পাকিস্তানে দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমে নারী সম্মেলন by রোজী ফেরদৌস
ঘুমন্ত নগরী লাহোর যখন আড়মোড়া ভাঙছিল ১০ অক্টোবরের সুবেহ সাদেকে, আমরা বাংলাদেশের ক’জন নারী সাংবাদিক তখন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেখানে প্রবেশ করেছিলাম। প্রথম দর্শনে প্রায় সবকিছুতেই একটা জানার অভীপ্সা থাকে। ভোরের নীরবতায় থাকে একটা পরিচ্ছন্নতা। চারদিকে চোখ মেলে যখন শহরটাকে দেখছিলাম তখন ভোরের কাগজের কূটনৈতিক সংবাদদাতা বলে উঠলেন, ‘এরা তো দেখি ভালোই এগিয়েছে।’ তখন আমরা পার হচ্ছিলাম আবিদ মজিদ রোড, স্বামী রোডের রাজপথ।
দেখলাম চারদিকে উন্নয়নের ছোঁয়া। সাজানো-গোছানো বাড়ি-ঘর। বড় বড় রাস্তাঘাট, দোকানপাট, সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। নির্মিত হচ্ছে সুদীর্ঘ ফ্লাইওভার। তবে আমাদের চারদিনের সফরে কোথাও কখনও যানজট দেখিনি।
সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া বা ‘সওম’-এর পাকিস্তান পক্ষ থেকে আসা গাইড আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা গুলবার্গ এলাকার হোটেল সানফোর্টে নিয়ে এলো। যেতে হবে শহরাহ-কায়েদ-ই-আযম রোডের হোটেল আভারি লাহোরে। আমাদের দলনেত্রী ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সাবেক প্রথম নারী বার্তা সম্পাদক ও ১৯৮৯ সালে গঠিত বাংলাদেশ মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি রাশেদা আমিন, বাংলাদেশ সময়ের ফিচার সম্পাদক ও বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসিমুন আরা হক। আরও ছিলেন পাক্ষিক অনন্যার নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা খান, ফিদ্ধল্যান্স সাংবাদিক ও দৈনিক জনকণ্ঠের অর্থনৈতিক পাতার সাবেক সম্পাদক পারভীন সুলতানা যিনি সওমের কো-অর্ডিনেটরও বটে, ছিলেন দৈনিক দিনকালের সিনিয়র রিপোর্টার ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা চৌধুরী, ফিদ্ধল্যান্স সাংবাদিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাব এডিটর ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সহ-সভাপতি এই প্রতিবেদক, দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাব এডিটর ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের যুগ্ম-সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, রোজিনা আকতার, বৈশাখী টিভির সাবেক নিউজরুম এডিটর আখতার জাহান মালিক, টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার রিপোর্টার এবং নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সদস্য নাদিরা কিরণ, দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার ও ভোরের কাগজের সাংবাদিক এবং নারী উন্নয়ন কেন্দ্রের সদস্য আঙ্গুুর নাহার মন্টি, ইটিভি’র খাগড়াছড়ি রিপোর্টার চিনমেপুরা মারমা ও দৈনিক আমাদের সময় এবং চ্যানেল ওয়ানের সাবেক সাংবাদিক ফারজানা লাবনি।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী সাংবাদিকরা নারী শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে প্রথমবারের মতো সংগঠিত হয়েছিলেন। এর মিলনস্থল ছিল লাহোর। অক্টোবরের ১০ ও ১১ তারিখ ২০০৯-এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। শিরোনাম ছিল ‘চ্যালেঞ্জেস, অপরচুনিটিস অ্যান্ড পার্টনারশিপ’ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও আয়োজক দেশ পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত আটটি দেশের প্রায় দেড়শ’ নারী সাংবাদিক এ সম্মেলনে যোগ দেন।
সম্মেলন শুরু হলো সাড়ে ১০টার দিকে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বুশরা সুলতানা। ‘বেইজিং প্লাটফর্ম অ্যান্ড স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন সাউথ এশিয়ান মিডিয়া’ বিষয়ে বললেন, তুখোড় বক্তা নেপালের বন্দনা রানা। তিনি নারী সমাজের বিভিন্ন বঞ্চনার কথা তুলে ধরলেন। বললেন, সমাধানের পথ। আরো বললেন, ভারত থেকে আসা চলচ্চিত্র ও মানবাধিকার কর্মী বিশিষ্ট অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। তিনি নারীর আত্মপরিচয় নিয়ে বলে গেলেন অনর্গল।
আমাদের মূল সংগঠন সাউথ এশিয়ান ফিদ্ধ মিডিয়া এসোসিয়েশনের (সাফমা) সেক্রেটারি জেনারেল ইমতিয়াজ আলম সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরলেন। বললেন, সওম গঠনের প্রচেষ্টার কথা। এই ইমতিয়াজ আলমকে সাফমা গঠনের প্রথম থেকে অদ্যাবধি দেখেছি এক অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ নেতা হিসেবে, যিনি বাংলাদেশের রিয়াজউদ্দিন আহমদ, জাহিদুজ্জামান ফারুক, ইকবাল সোবহানের মতো তারকা সাংবাদিকের সঙ্গে সাফমা’র পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে। বস্তুনিষ্ঠ, মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করছেন অন্তহীন উদ্যম নিয়ে।
বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নেত্রী রাশেদা আমিন সাংবাদিকতায় নারীদের অধিকার আদায়ের কথা বললেন।
নাসিমুন আরা হক সাংবাদিক নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে, পদোন্নতি ও বেতনের সমতার কথা বললেন।
রেহানা হাকিম পাকিস্তানের এক জাঁদরেল সাংবাদিক। বুদ্ধিমত্তায়, বাগ্মীতায়, আচরণের স্তরে স্তরে তার মেধার ঝলক নারী সম্মেলনকে চমকিত করেছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি মননে নারীর সার্বিক অবস্থান বিশ্লেষণে তিনি যেন দেড়শ’ সাংবাদিকের হৃদয়ের কথা তুলে ধরলেন।
সওম’এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জেবুন্নেসা বারকির নজর ছিল সবদিকে। তিনি তার ক্ষিপ্রধার যোগাযোগ ব্যক্তিত্ব দিয়ে, মেধাসম্পন্ন উপস্থাপনা দিয়ে সবাইকে চমত্কৃত করলেন। জেবুন্নেসা ব্যতিরেকে এতবড় একটি সম্মেলন সফল করা যেন ছিল দুঃসাধ্য। সম্মেলনে দেরিতে হলেও উপস্থিত হয়েছিলেন ফেডারেল মিনিস্টার ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিংয়ের জনাব কামারুজ্জামান কায়রা। তিনি গিলগিট বেলুচিস্তানের গভর্নরও। উপস্থিত সাংবাদিকদের নিজ দেশে স্বাগত জানিয়ে তিনি মহিলাদের কষ্টকর পথ-পরিক্রমার কথা তুলে ধরলেন। তিনি পত্রিকা ও টিভি মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বললেন, আপনারা তাদের উত্সাহিত করুন। তারা যেন কোনো রকম লাঞ্ছনার শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বললেন, আমরা লড়াই করছি সবদিকে। যারা নারীর প্রতি সহিংস হয় তাদের বিরুদ্ধে এবং যারা দেশে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। এ কারণে গোটা বিশ্ব আমাদের সমর্থন জানাচ্ছে। তিনি বললেন, ভারত বলছে, ‘নো মোর ডায়ালগ’ বা কোনো আলোচনা নয়। এটা ঠিক নয়। এ পথ খোলা রাখতে হবে। বললেন, সার্ক ফোরাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এই ফোরাম গোটা অঞ্চলের জন্য প্রয়োজন। বললেন, পাকিস্তান শান্তি চায়। চায় সবার সহযোগিতা।
এরপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো হলো তথ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার জন্য। পাকিস্তানের এক নারী সাংবাদিক অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বললেন আপনি কেন ‘ জিও টিভি’ বন্ব্দ করে দিলেন? মন্ত্রীও ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বললেন, আমাদেরও কিছু নীতিমালা রয়েছে। ‘জিও টিভি’ অব্যাহতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসছিল। আমাদের রাশেদা আমিন বাংলাদেশে আটকেপড়া বিহারিদের কবে ফেরত নেয়া হবে জানতে চাইলেন। তথ্যমন্ত্রী বললেন, এ ব্যাপারে কাজ চলছে। আমরা তাদের ফিরিয়ে আনব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, আজকাল পত্রিকার চিফ রিপোর্টার মধুমিতা দত্ত সাংবাদিক নারীদের নানা সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরলেন। বিকেলে ৪টি বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটির কাজ শুরু হলো। এই কমিটিগুলোতে আমরা সব সাংবাদিক ভাগাভাগি হয়ে কাজ করলাম।
দ্বিতীয় দিনে ওয়ার্কিং কমিটির সুপারিশ মূল্যায়ন ও ‘সওম’এর আঞ্চলিক সম্মেলনের ডিক্লারেশন ড্রাফট পেশ করা হলো। এর আগে দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন পাঞ্জাবের গভর্নর জনাব সালমান তাসির তার গভর্নর হাউসে।
পাঞ্জাব গভর্নর স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন। তিনি নারী স্বাধীনতার কথা বললেন। বললেন, তার দেশের নারী নেত্রী পিপলস পার্টি প্রধান বেনজির ভুট্টোর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা। বললেন, আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সব প্রদেশের সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি।
রাতে পুনরায় রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী কামার জানান কায়রা। সেখানে গিয়ে দেখি স্ললস্থুল কাণ্ড। বিশাল এক মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে মরস্লমা গায়িকা ইকবাল বানুর ছবি। ইকবাল বানু পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক বিখ্যাত নাম। এক কিংবদন্তী। আয়োজনের স্থান ছিল লাহোরের পার্ল কন্টিনেন্টালের শাহী খেমায়। ইকবাল বানু স্মরণে লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ইকবাল বানুর গানগুলো গাইলেন বর্তমান প্রজন্মের গায়িকারা।
‘গুমনাম’ ছায়াছবির সঙ্গীত পরিবেশন করলেন গায়িকা কিরন। তিনি গাইলেন, ‘পায়েল কি গীত ছমছম কি।’ মনে হলো একজন প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে এমন অনুষ্ঠান বোধকরি সাংস্কৃতিক উচ্চতার দেশ পাকিস্তানই করতে পারে!
ফিরে আসতে আসতে আমাদের সম্মেলনের কথা মনে হলো। মনে হলো এই যে প্রায় দেড়শ’ সাংবাদিক নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা কি পারবেন স্ব-স্ব দেশের চিরবঞ্চিত, চির অবহেলিত, নারীর দুর্দশা দূর করতে? তবু পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী শেরি রহমান, সাংবাদিক রেহানা হাকিম, আমাদের দেশের রাশেদা, মাহমুদা চৌধুরী, নাসিমুন, ভুটানের কেজাং চোডেন ও শ্রীলংকার শর্মিনি বোয়েল যিনি এবারে ২ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বলতে হবে আমরা এগিয়ে যাব।
যত বাধাই আসুক, প্রতিহত করব। করব প্রতিবাদ। অচলায়তনের এ পাহাড় ভাঙব। দেশের ১৫ কোটি মানুষের অর্ধেক নারীকে ‘অপর অংশের সুন্দর জীবনের জন্যই’ আমাদের এগুতে হবে। সে তারা বুঝুন আর নাই বুঝুন। নারী সাংবাদিকের কাজ দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক শুধু নয়—হতে হবে শত হাজার মাত্রিক। তবেই এ ধরনের সম্মেলনের সার্থকতা।
সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া বা ‘সওম’-এর পাকিস্তান পক্ষ থেকে আসা গাইড আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা গুলবার্গ এলাকার হোটেল সানফোর্টে নিয়ে এলো। যেতে হবে শহরাহ-কায়েদ-ই-আযম রোডের হোটেল আভারি লাহোরে। আমাদের দলনেত্রী ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সাবেক প্রথম নারী বার্তা সম্পাদক ও ১৯৮৯ সালে গঠিত বাংলাদেশ মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি রাশেদা আমিন, বাংলাদেশ সময়ের ফিচার সম্পাদক ও বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসিমুন আরা হক। আরও ছিলেন পাক্ষিক অনন্যার নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা খান, ফিদ্ধল্যান্স সাংবাদিক ও দৈনিক জনকণ্ঠের অর্থনৈতিক পাতার সাবেক সম্পাদক পারভীন সুলতানা যিনি সওমের কো-অর্ডিনেটরও বটে, ছিলেন দৈনিক দিনকালের সিনিয়র রিপোর্টার ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা চৌধুরী, ফিদ্ধল্যান্স সাংবাদিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাব এডিটর ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের সহ-সভাপতি এই প্রতিবেদক, দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাব এডিটর ও মহিলা সাংবাদিক ফোরামের যুগ্ম-সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, রোজিনা আকতার, বৈশাখী টিভির সাবেক নিউজরুম এডিটর আখতার জাহান মালিক, টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার রিপোর্টার এবং নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সদস্য নাদিরা কিরণ, দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার ও ভোরের কাগজের সাংবাদিক এবং নারী উন্নয়ন কেন্দ্রের সদস্য আঙ্গুুর নাহার মন্টি, ইটিভি’র খাগড়াছড়ি রিপোর্টার চিনমেপুরা মারমা ও দৈনিক আমাদের সময় এবং চ্যানেল ওয়ানের সাবেক সাংবাদিক ফারজানা লাবনি।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী সাংবাদিকরা নারী শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে প্রথমবারের মতো সংগঠিত হয়েছিলেন। এর মিলনস্থল ছিল লাহোর। অক্টোবরের ১০ ও ১১ তারিখ ২০০৯-এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। শিরোনাম ছিল ‘চ্যালেঞ্জেস, অপরচুনিটিস অ্যান্ড পার্টনারশিপ’ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও আয়োজক দেশ পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত আটটি দেশের প্রায় দেড়শ’ নারী সাংবাদিক এ সম্মেলনে যোগ দেন।
সম্মেলন শুরু হলো সাড়ে ১০টার দিকে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বুশরা সুলতানা। ‘বেইজিং প্লাটফর্ম অ্যান্ড স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন সাউথ এশিয়ান মিডিয়া’ বিষয়ে বললেন, তুখোড় বক্তা নেপালের বন্দনা রানা। তিনি নারী সমাজের বিভিন্ন বঞ্চনার কথা তুলে ধরলেন। বললেন, সমাধানের পথ। আরো বললেন, ভারত থেকে আসা চলচ্চিত্র ও মানবাধিকার কর্মী বিশিষ্ট অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। তিনি নারীর আত্মপরিচয় নিয়ে বলে গেলেন অনর্গল।
আমাদের মূল সংগঠন সাউথ এশিয়ান ফিদ্ধ মিডিয়া এসোসিয়েশনের (সাফমা) সেক্রেটারি জেনারেল ইমতিয়াজ আলম সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরলেন। বললেন, সওম গঠনের প্রচেষ্টার কথা। এই ইমতিয়াজ আলমকে সাফমা গঠনের প্রথম থেকে অদ্যাবধি দেখেছি এক অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ নেতা হিসেবে, যিনি বাংলাদেশের রিয়াজউদ্দিন আহমদ, জাহিদুজ্জামান ফারুক, ইকবাল সোবহানের মতো তারকা সাংবাদিকের সঙ্গে সাফমা’র পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে। বস্তুনিষ্ঠ, মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করছেন অন্তহীন উদ্যম নিয়ে।
বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নেত্রী রাশেদা আমিন সাংবাদিকতায় নারীদের অধিকার আদায়ের কথা বললেন।
নাসিমুন আরা হক সাংবাদিক নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে, পদোন্নতি ও বেতনের সমতার কথা বললেন।
রেহানা হাকিম পাকিস্তানের এক জাঁদরেল সাংবাদিক। বুদ্ধিমত্তায়, বাগ্মীতায়, আচরণের স্তরে স্তরে তার মেধার ঝলক নারী সম্মেলনকে চমকিত করেছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি মননে নারীর সার্বিক অবস্থান বিশ্লেষণে তিনি যেন দেড়শ’ সাংবাদিকের হৃদয়ের কথা তুলে ধরলেন।
সওম’এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জেবুন্নেসা বারকির নজর ছিল সবদিকে। তিনি তার ক্ষিপ্রধার যোগাযোগ ব্যক্তিত্ব দিয়ে, মেধাসম্পন্ন উপস্থাপনা দিয়ে সবাইকে চমত্কৃত করলেন। জেবুন্নেসা ব্যতিরেকে এতবড় একটি সম্মেলন সফল করা যেন ছিল দুঃসাধ্য। সম্মেলনে দেরিতে হলেও উপস্থিত হয়েছিলেন ফেডারেল মিনিস্টার ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিংয়ের জনাব কামারুজ্জামান কায়রা। তিনি গিলগিট বেলুচিস্তানের গভর্নরও। উপস্থিত সাংবাদিকদের নিজ দেশে স্বাগত জানিয়ে তিনি মহিলাদের কষ্টকর পথ-পরিক্রমার কথা তুলে ধরলেন। তিনি পত্রিকা ও টিভি মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বললেন, আপনারা তাদের উত্সাহিত করুন। তারা যেন কোনো রকম লাঞ্ছনার শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বললেন, আমরা লড়াই করছি সবদিকে। যারা নারীর প্রতি সহিংস হয় তাদের বিরুদ্ধে এবং যারা দেশে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। এ কারণে গোটা বিশ্ব আমাদের সমর্থন জানাচ্ছে। তিনি বললেন, ভারত বলছে, ‘নো মোর ডায়ালগ’ বা কোনো আলোচনা নয়। এটা ঠিক নয়। এ পথ খোলা রাখতে হবে। বললেন, সার্ক ফোরাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এই ফোরাম গোটা অঞ্চলের জন্য প্রয়োজন। বললেন, পাকিস্তান শান্তি চায়। চায় সবার সহযোগিতা।
এরপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো হলো তথ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার জন্য। পাকিস্তানের এক নারী সাংবাদিক অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বললেন আপনি কেন ‘ জিও টিভি’ বন্ব্দ করে দিলেন? মন্ত্রীও ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বললেন, আমাদেরও কিছু নীতিমালা রয়েছে। ‘জিও টিভি’ অব্যাহতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসছিল। আমাদের রাশেদা আমিন বাংলাদেশে আটকেপড়া বিহারিদের কবে ফেরত নেয়া হবে জানতে চাইলেন। তথ্যমন্ত্রী বললেন, এ ব্যাপারে কাজ চলছে। আমরা তাদের ফিরিয়ে আনব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, আজকাল পত্রিকার চিফ রিপোর্টার মধুমিতা দত্ত সাংবাদিক নারীদের নানা সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরলেন। বিকেলে ৪টি বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটির কাজ শুরু হলো। এই কমিটিগুলোতে আমরা সব সাংবাদিক ভাগাভাগি হয়ে কাজ করলাম।
দ্বিতীয় দিনে ওয়ার্কিং কমিটির সুপারিশ মূল্যায়ন ও ‘সওম’এর আঞ্চলিক সম্মেলনের ডিক্লারেশন ড্রাফট পেশ করা হলো। এর আগে দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন পাঞ্জাবের গভর্নর জনাব সালমান তাসির তার গভর্নর হাউসে।
পাঞ্জাব গভর্নর স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন। তিনি নারী স্বাধীনতার কথা বললেন। বললেন, তার দেশের নারী নেত্রী পিপলস পার্টি প্রধান বেনজির ভুট্টোর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা। বললেন, আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সব প্রদেশের সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি।
রাতে পুনরায় রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী কামার জানান কায়রা। সেখানে গিয়ে দেখি স্ললস্থুল কাণ্ড। বিশাল এক মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে মরস্লমা গায়িকা ইকবাল বানুর ছবি। ইকবাল বানু পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক বিখ্যাত নাম। এক কিংবদন্তী। আয়োজনের স্থান ছিল লাহোরের পার্ল কন্টিনেন্টালের শাহী খেমায়। ইকবাল বানু স্মরণে লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ইকবাল বানুর গানগুলো গাইলেন বর্তমান প্রজন্মের গায়িকারা।
‘গুমনাম’ ছায়াছবির সঙ্গীত পরিবেশন করলেন গায়িকা কিরন। তিনি গাইলেন, ‘পায়েল কি গীত ছমছম কি।’ মনে হলো একজন প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে এমন অনুষ্ঠান বোধকরি সাংস্কৃতিক উচ্চতার দেশ পাকিস্তানই করতে পারে!
ফিরে আসতে আসতে আমাদের সম্মেলনের কথা মনে হলো। মনে হলো এই যে প্রায় দেড়শ’ সাংবাদিক নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা কি পারবেন স্ব-স্ব দেশের চিরবঞ্চিত, চির অবহেলিত, নারীর দুর্দশা দূর করতে? তবু পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী শেরি রহমান, সাংবাদিক রেহানা হাকিম, আমাদের দেশের রাশেদা, মাহমুদা চৌধুরী, নাসিমুন, ভুটানের কেজাং চোডেন ও শ্রীলংকার শর্মিনি বোয়েল যিনি এবারে ২ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বলতে হবে আমরা এগিয়ে যাব।
যত বাধাই আসুক, প্রতিহত করব। করব প্রতিবাদ। অচলায়তনের এ পাহাড় ভাঙব। দেশের ১৫ কোটি মানুষের অর্ধেক নারীকে ‘অপর অংশের সুন্দর জীবনের জন্যই’ আমাদের এগুতে হবে। সে তারা বুঝুন আর নাই বুঝুন। নারী সাংবাদিকের কাজ দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক শুধু নয়—হতে হবে শত হাজার মাত্রিক। তবেই এ ধরনের সম্মেলনের সার্থকতা।
No comments