দ্রোহ নয় বিদ্রোহ by ইমরুল চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ব মানচিত্রে গত চার দশক ধরে প্রাদেশিকতার গণ্ডি পেরিয়ে একটি সার্বভৌম দেশের রাজধানী। ঢাকা এখন তিলোত্তমা। কম গৌরবের বিষয় নয় যে, আমি বা আপনি এবং আমাদের মতো এক কোটির ওপর অধিবাসী এই শহরের বাসিন্দা। সপ্তম শতাব্দীতে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে যে শাহরিক ভিত্তি রচিত হয়েছিল তা এখন আর চকবাজার-শাঁখারীবাজার-তাঁতীবাজার-চক-মোগলটুলিতে সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাস-বিস্তৃতি, আকার-আয়তন বেড়েছে সহস্রগুণ। স্টম্ফীত জনপদের


ঢাকা এখন উত্তরায়। ঢাকা এখন বারিধারায়। ঢাকা এখন বসুন্ধরায়। ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁর হাত ধরে যে 'জাহাঙ্গীরনগর' শহরের গোড়াপত্তন, ওই দশকের মধ্যভাগে শায়েস্তা খাঁর শাসনামলে যে শহরের পরিপূর্ণ বিস্তৃতি, 'পলাশী যুদ্ধে'র অব্যবহিত পর আবার 'ঢাকা' নামে পরিচিত হয় এই শহর। যদিও ইংরেজি বানানের ক্ষেত্রে গত শতকে খানিকটা হেরফের ঘটেছে। সারাবিশ্বে খুবই নগণ্যসংখ্যক শহর রয়েছে, জনসংখ্যায় যা ঢাকার সমান। গত এক শতাব্দী ধরে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের দোলাচলে আবর্তিত এই যে জনাকীর্ণ ঢাকা শহর, কীভাবে আপনি তাকে দেখতে চান? একটা সময় ছিল যখন ঢাকা শহরকে বলা হতো মসজিদের নগরী। তাও ভালো। অন্তত স্থাপত্যকলার বিবেচনায় নির্মিত মসজিদের একটি অনুপম সৌন্দর্য তো বিদ্যমান ছিল। যদিও এখন তা ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
কী দিয়ে ঢাকা শহরকে ঢেকে রাখছি আমরা? কী কারণে প্রিয় ঢাকা শহরকে মুগ্ধ নয়নজুড়ে দেখতে পারছি না আমরা? পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, কারণ ঢাকা যে ঢেকে আছে ৪০ী১৫ ফুট চটকদার বিজ্ঞাপন সজ্জিত বিলবোর্ডের অন্তরালে। মসজিদের নগরী নয়, বর্তমানে ঢাকা শহর যেন চক্ষুযুগলের বিরক্তি উদ্রেককারী বিলবোর্ডের আহামরি এক অনাকাঙ্ক্ষিত আয়োজন।
হোটেল শেরাটন অধুনা নামাঙ্কিত রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে যে পরিমাণ বিলবোর্ডের শোভা আপনি দেখতে পান, বোধকরি গোটা নিউইয়র্ক শহরে এই পরিমাণ বিলবোর্ডের অস্তিত্ব রয়েছে কি-না আমার সন্দেহ। স্টিল স্ট্রাকচারের ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্মিত এসব বিলবোর্ডের কোনোটিতে পণ্যের বিজ্ঞাপন, কোনোটিতে আবাসন শিল্পের। অত্যধিক জনসংখ্যার ভারে ঢাকা শহর যেমন গিজগিজ করছে, রূপসী বাংলার বিপরীতেও যেন বিলবোর্ডের একপ্রকার গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি সহাবস্থান। শুধু কি তা-ই? ঢাকা শহরজুড়ে অনেক রাজপথ কি বিলবোর্ড দ্বারা আচ্ছাদিত নয়?
বিলবোর্ড নগরীর কোনো সৌন্দর্য বহন করে না। বরং একটি শহরের সৌন্দর্যের অবলোকন থেকে নগরবাসীকে বঞ্চিত করা হয়। যত্রতত্র বিলবোর্ড, যেখানে-সেখানে বিলবোর্ড! ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধিকর্তারা শুধু বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি প্রদানেই সীমিত নন, অধিকন্তু তারা ব্যস্ততম রাস্তার দু'পাশে চিত্তাকর্ষক বেল সাইন এবং ইলেকট্রিক খুঁটিতে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে নগরবাসীকে হতচকিত করে তুলছেন। প্রতিটি বিজলি বাতির খুঁটিতে 'রবি সেল ফোনের' বিজ্ঞাপন যেন অস্তমিত হতে চায় না।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের এতই কি অর্থ সংকট যে, বিলবোর্ড থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে তাদের প্রশাসনিক কিংবা অন্য কোনো ব্যয়ভার বহন করা হয়? তাহলে কী পরিমাণ অর্থ ডিসিসি এই খাত থেকে অর্জন করে থাকে? যদি তা হয় খুবই নগণ্য, তাহলে দোহাই, একটি শহরের রমণীয় সৌন্দর্যের ওপর অযথা কোনো প্রলেপ জড়াবেন না।
আমি সাংবাদিক নই। আমার কোনো অনুসন্ধিৎসু অভিপ্রায় নেই। নেহাত একজন নব্য কলাম লেখক। বিলবোর্ড স্থাপনকারী বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ডিসিসির কর্মকর্তাদের 'গিভ অ্যান্ড টেক'-এর ব্যাপারে আমি উৎসাহী নই। আমি শুধু নগরের সৌন্দর্য যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে ব্যাপারে খানিকটা উদ্বিগ্ন।
কই শহরের অনেক রাস্তাঘাট তো দিনের পর দিন অপরিষ্কার থেকে যাচ্ছে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে রাজপথে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, সেদিকটা ডিসিসির কোনো কর্মকর্তার কেন নজর কাড়ে না? তাহলে বিলবোর্ড স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা এত উৎসাহী ও তৎপর কেন? আমি বা আপনি, আমরা তো সবাই চাই একটি ছিমছাম পরিচ্ছন্ন শহর। দূষিত বায়ু সেবন করে রাস্তায় হাঁটব বা কোথাও থেকে নাসারন্ধ্রে উৎকট গন্ধ ভেসে পাকস্থলীর উদ্গিরণ শুরু হবে তা কি কোনো নগরবাসীর কাম্য? ডিসিসি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, তারা যেন আমাদের একটি সুপরিকল্পিত, দৃষ্টিনন্দন ও বিন্যস্ত রাজধানী শহর উপহার দেয়, যাতে করে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারি_ 'প্রাচ্যের শুদ্ধতম নগরী ঢাকা_ আমার গর্বিত ঠিকানা।'

ইমরুল চৌধুরী : সাবেক সংবাদ পাঠক, কবি ও শিশুসাহিত্যিক
adkingltd@yahoo.com

1 comment:

Powered by Blogger.