নজরদারি বাড়ানোর পক্ষে বিশেষজ্ঞরা-কয়েকটি কম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক আচরণ by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু
শেয়ারবাজারে টাকার জোগান বাড়ছে, বাড়ছে সার্বিক সূচকও। অনেক দুর্যোগের পর পুঁজিবাজারের এই ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনায় সৃষ্টি হয়েছে আশাবাদ। তবে কয়েকটি কম্পানির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কিছুদিন আগে বিক্রি শুরু হওয়া কয়েকটি শেয়ারের দাম ৮৮ থেকে ৩২৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর পেছনে কারসাজি থাকতে পারে।
গত দুই মাসে ঢাকার শেয়ারবাজারের সূচক বেড়েছে ১৭ শতাংশ। দৃঢ় মৌলভিত্তির কোনো কোনো কম্পানির শেয়ারের দাম এ সময়ে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, কোনোটির বেড়েছে ৮ শতাংশ। কিছু কম্পানির শেয়ারের এ রকম লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বৃদ্ধিকে শেয়ারবাজারের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার আগে এ রকমভাবেই জুয়াড়িরা শেয়ারের দাম বাড়িয়েছিল। তাই নিয়ন্ত্রক ও বাজার পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
লেনদেনের দৈনন্দিন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্দিষ্ট খাতের কয়েকটি কম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়ায় দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এরপর একপর্যায়ে শুরু হচ্ছে বিক্রির চাপ। মনে করা হচ্ছে, একটি মহল শেয়ার কিনে ধরে রেখে দর বৃদ্ধির পর ছেড়ে দিচ্ছে, ঢুকছে নতুন খাতের নতুন কোনো কম্পানিতে। মাঝখানে বেশি দামে কিনে বিপাকে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কম্পানির মৌলভিত্তি বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের গুজবে কান দিয়ে তাঁরা এসব শেয়ার কিনছেন। এরপর আটকে গিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে কেনা দামে বা লাভে শেয়ারটি বিক্রি করতে পারবেন। এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে এসব কম্পানির কাছে দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কম্পানিগুলো জানিয়েছে, তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
১৪ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২৪ টাকা ইস্যু মূল্যের আমরা টেকনোলজিসের লেনদেন শুরু হয় গত ৪ জুন। একপর্যায়ে ইস্যু মূল্যের নিচে চলে আসে এর দর। প্রতিটি শেয়ার গত ১৬ জুলাই সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৮.৪০ টাকা দরে। গত ১৩ আগস্ট এর দর ছিল ৩০.২০ টাকা। বাড়তে বাড়তে ১৮ সেপ্টেম্বর এর দাম ওঠে ৭৭.৪০ টাকায়। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে কম্পানিটি- এমন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এর অস্বাভাবিক উত্থান আরো বৃদ্ধি পায়। তবে শেষ পর্যন্ত দুই দিন ধরে এর দাম কমতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার ২০ সেপ্টেম্বর এর দর ছিল ৬৮.৮০ টাকা। ১৬ জুলাই থেকে গত মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দর বৃদ্ধি হার ছিল ৩২৭ শতাংশ।
৬৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৭৫ টাকার ইউনিক হোটেলের শেয়ারের লেনদেন শুরু হয় ২ জুন। ১৬ জুলাই এর দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে আসে। ওইদিন সর্বশেষ লেনদেন শেষ হয় ৬৩.৯০ টাকায়। এরপর একটু একটু করে দর বাড়তে থাকে এবং ১৯ সেপ্টেম্বর এর দাম ছিল ১৫৫.৯০ টাকা। ১৬ জুলাই থেকে এর দর বৃদ্ধির হার ছিল ১৪৬ শতাংশ।
গত ১৩ আগস্ট ইউনিক হোটেলের শেয়ারের দাম ছিল ৯১.৭০ টাকা। আগস্ট মাসের শেষ দিন এর দাম পৌঁছে ১৩০ টাকায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর কম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা করে কম্পানিটির পরিচালনা পরিষদ। ঘোষিত লভ্যাংশ ছিল ৩০ শতাংশ (১৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ স্টক বোনাস)। এর পরই ১৯ সেপ্টেম্বর এর দর সর্বোচ্চ ১৫৫.৯০ টাকায় ওঠে। পরের দিন গত ২০ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) এর দাম কমে ১৪০ টাকায় নেমেছে।
গত ২৪ জুন সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন শুরু হয়েছে সায়হাম কটনের। শুরুর দিন থেকে ২০ টাকা ইস্যু মূল্য থেকে কমে বিক্রি হয় এর শেয়ার। ১৬ জুলাই এর সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৫ টাকা ৭০ পয়সা দরে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দাম সর্বোচ্চ ৪৪.৪০ টাকায় ওঠে। ১৬ জুলাই থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দর বৃদ্ধির হার ছিল ১৮৬ শতাংশ।
দেখা গেছে, ১৬ জুলাই থেকেই বাড়তে থাকে সায়হাম কটনের শেয়ারের দর। ৩০ আগস্ট ইস্যু মুল্যে বেশ ওপরে ২৬ টাকায় লেনদেন হয় এর শেয়ারের। গত ২ সেপ্টেম্বর কম্পানির পরিচালনা পরিষদ ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর রেকর্ড ডেট ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে এর দর বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে। এদিন এর প্রতিটি শেয়ারের দাম ২৮ থেকে ২৯ টাকার মধ্যে ওঠা-নামা করে। পরবর্তী ছয় কার্যদিবসে এর দাম সর্বোচ্চ ৪৪.৪০ টাকায় ওঠে। সর্বোচ্চ দর ওঠে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এই দর বৃদ্ধির সঙ্গে ঘোষিত লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্তির কোনো সামঞ্জস্য নেই বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর পরের দুই দিনে এর প্রমাণও মেলে। টানা দরপতন ঘটেছে এ দুই দিন। গত ২০ সেপ্টেম্বর এর দর নামে ৩৯.৯০ টাকায়।
ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ৪০ টাকা ইস্যু দরের বিদ্যুৎ খাতের কম্পানি জিবিবি পাওয়ারের শেয়ার লেনদেন শুরু হয় গত ১৩ জুন। শুরুর দিনে ৪৩ টাকা দরে লেনদেন হয়। গত ১৬ জুলাই দর ছিল ২৬ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর একটু একটু করে দাম বাড়তে বাড়তে ঈদের পর ২৬ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর ওঠে ৪০ টাকার ঘরে। এরপর আবার কমে যায়। ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর বৃদ্ধি ছিল অস্বাভাবিক। ৩৭ থেকে ৪৯.৬০ টাকায় ওঠে যায় প্রতিটি শেয়ারের দাম। ১১ সেপ্টেম্বর এর সর্বোচ্চ দর ৪৯.৬০ টাকায় ওঠে। এদিনই এর লভ্যাংশ ঘোষণা করে কম্পানির পরিচালনা পরিষদ। তাতে ২৫ শতাংশ স্টক বোনাস ও ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটি। এই লভ্যাংশ ঘোষণার প্রভাবেই চার কার্যদিবসে এর দর বৃদ্ধি পায় ৩৪ শতাংশ। ১৬ জুলাই থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর বৃদ্ধির হার ছিল ৮৮ শতাংশ। সাধারণত লভ্যাংশ ঘোষণার পরে দর বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু আগাম তথ্য ছড়িয়ে আগেই দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন থেকেই এর দাম কমতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার দর ছিল ৪৩ টাকা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে ১৬ জুলাই থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক বেড়েছে ৬৮৪ পয়েন্ট বা ১৭ শতাংশ। ১৬ জুলাই ডিএসইর সূচক ছিল ৩৯৯৪ পয়েন্ট। ২০ সেপ্টেম্বর এই সূচক ৬৮৪ পয়েন্ট বেড়ে ৪৬৭৮ পয়েন্টে ওঠে। এই সময়ে ডিএসইর তালিকাভুক্ত শক্ত মৌলভিত্তির কম্পানি গ্রামীণফোনের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ। ১৬ জুলাই এই কম্পানির দাম ছিল ২১০ টাকার কাছাকাছি। ২০ সেপ্টেম্বর এই শেয়ারের দাম ছিল ১৭৪ টাকা। অপর শক্ত কম্পানি গ্লাক্সোস্মিথ কে লাইনের দাম ছিল ১৬ জুলাই ৫০০ টাকা। গতকাল রবিবার পর্যন্ত এর দাম উঠেছে ৫৪০ টাকা এবং এর দর বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ভালো মৌলভিত্তির কম্পানিগুলোর দর বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু নতুন ও কম শক্তিশালী কম্পানির দর বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক রকম বেশি।
এসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, যেভাবে কয়েকটি কম্পানির দর বাড়ছে, বাজারের জন্য তা আবার বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ব্যাপারে এসইসির নজরদারি বিভাগের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে এসব কম্পানির শেয়ার কিনছেন বিনিয়োগকারীরা। কোনো আইনের আওতায় তাদের ধরা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, গুজব ছড়িয়ে বেশ কয়েকটি কম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, শেয়ারবাজারের যে ঊর্ধ্বগতি এটা স্বাভাবিক। সামগ্রিক সূচক খুব বেশি বাড়েনি। বৃদ্ধির হার ১ থেকে ৩ শতাংশ। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির হার যদি অনেক বেশি হয়, তবে সে ব্যাপারে এসইসি ও ডিএসইকে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখতে হবে সে ক্ষেত্রে কোনো সংঘবদ্ধ চক্র কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে কি-না। এবং তা বন্ধ করতে হবে। নইলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবার বিপদে পড়বেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে একপ্রকার জুয়াখেলা (গ্যাম্বলিং) চলছে। তবে এবার ছোট বাজারে ছোট আকারে হচ্ছে। যেসব কম্পানির দাম বাড়ার কথা, সেসব কম্পানির দাম না বেড়ে নির্দিষ্ট কিছু কম্পানির দাম বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি আরো বলেন, যেসব কম্পানি সার্কিট ব্রেকারে পৌঁছেছে, তাদের দাম এত বেশি বাড়ার কোনো কারণ নেই।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। এর আগের দুই মাস বা তারও আগে থেকে একই ধারায় বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময়ে বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির হার ছিল ১০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত। আফতাব অটোমোবাইল কম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০০ থেকে ৭০০ টাকায় উঠেছিল দুই মাসের ব্যবধানে। এ রকম অসংখ্য কম্পানির দর উঠেছিল ২০০ থেকে ৩০০ ভাগ।
গত দুই মাসে ঢাকার শেয়ারবাজারের সূচক বেড়েছে ১৭ শতাংশ। দৃঢ় মৌলভিত্তির কোনো কোনো কম্পানির শেয়ারের দাম এ সময়ে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, কোনোটির বেড়েছে ৮ শতাংশ। কিছু কম্পানির শেয়ারের এ রকম লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বৃদ্ধিকে শেয়ারবাজারের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার আগে এ রকমভাবেই জুয়াড়িরা শেয়ারের দাম বাড়িয়েছিল। তাই নিয়ন্ত্রক ও বাজার পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
লেনদেনের দৈনন্দিন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্দিষ্ট খাতের কয়েকটি কম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়ায় দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এরপর একপর্যায়ে শুরু হচ্ছে বিক্রির চাপ। মনে করা হচ্ছে, একটি মহল শেয়ার কিনে ধরে রেখে দর বৃদ্ধির পর ছেড়ে দিচ্ছে, ঢুকছে নতুন খাতের নতুন কোনো কম্পানিতে। মাঝখানে বেশি দামে কিনে বিপাকে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কম্পানির মৌলভিত্তি বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের গুজবে কান দিয়ে তাঁরা এসব শেয়ার কিনছেন। এরপর আটকে গিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে কেনা দামে বা লাভে শেয়ারটি বিক্রি করতে পারবেন। এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে এসব কম্পানির কাছে দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কম্পানিগুলো জানিয়েছে, তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
১৪ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২৪ টাকা ইস্যু মূল্যের আমরা টেকনোলজিসের লেনদেন শুরু হয় গত ৪ জুন। একপর্যায়ে ইস্যু মূল্যের নিচে চলে আসে এর দর। প্রতিটি শেয়ার গত ১৬ জুলাই সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৮.৪০ টাকা দরে। গত ১৩ আগস্ট এর দর ছিল ৩০.২০ টাকা। বাড়তে বাড়তে ১৮ সেপ্টেম্বর এর দাম ওঠে ৭৭.৪০ টাকায়। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে কম্পানিটি- এমন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এর অস্বাভাবিক উত্থান আরো বৃদ্ধি পায়। তবে শেষ পর্যন্ত দুই দিন ধরে এর দাম কমতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার ২০ সেপ্টেম্বর এর দর ছিল ৬৮.৮০ টাকা। ১৬ জুলাই থেকে গত মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দর বৃদ্ধি হার ছিল ৩২৭ শতাংশ।
৬৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৭৫ টাকার ইউনিক হোটেলের শেয়ারের লেনদেন শুরু হয় ২ জুন। ১৬ জুলাই এর দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে আসে। ওইদিন সর্বশেষ লেনদেন শেষ হয় ৬৩.৯০ টাকায়। এরপর একটু একটু করে দর বাড়তে থাকে এবং ১৯ সেপ্টেম্বর এর দাম ছিল ১৫৫.৯০ টাকা। ১৬ জুলাই থেকে এর দর বৃদ্ধির হার ছিল ১৪৬ শতাংশ।
গত ১৩ আগস্ট ইউনিক হোটেলের শেয়ারের দাম ছিল ৯১.৭০ টাকা। আগস্ট মাসের শেষ দিন এর দাম পৌঁছে ১৩০ টাকায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর কম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা করে কম্পানিটির পরিচালনা পরিষদ। ঘোষিত লভ্যাংশ ছিল ৩০ শতাংশ (১৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ স্টক বোনাস)। এর পরই ১৯ সেপ্টেম্বর এর দর সর্বোচ্চ ১৫৫.৯০ টাকায় ওঠে। পরের দিন গত ২০ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) এর দাম কমে ১৪০ টাকায় নেমেছে।
গত ২৪ জুন সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন শুরু হয়েছে সায়হাম কটনের। শুরুর দিন থেকে ২০ টাকা ইস্যু মূল্য থেকে কমে বিক্রি হয় এর শেয়ার। ১৬ জুলাই এর সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৫ টাকা ৭০ পয়সা দরে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দাম সর্বোচ্চ ৪৪.৪০ টাকায় ওঠে। ১৬ জুলাই থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দর বৃদ্ধির হার ছিল ১৮৬ শতাংশ।
দেখা গেছে, ১৬ জুলাই থেকেই বাড়তে থাকে সায়হাম কটনের শেয়ারের দর। ৩০ আগস্ট ইস্যু মুল্যে বেশ ওপরে ২৬ টাকায় লেনদেন হয় এর শেয়ারের। গত ২ সেপ্টেম্বর কম্পানির পরিচালনা পরিষদ ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর রেকর্ড ডেট ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে এর দর বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে। এদিন এর প্রতিটি শেয়ারের দাম ২৮ থেকে ২৯ টাকার মধ্যে ওঠা-নামা করে। পরবর্তী ছয় কার্যদিবসে এর দাম সর্বোচ্চ ৪৪.৪০ টাকায় ওঠে। সর্বোচ্চ দর ওঠে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এই দর বৃদ্ধির সঙ্গে ঘোষিত লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্তির কোনো সামঞ্জস্য নেই বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর পরের দুই দিনে এর প্রমাণও মেলে। টানা দরপতন ঘটেছে এ দুই দিন। গত ২০ সেপ্টেম্বর এর দর নামে ৩৯.৯০ টাকায়।
ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ৪০ টাকা ইস্যু দরের বিদ্যুৎ খাতের কম্পানি জিবিবি পাওয়ারের শেয়ার লেনদেন শুরু হয় গত ১৩ জুন। শুরুর দিনে ৪৩ টাকা দরে লেনদেন হয়। গত ১৬ জুলাই দর ছিল ২৬ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর একটু একটু করে দাম বাড়তে বাড়তে ঈদের পর ২৬ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর ওঠে ৪০ টাকার ঘরে। এরপর আবার কমে যায়। ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর বৃদ্ধি ছিল অস্বাভাবিক। ৩৭ থেকে ৪৯.৬০ টাকায় ওঠে যায় প্রতিটি শেয়ারের দাম। ১১ সেপ্টেম্বর এর সর্বোচ্চ দর ৪৯.৬০ টাকায় ওঠে। এদিনই এর লভ্যাংশ ঘোষণা করে কম্পানির পরিচালনা পরিষদ। তাতে ২৫ শতাংশ স্টক বোনাস ও ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটি। এই লভ্যাংশ ঘোষণার প্রভাবেই চার কার্যদিবসে এর দর বৃদ্ধি পায় ৩৪ শতাংশ। ১৬ জুলাই থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর দর বৃদ্ধির হার ছিল ৮৮ শতাংশ। সাধারণত লভ্যাংশ ঘোষণার পরে দর বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু আগাম তথ্য ছড়িয়ে আগেই দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন থেকেই এর দাম কমতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার দর ছিল ৪৩ টাকা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে ১৬ জুলাই থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক বেড়েছে ৬৮৪ পয়েন্ট বা ১৭ শতাংশ। ১৬ জুলাই ডিএসইর সূচক ছিল ৩৯৯৪ পয়েন্ট। ২০ সেপ্টেম্বর এই সূচক ৬৮৪ পয়েন্ট বেড়ে ৪৬৭৮ পয়েন্টে ওঠে। এই সময়ে ডিএসইর তালিকাভুক্ত শক্ত মৌলভিত্তির কম্পানি গ্রামীণফোনের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ। ১৬ জুলাই এই কম্পানির দাম ছিল ২১০ টাকার কাছাকাছি। ২০ সেপ্টেম্বর এই শেয়ারের দাম ছিল ১৭৪ টাকা। অপর শক্ত কম্পানি গ্লাক্সোস্মিথ কে লাইনের দাম ছিল ১৬ জুলাই ৫০০ টাকা। গতকাল রবিবার পর্যন্ত এর দাম উঠেছে ৫৪০ টাকা এবং এর দর বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ভালো মৌলভিত্তির কম্পানিগুলোর দর বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু নতুন ও কম শক্তিশালী কম্পানির দর বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক রকম বেশি।
এসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, যেভাবে কয়েকটি কম্পানির দর বাড়ছে, বাজারের জন্য তা আবার বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ব্যাপারে এসইসির নজরদারি বিভাগের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে এসব কম্পানির শেয়ার কিনছেন বিনিয়োগকারীরা। কোনো আইনের আওতায় তাদের ধরা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, গুজব ছড়িয়ে বেশ কয়েকটি কম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, শেয়ারবাজারের যে ঊর্ধ্বগতি এটা স্বাভাবিক। সামগ্রিক সূচক খুব বেশি বাড়েনি। বৃদ্ধির হার ১ থেকে ৩ শতাংশ। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির হার যদি অনেক বেশি হয়, তবে সে ব্যাপারে এসইসি ও ডিএসইকে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখতে হবে সে ক্ষেত্রে কোনো সংঘবদ্ধ চক্র কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে কি-না। এবং তা বন্ধ করতে হবে। নইলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবার বিপদে পড়বেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে একপ্রকার জুয়াখেলা (গ্যাম্বলিং) চলছে। তবে এবার ছোট বাজারে ছোট আকারে হচ্ছে। যেসব কম্পানির দাম বাড়ার কথা, সেসব কম্পানির দাম না বেড়ে নির্দিষ্ট কিছু কম্পানির দাম বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি আরো বলেন, যেসব কম্পানি সার্কিট ব্রেকারে পৌঁছেছে, তাদের দাম এত বেশি বাড়ার কোনো কারণ নেই।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। এর আগের দুই মাস বা তারও আগে থেকে একই ধারায় বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময়ে বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির হার ছিল ১০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত। আফতাব অটোমোবাইল কম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০০ থেকে ৭০০ টাকায় উঠেছিল দুই মাসের ব্যবধানে। এ রকম অসংখ্য কম্পানির দর উঠেছিল ২০০ থেকে ৩০০ ভাগ।
No comments