসিউর দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে পারেন না। একজন লোকের অধঃপতন এত তাড়াতাড়ি শুরু হতে পারে না। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর পুরো ব্যাপারটাতে মনে হতো বেড়ায় বুঝি ক্ষেত খাচ্ছে। যাক সে; মসিউর বলেছেন, এই দেশের কিছু গুপ্তচর উনার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের কান ভারী করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো গুপ্তচররা কিছু একটা বললে অমনি বিশ্বব্যাংক সেটা বিশ্বাস করে ফেলবে? বিশ্বব্যাংক তো একটা বড় প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমা জগতের লোকদের করের টাকায় সেই সংস্থা চলে। তাঁদের তো দুর্নীতি যাচাই-বাচাই করার নিশ্চয়ই নিজস্ব প্রক্রিয়া আছে। তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান কিভাবে শুধু গুপ্তচরদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেবে। অন্য কথা হলো দেশের লোকজন কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কথাকেই বেশি বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রেও লোকের ভাবনাকে সরকারের পক্ষে নেওয়া যেত, যদি আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বস্ততার কাজ করত। তারা সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে বিষয়গুলোকে দেখছে বলে আজকে লোকে বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপারে বাইরের সূত্রগুলোকে বেশি বিশ্বাস করে। ড. মসিউরকে অনেকে একজন সৎলোক হিসেবেই জানেন। উনার মন-মানুষের ওপর যে চাপ যাচ্ছে, সেটার ভার অনেক বেশি।
প্রশ্ন হলো অ্যাডভাইজরি করা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এর জন্য নিজেকে শুধু কৈফিয়ত দিয়ে চলতে হবে এবং তার জন্য নিজের পরিবারের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিতে হবে? আমি উনার স্থলে হলে যে সিদ্ধান্ত নিতাম, তাহলো এই অ্যাডভাইজরশিপ থেকে ইস্তফা দিতাম। কথা একটা যখন উঠেছেই, সেটির ডালপালা গজানোর আগেই পদ ছেড়ে দিতাম এবং প্রকাশ্যে বলতাম, আমি চোর কি না তা তোমরা খুঁজে দেখো এবং প্রমাণ করো। বর্তমান অবস্থায় ড. মসিউর স্বপদে বহাল থেকেও কি ইচ্ছেমতো এবং ভালো মেজাজে কাজ করতে পারবেন? অবশ্য এ লেখা প্রেসে যাওয়ার আগে মসিউর দীর্ঘ ছুটিতে গেছেন বলে জানা গেছে, যেটা তাঁর জন্যও ভালো হয়েছে, দেশের জন্যও ভালো হয়েছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.