দেশের বর্তমান সংকটে জনগণ কী চায়? by গাজীউল হাসান খান
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার প্রায় সোয়া বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের যে রায়ে স্বাক্ষর করেছেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, তা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটকে নতুন করে আবার এক দ্বন্দ্ব ও সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে রায় ঘোষণার এক বছর চার মাস পাঁচ দিন পর গত রবিবার রাতে যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে আরো বলা হয়েছে- জনগণের নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের দ্বারাই গঠিত হতে হবে বলে বিচারকরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি আরো বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ দিয়ে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংস্কার করে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। সংসদের সে স্বাধীনতা রয়েছে। অপরদিকে পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই বর্তমান সরকার গত বছর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধান ঘোষণা করে একটি বিল পাস করেছে। তাতে জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে জনগণের নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিবর্তে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নকে আরো জটিল এবং সাংঘর্ষিক করে তোলা হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
জাতীয় সংসদের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে মহাজোট নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে একটি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার করেছেন। আর তা হলো- দেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তবে বিরোধী দল বা জোটের সঙ্গে আপস-নিষ্পত্তির স্বার্থে বড়জোর তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) নেতৃত্বে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিরোধী দল বা জোটের সদস্যরাও যোগ দেওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। উল্লেখ্য, এ ব্যাপারে তিনি এখনো বিশদভাবে কিছু উল্লেখ করেননি। এবং এ বিষয়টি নিয়ে এখনো তেমন কোনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী বা ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত ব্যবস্থা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি ইতিমধ্যে কয়েকবারই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়া দাবি করেছেন একটি সম্পূর্ণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুবা তাঁরা দেশে কোনো সাধারণ নির্বাচন হতে দেবেন না- অর্থাৎ জনগণকে নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। এ থেকে এখন একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের দুটি প্রধান দল বা জোটের মধ্যে কোনো সমঝোতা বা রফা না হলে একটি রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষ অত্যাসন্ন। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে যদিও বলা হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংস্কার করে সংবিধান সংশোধন করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার জাতীয় সংসদের রয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার ওপরই তা এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করছে। সংসদে একটি বিল এনে অতীতের মতো (১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার যা করেছে) একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার বিধান করতে হবে। একমাত্র তা হলেই আগামী সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও কারচুপিমুক্ত হতে পারে। কিন্তু তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একটি অংশের সন্দেহ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথে যাবেন কি না!
দলীয় কিংবা জোটগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অবস্থান যে খুব একটা শক্তিশালী কিংবা সুসংহত নয়, তা আশা করি তিনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন। জাতীয় সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন অথচ পারছেন না সর্বস্তরে দুর্নীতি বন্ধ করতে। পদ্মা সেতুর পর একে একে ডেসটিনি ও হলমার্কসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎসংক্রান্ত কেলেঙ্কারি, অর্থমন্ত্রীর বিকারগ্রস্ত উক্তি ও আচরণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চরম ব্যর্থতা, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি- কোনো কিছুই বর্তমান সরকারের পক্ষে কিংবা দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের পক্ষে যায়নি। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে উন্নয়ন ও বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিশ্বব্যাপী সভ্য নাগরিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশে পোশাক প্রস্তুতকারী শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্যের মধ্যে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকেও সরকার এগিয়ে যেতে দেয়নি। আজও কক্সবাজার পর্যটন নগরীর এরিয়া প্ল্যানটি সরকার অনুমোদন দেওয়ার সময় পায়নি। ফলে সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা ও জমির অপব্যবহার। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তিন হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের কথা বলা হলেও 'কুইক রেন্টাল' পদ্ধতি গোগ্রাসে হজম করেছে একটি দরিদ্র দেশের ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি। কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের যা-ও সামান্য কিছু সাফল্য রয়েছে, তা-ও ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কারণে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কলঙ্কের ইতিহাস বিগত চারদলীয় জোট সরকার যেমন এখনো ঢাকতে পারেনি, তেমনি বর্তমান মহাজোট সরকারকেও ভবিষ্যতে যথাযথভাবে জবাবদিহিতার জন্য জনগণের সম্মুখীন হতে হবে। সম্মুখীন হতে হবে বিচার বিভাগীয় বিশদ তদন্ত ও সত্যের।
দুর্নীতিই শুধু বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় নয়। যথাযোগ্য নেতৃত্বের সংকট বা ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নও একটি জাতির উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে বিরাট ভূমিকা পালন করে। সর্বস্তরে দলীয়করণ করে দিন বদল করা যায় না। তাহলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা গায়ের জোরেই সব কিছু করে ফেলতে পারত। দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির জন্য মেধাসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হতো না। অর্থের অভাবে দেশের একটি অন্যতম অর্থনৈতিক 'লাইফ লাইন' ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের রাস্তার কাজ কাঙ্ক্ষিতভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। কেন এডিপি অর্থায়নে সাহায্যদাতাদের অর্থ ডিসবার্সমেন্ট হচ্ছে না অথচ পাইপলাইনে আছে- সেগুলো দেখার কি মানুষ নেই? সরকারের অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিব এবং এত পরামর্শদাতা কী করেন? আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো কি পর্যালোচনা করে দেখা হয় না? জাতীয় আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক উৎসগুলো বিবেচনা করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে মনে হচ্ছে না। বরং সরকারি অর্থ আত্মসাতের ধান্দায় বড় বড় প্রকল্প নিয়ে যেন সবাই ব্যস্ত। সৎ ও কর্মঠ মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তারা তেমন হারে ঋণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কতিপয় রাঘব বোয়াল। সরকারের নেতা-নেত্রী ও প্রভাবশালী লোকদের সেখানে কোনো হাত নেই- এ কথা কিভাবে বিশ্বাস করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এ কথাগুলো কোনো মতেই আমাদের উপলব্ধির মধ্যে আসছে না।
এ সামগ্রিক অবস্থার মধ্যে মন্ত্রিসভায় রদবদল এনেছেন মহাজোট নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরই দলের (আওয়ামী লীগ) একজন বিচক্ষণ জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং জোটের অন্য এক প্রগতিশীল নেতা রাশেদ খান মেনন। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা এবং ঝঞ্ঝার লক্ষণ দেখে পিছিয়ে গেছেন। মহাজোট সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ অভিযোগ করেছেন, তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করা একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। মন্ত্রিত্ব না নিয়ে তোফায়েল সাহেব নাকি দলকে ছোট ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন এবং তাঁর এলাকাবাসীকে বঞ্চিত করেছেন। দলের সিদ্ধান্তকে অপমান করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তা-ই ঘটেছে? মন্ত্রিত্ব না নেওয়ার জন্য এলাকাবাসী পুষ্পস্তবক উপহার দিয়েছে তোফায়েল আহমেদকে। জনগণ সাধুবাদ দিয়েছে বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননকে। সময় থাকতে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের পরিহার করে গেছেন। শুনেননি তাঁদের কোনো সাবধান বাণী। এসব অভিজ্ঞ রাজনীতিককে শুরুতে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী না করে ক্ষেত্রবিশেষে কতিপয় অর্বাচীন ও আজ্ঞাবহকে মন্ত্রী করে সফলভাবে দেশ পরিচালনার সব কৃতিত্ব একাই নিতে চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পদে পদে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও আগে তাঁর সম্বিত ফেরেনি। শেষ মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় রদবদল আনার 'রুটিন কাজে' হাত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জনগণের কাছে তা সাদরে গৃহীত কিংবা নন্দিত হয়নি। সরকারের কিছু লোক ভাবতেন, তাঁরা বিশ্বব্যাংকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ওবামা সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। এখন তাঁদের শুভ চেতনার উদয় হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি থেকে আগাম শিক্ষা নেওয়া উচিত বিএনপি কিংবা ১৮ দলীয় জোটের নেতা-নেত্রীদের। নিজেদের অতীত থেকে যদি শিক্ষা নাও নিয়ে থাকেন, তবে বর্তমান মহাজোট সরকারের অবস্থা দেখে তাঁদের শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। অর্বাচীন ও দুর্নীতিবাজদের দিয়ে দেশ চালানো মোটেও সম্ভব নয়। এত কিছুর পরেও মনে করি, আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের শরিক দলগুলো দেশপ্রেমিক। সবাই দুর্নীতিবাজ, অর্বাচীন ও তোষামোদকারী নন। অগণিত মানুষের রক্ত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত দেশটাকে তাঁরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। সুতরাং সামনে যে স্বল্প সময়টুকু রয়েছে, তা যেন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহলের দুর্নীতি, লুটপাট ও অনাচার বন্ধ করে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মুছে দিতে চেষ্টা করে পেছনের সব কলঙ্ক ও কালিমা। তারা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু, দেশ ও জাতিকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসলে অনেক কিছুই সাধন করতে পারবে। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক কিংবা একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ইস্যুটিকে সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করলে দেশ একটি অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের হাত থেকে নিস্তার পাবে। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়োচিত এবং যথাযথ রাজনৈতিক পদক্ষেপ জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটেরও একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছার দায়িত্ব রয়েছে অপরিসীম।
(লন্ডন)
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
জাতীয় সংসদের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে মহাজোট নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে একটি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার করেছেন। আর তা হলো- দেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তবে বিরোধী দল বা জোটের সঙ্গে আপস-নিষ্পত্তির স্বার্থে বড়জোর তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) নেতৃত্বে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিরোধী দল বা জোটের সদস্যরাও যোগ দেওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। উল্লেখ্য, এ ব্যাপারে তিনি এখনো বিশদভাবে কিছু উল্লেখ করেননি। এবং এ বিষয়টি নিয়ে এখনো তেমন কোনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী বা ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত ব্যবস্থা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি ইতিমধ্যে কয়েকবারই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়া দাবি করেছেন একটি সম্পূর্ণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুবা তাঁরা দেশে কোনো সাধারণ নির্বাচন হতে দেবেন না- অর্থাৎ জনগণকে নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। এ থেকে এখন একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের দুটি প্রধান দল বা জোটের মধ্যে কোনো সমঝোতা বা রফা না হলে একটি রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষ অত্যাসন্ন। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে যদিও বলা হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংস্কার করে সংবিধান সংশোধন করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার জাতীয় সংসদের রয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার ওপরই তা এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করছে। সংসদে একটি বিল এনে অতীতের মতো (১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার যা করেছে) একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার বিধান করতে হবে। একমাত্র তা হলেই আগামী সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও কারচুপিমুক্ত হতে পারে। কিন্তু তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একটি অংশের সন্দেহ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথে যাবেন কি না!
দলীয় কিংবা জোটগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অবস্থান যে খুব একটা শক্তিশালী কিংবা সুসংহত নয়, তা আশা করি তিনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন। জাতীয় সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন অথচ পারছেন না সর্বস্তরে দুর্নীতি বন্ধ করতে। পদ্মা সেতুর পর একে একে ডেসটিনি ও হলমার্কসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎসংক্রান্ত কেলেঙ্কারি, অর্থমন্ত্রীর বিকারগ্রস্ত উক্তি ও আচরণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চরম ব্যর্থতা, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি- কোনো কিছুই বর্তমান সরকারের পক্ষে কিংবা দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের পক্ষে যায়নি। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে উন্নয়ন ও বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিশ্বব্যাপী সভ্য নাগরিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশে পোশাক প্রস্তুতকারী শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্যের মধ্যে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকেও সরকার এগিয়ে যেতে দেয়নি। আজও কক্সবাজার পর্যটন নগরীর এরিয়া প্ল্যানটি সরকার অনুমোদন দেওয়ার সময় পায়নি। ফলে সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা ও জমির অপব্যবহার। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তিন হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের কথা বলা হলেও 'কুইক রেন্টাল' পদ্ধতি গোগ্রাসে হজম করেছে একটি দরিদ্র দেশের ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি। কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের যা-ও সামান্য কিছু সাফল্য রয়েছে, তা-ও ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কারণে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কলঙ্কের ইতিহাস বিগত চারদলীয় জোট সরকার যেমন এখনো ঢাকতে পারেনি, তেমনি বর্তমান মহাজোট সরকারকেও ভবিষ্যতে যথাযথভাবে জবাবদিহিতার জন্য জনগণের সম্মুখীন হতে হবে। সম্মুখীন হতে হবে বিচার বিভাগীয় বিশদ তদন্ত ও সত্যের।
দুর্নীতিই শুধু বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় নয়। যথাযোগ্য নেতৃত্বের সংকট বা ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নও একটি জাতির উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে বিরাট ভূমিকা পালন করে। সর্বস্তরে দলীয়করণ করে দিন বদল করা যায় না। তাহলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা গায়ের জোরেই সব কিছু করে ফেলতে পারত। দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির জন্য মেধাসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হতো না। অর্থের অভাবে দেশের একটি অন্যতম অর্থনৈতিক 'লাইফ লাইন' ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের রাস্তার কাজ কাঙ্ক্ষিতভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। কেন এডিপি অর্থায়নে সাহায্যদাতাদের অর্থ ডিসবার্সমেন্ট হচ্ছে না অথচ পাইপলাইনে আছে- সেগুলো দেখার কি মানুষ নেই? সরকারের অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিব এবং এত পরামর্শদাতা কী করেন? আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো কি পর্যালোচনা করে দেখা হয় না? জাতীয় আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক উৎসগুলো বিবেচনা করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে মনে হচ্ছে না। বরং সরকারি অর্থ আত্মসাতের ধান্দায় বড় বড় প্রকল্প নিয়ে যেন সবাই ব্যস্ত। সৎ ও কর্মঠ মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তারা তেমন হারে ঋণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কতিপয় রাঘব বোয়াল। সরকারের নেতা-নেত্রী ও প্রভাবশালী লোকদের সেখানে কোনো হাত নেই- এ কথা কিভাবে বিশ্বাস করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এ কথাগুলো কোনো মতেই আমাদের উপলব্ধির মধ্যে আসছে না।
এ সামগ্রিক অবস্থার মধ্যে মন্ত্রিসভায় রদবদল এনেছেন মহাজোট নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরই দলের (আওয়ামী লীগ) একজন বিচক্ষণ জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং জোটের অন্য এক প্রগতিশীল নেতা রাশেদ খান মেনন। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা এবং ঝঞ্ঝার লক্ষণ দেখে পিছিয়ে গেছেন। মহাজোট সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ অভিযোগ করেছেন, তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করা একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। মন্ত্রিত্ব না নিয়ে তোফায়েল সাহেব নাকি দলকে ছোট ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন এবং তাঁর এলাকাবাসীকে বঞ্চিত করেছেন। দলের সিদ্ধান্তকে অপমান করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তা-ই ঘটেছে? মন্ত্রিত্ব না নেওয়ার জন্য এলাকাবাসী পুষ্পস্তবক উপহার দিয়েছে তোফায়েল আহমেদকে। জনগণ সাধুবাদ দিয়েছে বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননকে। সময় থাকতে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের পরিহার করে গেছেন। শুনেননি তাঁদের কোনো সাবধান বাণী। এসব অভিজ্ঞ রাজনীতিককে শুরুতে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী না করে ক্ষেত্রবিশেষে কতিপয় অর্বাচীন ও আজ্ঞাবহকে মন্ত্রী করে সফলভাবে দেশ পরিচালনার সব কৃতিত্ব একাই নিতে চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পদে পদে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও আগে তাঁর সম্বিত ফেরেনি। শেষ মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় রদবদল আনার 'রুটিন কাজে' হাত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জনগণের কাছে তা সাদরে গৃহীত কিংবা নন্দিত হয়নি। সরকারের কিছু লোক ভাবতেন, তাঁরা বিশ্বব্যাংকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ওবামা সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। এখন তাঁদের শুভ চেতনার উদয় হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি থেকে আগাম শিক্ষা নেওয়া উচিত বিএনপি কিংবা ১৮ দলীয় জোটের নেতা-নেত্রীদের। নিজেদের অতীত থেকে যদি শিক্ষা নাও নিয়ে থাকেন, তবে বর্তমান মহাজোট সরকারের অবস্থা দেখে তাঁদের শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। অর্বাচীন ও দুর্নীতিবাজদের দিয়ে দেশ চালানো মোটেও সম্ভব নয়। এত কিছুর পরেও মনে করি, আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের শরিক দলগুলো দেশপ্রেমিক। সবাই দুর্নীতিবাজ, অর্বাচীন ও তোষামোদকারী নন। অগণিত মানুষের রক্ত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত দেশটাকে তাঁরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। সুতরাং সামনে যে স্বল্প সময়টুকু রয়েছে, তা যেন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহলের দুর্নীতি, লুটপাট ও অনাচার বন্ধ করে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মুছে দিতে চেষ্টা করে পেছনের সব কলঙ্ক ও কালিমা। তারা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু, দেশ ও জাতিকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসলে অনেক কিছুই সাধন করতে পারবে। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক কিংবা একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ইস্যুটিকে সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করলে দেশ একটি অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের হাত থেকে নিস্তার পাবে। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়োচিত এবং যথাযথ রাজনৈতিক পদক্ষেপ জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটেরও একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছার দায়িত্ব রয়েছে অপরিসীম।
(লন্ডন)
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
No comments