ফর্মুলা নয় আওয়ামী লীগকে আত্মসমর্পণ করতে হবে ॥ খালেদা- দিনাজপুরের বিশাল সমাবেশে ঘোষণা by শরিফুল ইসলাম ও সাজেদুর রহমান শিলু
দিনাজপুর থেকে ॥ অন্তর্বর্তীকালীন ছোট মন্ত্রিসভা সরকারে শরিক হওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, “কোন ফর্মুলায় কাজ হবে না, নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।
তা না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হবে যে পালিয়েও পার পাবেন না।” রবিবার বিকেলে দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ ময়দানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে ১৮ দলীয় জোট আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। স্মরণকালের এই জনসভায় প্রায় ৫ লাখ লোকের সমাগম হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। জাতিসংঘ প্রতিনিধি নিনিয়ান সে সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সমস্যা সমাধানে তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন তারা এই প্রস্তাব মানেনি। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেন, তখন যে ফর্মুলা আপনারা গ্রহণ করেননি, সে ফর্মুলা এখন দিতে পারেন না।
খালেদা জিয়া বলেন, মহাজোট সরকার আজ মহাচোর ও দুর্নীতিবাজ সরকারে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও আজ এ সরকারকে দুর্নীতিবাজ সরকার বলা হয়। প্রবীণ একজন সাংবাদিক বলেছেন, আওয়ামী লীগের লোক দেখলেই বলবেন, ‘তুই চোর, তুই চোর।’ তিনি বলেন, চোরের জায়গা জেলখানা। তাই এই আওয়ামী লীগের জায়গা জেলখানাতেই হবে। তিনি বলেন শুধু টাকা নয়, ভোট চুরিতেও এই সরকার সিদ্ধহস্ত। তাই এই ভোট চোর সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। তিনি বলেন মাছ পচলে যেমন মাছের মাথায় আগে পচন ধরে ঠিক তেমনিভাবে এই সরকারের সর্বোচ্চ মহলে পচন ধরেছে। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এই মহাচোর সরকারের কাছ থেকে দেশ রক্ষা করতে হলে আগামীতে যে আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে তাতে সকলকে শরিক হতে হবে। টিয়ার শেল, বন্দুক ও গুলি কোন কিছুতেই আন্দোলন থামানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আত্মসর্মপণ করতে বাধ্য হবে।
বিএনপি নেতৃতাধীন ১৮ দলীয় জোটের মূল জনসভা দুপুর ৩টা থেকে শুরু হলেও বিকেল ৪টা ১২ মিনিটে মঞ্চে ওঠেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এ সময় তাঁর পরনে ছিল হাল্কা সাদা রঙের শিফন শাড়ি। এ সময় ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ ময়দানে উপস্থিত লাখো জনতা মুহুর্মুহু সেøাগান ও হাত নেড়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী ও দিনাজপুরের কন্যা খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানান। বেগম জিয়ার গাড়িবহর বগুড়া থেকে দিনাজপুরের প্রবেশপথ ঘোড়াঘাট উপজেলায় প্রবেশ করলে শাহ্ ইসমাইল গাজীর মাজারের সামনের সড়কে তাঁকে দিনাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। দিনাজপুরের কৃতীসন্তান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনালের (অব) মাহবুবুর রহমান তাঁকে অর্ভ্যথনা জানান। এর পর বিরোধীদলীয় নেত্রীর গাড়িবহর নবাবগঞ্জ উপজেলার ভাদুরিয়া বাজার, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী বাজার, আমতলী, লক্ষ্মীতলা হয়ে দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করে। প্রথমেই তিনি শহরের ফরিদপুর গোরস্তানে অবস্থিত তাঁর পিতা ইস্কেন্দার মজুমদার, মা তৈয়বা মজুমদার ও বড়বোন খুরশীদ জাহান হকের কবর জিয়ারত করেন। সেখানে তিনি গাড়ি থেকে নেমে অশ্রুসজল চোখে মোনাজাত করেন। এর পর দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বিশ্রাম ও মধ্যাহ্ন ভোজন করেন।
১৮ দলীয় জোটের জনসভা উপলক্ষে রবিবার সকাল থেকেই দিনাজপুর শহর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শহরে প্রবেশের বিভিন্ন পথ দিয়ে ছোট-বড় শত শত মিছিল মূল জনসভাস্থলের দিকে যাওয়া শুরু করে। দুপুর ১২টার মধ্যে গোর-এ শহীদ ময়দানের মূল জনসভাস্থল মানুষে ভরে যায়। শহরে যানজট নিরসনে এর পর আগে ভোর থেকেই পুলিশ প্রশাসন শহরের সব প্রবেশ পথে ছোট, মাঝারি ও বড় যানবাহন প্রবেশে বাধা দেয়। শহরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মোটরসাইকেল ও রিক্সা চলাচল চোখে পড়ে। মূলত রবিবার দিনাজপুর শহর ছিল জনমানুষের শহর। ৩ দিন আগে থেকে দিনাজপুর শহরকে বর্ণিল সজ্জায় সাজানো হয়। শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, আইল্যান্ড ও উঁচু স্থানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি টাঙ্গানো হয়। প্রায় গোটা শহর রঙিন পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে ভরে যায়। শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মোড় থেকে জনসভাস্থল পর্যন্ত প্রায় ১০ গজ পর পর সুদৃশ্য তোরণ বানানো হয়। মূল জনসভাস্থল থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাইক লাগানো হয়। সকাল থেকেই এসব মাইকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক ও দলীয় সঙ্গীত। সব মিলিয়ে রবিবার সারাদিন দিনাজপুর শহর এক সর্বজনীন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। বেগম জিয়ার গাড়িবহর দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলে হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধবনিতা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন তৈরি করে নেত্রীকে স্বাগত জানায়। খালেদা জিয়া মঞ্চে ওঠার পর তাঁর বড় বোন প্রয়াত খুরশীদ জাহান হকের ছবি সংবলিত অসংখ্য বেলুন ওড়ানো হয়। এ ছাড়া শহরজুড়ে খুরশীদ জাহানের অসংখ্য পোস্টার লাগানো হয়।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ লুৎফর রহমান মিন্টুর সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহাবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সামসুজ্জামান দুদু, ফজলুর রহমান পটল, ডা. এবিএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মিজানুর রহমান মিনু, সাংগঠনিক সংম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, ফজলুল হক মিলন, হারুন-অর-রশিদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দীন আলম, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সংসদ সদস্য শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, আসিয়া আশরাফী পাপিয়া, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবর রহমান, মিয়া গোলাম পরওয়ার, এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ, বিজেপির (মঞ্জু) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসাহাক, দিনাজপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, দিনাজপুর পৌর মেয়র মোঃ জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ। জনসভা পরিচালনা করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুকুল চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামান উজ্জ্বল।
খালেদা জিয়া বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাঁরই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষিত লিখিত রায়ে এমন গরমিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা যে হীনরাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই ঘটানো হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচরণ। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
সরকার তাদের কোন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই আজ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেনি দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত উর্ধগতিতে জনগণ দিশেহারা, গ্যাস-বিদ্যুত-পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলার এতই অবনতি ঘটেছে যে, মানুষ ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমসহ গুম হওয়া কারও কোন সন্ধান নেই। সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতিসহ কোন খুনেরই সুরাহা হচ্ছে না। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সীমান্তে প্রতিদিন দেশের মানুষ খুন হচ্ছে, অবাধে চোরাচালান চলতে থাকায় দেশের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে। সরকার ও সরকারী দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব দুর্নীতি ও অনাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তিনি বলেন, আজ আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি দুর্নীতির অভিযোগে কলঙ্কিত। জনগণ এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তারা জুলুম, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবসান চায়। সরকার উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে অকার্যকর করে ফেলেছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ওপরই আজ আর জনগণের আস্থা নেই।
মহাজোট সরকারের আমলে ষষ্ঠবারের মতো বিদ্যুতের পাইকারি ১৭ শতাংশ ও খুচরা ১৫ শতাংশ পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে যথেচ্ছাচার আর স্বেচ্ছাচারিতার চরম বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুত সেক্টরকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনের লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে সরকার গোটা বিদ্যুত সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এই খাত থেকে সরকার ৪০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, এই খাত থেকে সরকার ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে।
৫৫ মিনিটের বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, এ সরকার ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। তিনি বলেন, এই সরকার ডিজিটাল দেশ গড়তে পারেনি, পেরেছেন ডিজিটাল দুর্নীতির রেকর্ড গড়তে। তিনি বলেন, হলমার্কের এমডি তানভীরের সঙ্গে হাওয়া ভবনকে জড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সর্বোচ্চ মিথ্যা ও জঘন্য অপপ্রচার। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কদর্য মিথ্যাচার আওয়ামী রাজনীতির সংস্কৃতি। চরিত্র হনন, প্রতিহিংসা, কটূক্তি আওয়ামী সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। এখনও কোন আইনী ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করেনি। তা থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায়, হলমার্কের এমডি (তানভীর) কোন্ ভবনের লোক।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার হিংসুটে সরকার। তার বড় শিকার ড. ইউনূস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন। অপরদিকে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ হিসেবে নোবেল পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম সুপারিশ করা যেতে পারে। দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান। এর চেয়ে সরকারের আর বড় ব্যর্থতা কী রয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, পদ্ম সেতু থেকে ৩শ’ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এর পরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। শুরু করা হলো চাঁদাবাজি। বাচ্চাদের টিফিনের পয়সাও তারা আত্মসাত করেছে। তিনি বলেন, ১০ মাস আগে বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে নিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখন তারা নাকে খত দিয়ে ও কান ধরে উঠবস করে বিশ্বব্যাংকে শর্তসাপেক্ষে রাজি করিয়েছে। জনগণকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সরকারের লোকদের যেখানে পাবেন কান ধরে উঠবস করাবেন।
পরোক্ষভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে খালেদা জিয়া বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কেউ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে অন্য জায়গায় বসে ছিলেন। আর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে, বাংলাদেশ কোনদিন স্বাধীন হতো না। তিনি বলেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের স্বাধীনতার সপক্ষের দল। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বেগম জিয়া বলেন, তাদের সময়ই দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ, বোমা হামলা, খুনের ঘটনা ঘটে। তারাই জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আর বিএনপি তাদের উপযুক্ত বিচার করেছে।
তিনি বলেন, এই সরকারের হাতে জনগণের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। দেশবরেণ্য আইনজীবী ড. কামালের মতো মানুষও আজ গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকেন। আমাদেরও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে গুম হত্যার হুমকিকে আমরা ভয় পাই না। তিনি বলেন, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে প্রতিদিন সীমান্তে বিএসএফ নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যা করছে। কিশোরী ফেলানীকে হত্যা করে নৃশংসভাবে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। আমরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। অন্য দেশের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার জন্য নয়। অথচ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই সরকার সবকিছু বিলিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা সকল দেশের সঙ্গে সম-মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখতে চাই। কোন দাসখত দিয়ে নয়।
পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সকল ভয়ভীতির উর্ধে থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। সকলের নাম ঠিকানা লেখা আছে। মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। বহু দুর্নীতি করে জমানো টাকায় তারা বিদেশে পালাবে। কিন্তু আপনারা পালাবেন কোথায়। জুলুম নির্যাতন বন্ধ না করলে আপনারদের পরিণতি ভয়াবহ হবে।
উত্তরাঞ্চলকে কৃষিনির্ভরশীল এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে ওয়াদা করেছিলেন, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবেন। অথচ এখন কৃষক বিনামূল্যে সার পাচ্ছে না। এই সরকারের সময় কৃষকরা ৩শ’ টাকার বস্তার সার ১২শ’ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষককদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত ধান কেনা হচ্ছে না। এসব ধান সরকারী গুদামে ঢুকিয়ে ফায়দা লুটছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিটি কৃষি উপকরণের দামই এখন অনেক বেশি। বেগম জিয়া বলেন, শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছিলেন নির্বাচিত হলে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং আওয়ামী না করলে অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন। এই সরকারের ব্যর্থতা ও নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে বিদেশ থেকে বাংলাদেশীরা খালি হাতে ফিরে আসছে। এ সরকার সারাদেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর আগে রবিবার দুপুর ১২টায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বগুড়া সার্কিট হাউসে জেলা বিএনপির একটি ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি দলের নেতাকর্মীদের বলেন, সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আগামীতে সকলকে সমবেতভাবে আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে হবে। এরপর দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তিনি বগুড়া সার্কিট হাউস থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। জাতিসংঘ প্রতিনিধি নিনিয়ান সে সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সমস্যা সমাধানে তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন তারা এই প্রস্তাব মানেনি। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেন, তখন যে ফর্মুলা আপনারা গ্রহণ করেননি, সে ফর্মুলা এখন দিতে পারেন না।
খালেদা জিয়া বলেন, মহাজোট সরকার আজ মহাচোর ও দুর্নীতিবাজ সরকারে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও আজ এ সরকারকে দুর্নীতিবাজ সরকার বলা হয়। প্রবীণ একজন সাংবাদিক বলেছেন, আওয়ামী লীগের লোক দেখলেই বলবেন, ‘তুই চোর, তুই চোর।’ তিনি বলেন, চোরের জায়গা জেলখানা। তাই এই আওয়ামী লীগের জায়গা জেলখানাতেই হবে। তিনি বলেন শুধু টাকা নয়, ভোট চুরিতেও এই সরকার সিদ্ধহস্ত। তাই এই ভোট চোর সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। তিনি বলেন মাছ পচলে যেমন মাছের মাথায় আগে পচন ধরে ঠিক তেমনিভাবে এই সরকারের সর্বোচ্চ মহলে পচন ধরেছে। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এই মহাচোর সরকারের কাছ থেকে দেশ রক্ষা করতে হলে আগামীতে যে আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে তাতে সকলকে শরিক হতে হবে। টিয়ার শেল, বন্দুক ও গুলি কোন কিছুতেই আন্দোলন থামানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আত্মসর্মপণ করতে বাধ্য হবে।
বিএনপি নেতৃতাধীন ১৮ দলীয় জোটের মূল জনসভা দুপুর ৩টা থেকে শুরু হলেও বিকেল ৪টা ১২ মিনিটে মঞ্চে ওঠেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এ সময় তাঁর পরনে ছিল হাল্কা সাদা রঙের শিফন শাড়ি। এ সময় ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ ময়দানে উপস্থিত লাখো জনতা মুহুর্মুহু সেøাগান ও হাত নেড়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী ও দিনাজপুরের কন্যা খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানান। বেগম জিয়ার গাড়িবহর বগুড়া থেকে দিনাজপুরের প্রবেশপথ ঘোড়াঘাট উপজেলায় প্রবেশ করলে শাহ্ ইসমাইল গাজীর মাজারের সামনের সড়কে তাঁকে দিনাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। দিনাজপুরের কৃতীসন্তান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনালের (অব) মাহবুবুর রহমান তাঁকে অর্ভ্যথনা জানান। এর পর বিরোধীদলীয় নেত্রীর গাড়িবহর নবাবগঞ্জ উপজেলার ভাদুরিয়া বাজার, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী বাজার, আমতলী, লক্ষ্মীতলা হয়ে দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করে। প্রথমেই তিনি শহরের ফরিদপুর গোরস্তানে অবস্থিত তাঁর পিতা ইস্কেন্দার মজুমদার, মা তৈয়বা মজুমদার ও বড়বোন খুরশীদ জাহান হকের কবর জিয়ারত করেন। সেখানে তিনি গাড়ি থেকে নেমে অশ্রুসজল চোখে মোনাজাত করেন। এর পর দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বিশ্রাম ও মধ্যাহ্ন ভোজন করেন।
১৮ দলীয় জোটের জনসভা উপলক্ষে রবিবার সকাল থেকেই দিনাজপুর শহর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শহরে প্রবেশের বিভিন্ন পথ দিয়ে ছোট-বড় শত শত মিছিল মূল জনসভাস্থলের দিকে যাওয়া শুরু করে। দুপুর ১২টার মধ্যে গোর-এ শহীদ ময়দানের মূল জনসভাস্থল মানুষে ভরে যায়। শহরে যানজট নিরসনে এর পর আগে ভোর থেকেই পুলিশ প্রশাসন শহরের সব প্রবেশ পথে ছোট, মাঝারি ও বড় যানবাহন প্রবেশে বাধা দেয়। শহরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মোটরসাইকেল ও রিক্সা চলাচল চোখে পড়ে। মূলত রবিবার দিনাজপুর শহর ছিল জনমানুষের শহর। ৩ দিন আগে থেকে দিনাজপুর শহরকে বর্ণিল সজ্জায় সাজানো হয়। শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, আইল্যান্ড ও উঁচু স্থানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি টাঙ্গানো হয়। প্রায় গোটা শহর রঙিন পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে ভরে যায়। শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মোড় থেকে জনসভাস্থল পর্যন্ত প্রায় ১০ গজ পর পর সুদৃশ্য তোরণ বানানো হয়। মূল জনসভাস্থল থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাইক লাগানো হয়। সকাল থেকেই এসব মাইকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক ও দলীয় সঙ্গীত। সব মিলিয়ে রবিবার সারাদিন দিনাজপুর শহর এক সর্বজনীন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। বেগম জিয়ার গাড়িবহর দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলে হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধবনিতা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন তৈরি করে নেত্রীকে স্বাগত জানায়। খালেদা জিয়া মঞ্চে ওঠার পর তাঁর বড় বোন প্রয়াত খুরশীদ জাহান হকের ছবি সংবলিত অসংখ্য বেলুন ওড়ানো হয়। এ ছাড়া শহরজুড়ে খুরশীদ জাহানের অসংখ্য পোস্টার লাগানো হয়।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ লুৎফর রহমান মিন্টুর সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহাবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সামসুজ্জামান দুদু, ফজলুর রহমান পটল, ডা. এবিএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মিজানুর রহমান মিনু, সাংগঠনিক সংম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, ফজলুল হক মিলন, হারুন-অর-রশিদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দীন আলম, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সংসদ সদস্য শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, আসিয়া আশরাফী পাপিয়া, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবর রহমান, মিয়া গোলাম পরওয়ার, এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ, বিজেপির (মঞ্জু) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসাহাক, দিনাজপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, দিনাজপুর পৌর মেয়র মোঃ জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ। জনসভা পরিচালনা করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুকুল চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামান উজ্জ্বল।
খালেদা জিয়া বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাঁরই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষিত লিখিত রায়ে এমন গরমিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা যে হীনরাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই ঘটানো হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচরণ। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
সরকার তাদের কোন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই আজ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেনি দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত উর্ধগতিতে জনগণ দিশেহারা, গ্যাস-বিদ্যুত-পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলার এতই অবনতি ঘটেছে যে, মানুষ ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমসহ গুম হওয়া কারও কোন সন্ধান নেই। সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতিসহ কোন খুনেরই সুরাহা হচ্ছে না। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সীমান্তে প্রতিদিন দেশের মানুষ খুন হচ্ছে, অবাধে চোরাচালান চলতে থাকায় দেশের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে। সরকার ও সরকারী দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব দুর্নীতি ও অনাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তিনি বলেন, আজ আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি দুর্নীতির অভিযোগে কলঙ্কিত। জনগণ এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তারা জুলুম, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবসান চায়। সরকার উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে অকার্যকর করে ফেলেছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ওপরই আজ আর জনগণের আস্থা নেই।
মহাজোট সরকারের আমলে ষষ্ঠবারের মতো বিদ্যুতের পাইকারি ১৭ শতাংশ ও খুচরা ১৫ শতাংশ পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে যথেচ্ছাচার আর স্বেচ্ছাচারিতার চরম বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুত সেক্টরকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনের লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে সরকার গোটা বিদ্যুত সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এই খাত থেকে সরকার ৪০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, এই খাত থেকে সরকার ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে।
৫৫ মিনিটের বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, এ সরকার ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। তিনি বলেন, এই সরকার ডিজিটাল দেশ গড়তে পারেনি, পেরেছেন ডিজিটাল দুর্নীতির রেকর্ড গড়তে। তিনি বলেন, হলমার্কের এমডি তানভীরের সঙ্গে হাওয়া ভবনকে জড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সর্বোচ্চ মিথ্যা ও জঘন্য অপপ্রচার। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কদর্য মিথ্যাচার আওয়ামী রাজনীতির সংস্কৃতি। চরিত্র হনন, প্রতিহিংসা, কটূক্তি আওয়ামী সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। এখনও কোন আইনী ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করেনি। তা থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায়, হলমার্কের এমডি (তানভীর) কোন্ ভবনের লোক।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার হিংসুটে সরকার। তার বড় শিকার ড. ইউনূস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন। অপরদিকে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ হিসেবে নোবেল পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম সুপারিশ করা যেতে পারে। দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান। এর চেয়ে সরকারের আর বড় ব্যর্থতা কী রয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, পদ্ম সেতু থেকে ৩শ’ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এর পরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। শুরু করা হলো চাঁদাবাজি। বাচ্চাদের টিফিনের পয়সাও তারা আত্মসাত করেছে। তিনি বলেন, ১০ মাস আগে বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে নিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখন তারা নাকে খত দিয়ে ও কান ধরে উঠবস করে বিশ্বব্যাংকে শর্তসাপেক্ষে রাজি করিয়েছে। জনগণকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সরকারের লোকদের যেখানে পাবেন কান ধরে উঠবস করাবেন।
পরোক্ষভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে খালেদা জিয়া বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কেউ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে অন্য জায়গায় বসে ছিলেন। আর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে, বাংলাদেশ কোনদিন স্বাধীন হতো না। তিনি বলেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের স্বাধীনতার সপক্ষের দল। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বেগম জিয়া বলেন, তাদের সময়ই দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ, বোমা হামলা, খুনের ঘটনা ঘটে। তারাই জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আর বিএনপি তাদের উপযুক্ত বিচার করেছে।
তিনি বলেন, এই সরকারের হাতে জনগণের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। দেশবরেণ্য আইনজীবী ড. কামালের মতো মানুষও আজ গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকেন। আমাদেরও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে গুম হত্যার হুমকিকে আমরা ভয় পাই না। তিনি বলেন, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে প্রতিদিন সীমান্তে বিএসএফ নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যা করছে। কিশোরী ফেলানীকে হত্যা করে নৃশংসভাবে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। আমরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। অন্য দেশের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার জন্য নয়। অথচ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই সরকার সবকিছু বিলিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা সকল দেশের সঙ্গে সম-মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখতে চাই। কোন দাসখত দিয়ে নয়।
পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সকল ভয়ভীতির উর্ধে থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। সকলের নাম ঠিকানা লেখা আছে। মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। বহু দুর্নীতি করে জমানো টাকায় তারা বিদেশে পালাবে। কিন্তু আপনারা পালাবেন কোথায়। জুলুম নির্যাতন বন্ধ না করলে আপনারদের পরিণতি ভয়াবহ হবে।
উত্তরাঞ্চলকে কৃষিনির্ভরশীল এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে ওয়াদা করেছিলেন, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবেন। অথচ এখন কৃষক বিনামূল্যে সার পাচ্ছে না। এই সরকারের সময় কৃষকরা ৩শ’ টাকার বস্তার সার ১২শ’ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষককদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত ধান কেনা হচ্ছে না। এসব ধান সরকারী গুদামে ঢুকিয়ে ফায়দা লুটছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিটি কৃষি উপকরণের দামই এখন অনেক বেশি। বেগম জিয়া বলেন, শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছিলেন নির্বাচিত হলে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং আওয়ামী না করলে অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন। এই সরকারের ব্যর্থতা ও নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে বিদেশ থেকে বাংলাদেশীরা খালি হাতে ফিরে আসছে। এ সরকার সারাদেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর আগে রবিবার দুপুর ১২টায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বগুড়া সার্কিট হাউসে জেলা বিএনপির একটি ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি দলের নেতাকর্মীদের বলেন, সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আগামীতে সকলকে সমবেতভাবে আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে হবে। এরপর দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তিনি বগুড়া সার্কিট হাউস থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দেন।
No comments