পঙ্গু হয়ে গেলেন নিখিল ভদ্র-দেশে নিরাপদ সড়ক কি পাওয়া যাবে না?

সংবাদ সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছিলেন কালের কণ্ঠের সিনিয়র প্রতিবেদক নিখিল ভদ্র। কিন্তু তিনি জানতেন না যে একটু পর নিজেই হয়ে যাবেন সংবাদের শিরোনাম। গত বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিআরটিসির একটি বাস তাঁকে চাপা দেয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। ডান পায়ের অবস্থাও গুরুতর। আমাদের সভ্য রাষ্ট্রে সড়ক নামের যে


দুষ্টক্ষত তৈরি হয়েছে, তাতে নিখিল কেন, আমরা কেউই নিরাপদ নই। কেউই জানি না, কে কখন এমন পরিণতির সম্মুখীন হব। প্রতিকারহীন(?) এই দুষ্টক্ষত কি এভাবেই আমাদের জীবন কেড়ে নিতে থাকবে?
কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং প্রতিভাবান টিভি সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহত হলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। যে বাসটি তাঁদের মাইক্রোবাসটিকে চাপা দিয়েছিল, সেই বাসটির চালককে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, সে জন্য বাস শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছিল। শুধু তা-ই নয়, বাসচালককে গ্রেপ্তারের দাবি জানানোর কারণে আরেক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল, তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা খ্যাতনামা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতাপেটা করেছিল বাস শ্রমিকরা। এই দুর্দান্ত বাসচালকরা নিখিল ভদ্রদের চাপা দিতে কুণ্ঠিত হবে কেন? তারা তো জানে, তাদের পেছনে রয়েছে মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক রাঘব বোয়াল। তা না হলে একজন মন্ত্রী কিভাবে বিনা পরীক্ষায় ছাগল-গরু চিনতে পারা ২০ হাজার বা ৩০ হাজার লোককে লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করতে পারেন! এমন লাইসেন্স প্রথা রাখারই বা দরকার কী? সব কিছু 'ফ্রি স্টাইল' করে দিলেই হয়। পেপসি-কোলার ঘাতক ট্রাক বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর জীবন কেড়ে নিয়েছিল। দীর্ঘকাল মামলা চলার পর তাঁর পক্ষে আদালত দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিলেও আজ পর্যন্ত তা আদায় হয়নি, উচ্চতর আদালতে ঝুলে আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আরো সাংবাদিকসহ বহু প্রাণ গেছে এরপর। বেদনাদায়ক দুর্ঘটনা আজও থামছে না।
বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশের বেশি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিংবা ভুয়া লাইসেন্সধারী। ট্রাফিক পুলিশও তা জানে। মাঝেমধ্যে ধরেও, আবার উৎকোচ নিয়ে ছেড়েও দেয়। অনেকেই সম্ভবত ভুলে যাননি মিরসরাই ট্র্যাজেডির কথাও। একটি মিনি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পার্শ্ববর্তী খাদে উল্টে পড়ে গেলে ৪৮ শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিক মারা গিয়েছিল। সেই ট্রাকটিও চালাচ্ছিল চালকের হেলপার, যার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। তদুপরি দুর্ঘটনার সময় সে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। আবার যাদের লাইসেন্স আছে, তাদেরও প্রায় ৮০ শতাংশ অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়নি। কোনো একজন চালকের কাছ থেকে কোনো রকমে স্টিয়ারিং ধরা শিখেছে মাত্র। গাড়ি চালনার অন্য সব নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এমনকি রাস্তার সব সংকেতও এরা চেনে না। এ ছাড়া বেপরোয়াভাবে অথবা প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর ঘটনা তো হরহামেশাই চোখে পড়ে।
বাংলাদেশে অত্যধিক সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণটি হলো দুর্বল আইন এবং আইনের প্রয়োগ না থাকা। চট্টগ্রামে ২০০৩ সালে আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ১১ জন কিশোর ক্রিকেটারের মৃত্যু হয়েছিল। তখনো শোকাহত হয়েছিল সারা দেশ। কিছুদিন আগে সেই মামলাটির রায় হয়েছে। যে দ্রুতগামী হিউম্যান হলারের ধাক্কায় সেদিন এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছিল, সেই চালকের মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তার ওপর সেই চালককে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে নিখিল ভদ্ররা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হবেন_এটাই তো স্বাভাবিক!

No comments

Powered by Blogger.