টমাস ট্রান্সট্রোমার : হৃদয়ের প্রতিবেশী by মোহাম্মদ সাদিক
৬ অক্টোবর ২০১১। সেলফোনে প্রথম সংবাদটা জানান কবি শামীম রেজা। কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৭ অক্টোবর ২০১১। আমি ফোন করি স্টকহোমে টমাসের বাসায়। যথারীতি ফোন ধরেন টমাসের স্ত্রী মনিকা ট্রান্সট্রোমার। সানন্দে টমাস এবং তাঁকে অভিনন্দন জানাই। বলি, এই সময়ে তোমাকে ফোন করে ব্যস্ত রাখা মানে, পৃথিবীর মানুষের সময় নষ্ট করা। মনিকা হাসেন এবং যা বলেন, তার মানে হচ্ছে_আমি ক্লান্ত, এ বড় ভারী জিনিস।
২. ১৯৯১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমি সুইডেনের স্টকহোমস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে যোগদান করি। সেদিন সকালে একটি ট্যাঙ্েিত করে আমি যখন অহফবৎংঃড়ঢ়ংাধমবহ-এ রওনা হই, তখন চারপাশে তুষারের সাদা চাদর পরে শুয়ে আছে সুইডেন। তার মাঝখানে পত্রপল্লবহীন বৃক্ষগুলো বিষণ্ন ম্লান দাঁড়িয়ে আছে। যে কারো মন খারাপ হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট। সুইডেনের রূপবর্ণনা অনেক শুনেছি। কিন্তু প্রথম দিন আমি সেখানে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো একটি সকাল আবিষ্কার করে হতাশ হই। মিসরীয় ট্যাঙ্ড্রিাইভার আমাকে একটি স্থূল ইঙ্গিত করে বলে, 'এখন শীতকাল, গাছে পাতা না থাকলেও মানুষের শরীরে পাতা (পোশাক) আছে। গ্রীষ্মে যখন গাছে পাতা থাকবে, তখন মানুষের শরীরে পাতা (পোশাক) থাকবে না।' বলে সে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে। আমার তেমন ভালো লাগে না। তাঁর কথার কোনো জবাব দেই না। পরে এই শীতের রুপালি রূপ এবং গ্রীষ্মের গভীর সবুজ ও রংবেরঙের ফুলের সাজে স্টকহোম তথা সুইডেনকে সাজতে দেখেছি। ভালো লেগেছে। সুন্দর সম্ভবত সব সময়ই বিষণ্ন। স্টকহোমকে আমার বিষণ্ন সুন্দর একটি শহর বলে মনে হয়েছে।
৩. এই শহরের, এই দেশের এক কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার। সারা বছরই অনুষ্ঠান লেগে থাকে স্টকহোমে। বিচিত্র সব প্রদর্শনী, অপেরা, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান। শীতে ক্লোজডোর অডিটরিয়ামে আর গ্রীষ্মে ওপেন এয়ার প্রোগ্রাম। উৎসবমুখর স্টকহোম। কিন্তু এই শহরেও সব সময় থাকেন না টমাস। তাঁর স্ত্রী মনিকা ট্রান্সট্রোমারকে আমি যখন প্রথম ফোন করি, তখন তাঁরা স্টকহোমের বাইরে ছিলেন। বললেন, মাসখানেক পর স্টকহোমে ফিরবেন। আমি অপেক্ষা করি।
দূতাবাসের কাজ সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে। কূটনৈতিক যোগসূত্র তার প্রধান অংশ। কিন্তু একটি দূতাবাসে ওই কাজটি সম্পাদন করতে গিয়ে যা করতে হয়, তাতে সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগসূত্রের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় আসে অনেক পরে। তার পরও আজিজ রহমান যখন সুইডেনে কাউন্সেলর (ইকোনমিক) ছিলেন, তখন তিনি টমাসের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। পরবর্তীকালে টমাসের বাসায় মনিকা ট্রান্সট্রোমার বাংলাদেশের কবি কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদগ্রন্থটি দেখিয়েছিলেন।
৪. টমাস ট্রান্সট্রোমারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় নির্ধারিত হওয়ার পর খুবই চনমন করেছিল মন। তাঁর জন্য সামান্য স্যুভেনির ছাড়া আর কী নিয়ে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে অনেক ভাবা হলো। পরে আমি আর আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিই, কবির জন্য কিছু বাংলাদেশি খাবার নিয়ে যাওয়া যায় কি না। যথারীতি আমরা তাঁর জন্য ঘরে তৈরি রসগোল্লা ও পাটিসাপটা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কোনো কারণে মিষ্টির প্রতি বিরাগ থাকলে বিকল্প হিসেবে একদম সদ্য তৈরি করা একটি পিঁয়াজুর বাঙ্ও নেওয়া হলো।
এসব দেখা-সাক্ষাতে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যথাসময়ের বেশ আগেই আমরা রওনা হই। অধিকতর সতর্কতায় টমাসের এলাকায় একটু আগেই পেঁৗছে যাই। কূটনৈতিকপাড়ায় এ রকম রেওয়াজ আছে যে, কোনো নির্ধারিত সাক্ষাতের আগে পেঁৗছে গেলে নির্দিষ্ট জায়গার আশপাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়ানো এবং সঠিক সময়ে গন্তব্যের গেটে নক করা। কিছুটা থ্রিল বুকে নিয়ে সময় পার করছি। সুইডেনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি টমাসের সঙ্গে দেখা হবে, দেখা হবে তাঁর স্ত্রী মনিকা ট্রান্সট্রোমারের সঙ্গে। একটি অপূর্ব ভালো লাগা অনুভূতির সঙ্গে এসে জড়ো হচ্ছে আশঙ্কা_দেখা কেমন হবে।
দরজা খুলে দিলেন মনিকা। উজ্জ্বল হাসির আভা মুখজুড়ে। আমাদের নিয়ে ঘরের ভেতরে যান, একটি চেয়ারে বসে আছেন টমাস। ওঠার চেষ্টা করছিলেন, মনিকা তাঁকে বসিয়ে দেন। জানতাম তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা, তাই কাছে গিয়ে হাতে হাত রেখে তাঁকে আরাম করে বসার সুযোগ করে দিই। মনিকা তাঁকে সুইডিশ ভাষায় কিছু বলেন। বুঝতে পারি, আমাদের আসার আগ্রহ ও কারণ। এবং তাঁর বাংলাদেশ উচ্চারণে বুঝতে পারি, তিনি আমাদের দেশের কথা বলছেন।
টমাসকে দেখে অবাক হই। তাঁর কবিতা পড়ে বারবার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশকে আমার মনে পড়ে। কিন্তু তাঁর অবয়ব দেখে কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়ে যায়। ক্লিনশেভ্ড রাহমান ভাইয়ের বিচিত্রার টেবিলে আমার বহু প্রহর কেটেছে। টমাসকে হুবহু তাঁর মতো লাগছিল। ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করছেন। যখনই কিছু দরকার, মনিকার দিকে তাকালেই তিনি যেন বুঝতে পারেন। মনিকা বলেন, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুশি হয়েছেন টমাস। বাংলায় তাঁর কবিতার অনুবাদ হয়েছে। আমিও, উভয় বাংলায় তাঁর কবিতার অনেক অনুরাগী আছেন, তাঁকে জানাই। মনিকাও আমাকে সহযোগিতা করছিলেন। তিনি তাঁর বুকশেল্ফ থেকে কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদগ্রন্থটি এনে আমাকে দেখালেন। আমার খুব ভালো লাগল, বইটি যত্ন করে রাখছে টমাসের পরিবার। ১৯১৩ সালে যে কবি তাঁর কবিতার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই ভাষার মানুষ আমরা। ইতিমধ্যে মনিকা টমাসকে জানিয়েছিলেন, আমরা কবিতার অনুরাগী। আমি নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি_এটা তাঁকে জানানো হলো। টমাসের মুখে মৃদু হাসির রেখা, মনিকাকে কী যেন বলেন তিনি। মনিকা জানালেন, টমাস আমার কবিতা শুনতে চান। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে জানাই, সঙ্গে আমার কবিতার ইংরেজি বা সুইডিশ কোনো অনুবাদ নেই।
মনিকা আমাকে বাংলা কবিতা পড়তে বলেন। এও জানান, টমাস ট্রান্সট্রোমার বাংলায় কবিতা শুনতে চাইছেন। তিনি বাংলা কবিতার ধ্বনি শুনতে চান। স্যুভেনির হিসেবে আমি আমার একটি কবিতার বই নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে একটি কবিতা পাঠ করি। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে সুইডেনের স্টকহোমে এক মহান কবি গভীর মনোযোগ দিয়ে বাংলা কবিতার ধ্বনি শুনছেন। গালে হাত দিয়ে মনিকাও শুনছেন বাংলা কবিতা। সুইডেনে আমার স্মরণীয় মুহূর্ত। কবিতা শেষ হলে আমি মনিকাকে জিজ্ঞেস করি_বাংলা কবিতার ধ্বনি কেমন লাগল টমাসের। মনিকা কিছু বলার আগেই টমাসের মুখ মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মনিকার কাছে জানতে চাই, টমাস এখন কেমন আছেন? মনিকা তাঁর স্বাস্থ্যের যে বিবরণ দেন, তাতে খুব ভালো সময় যাচ্ছে বলা যায় না। সন্তানরা কাছে নেই, তারা দূরে থাকে। মনিকা এক গভীর মমতায় টমাসের সব কিছু দেখাশোনা করছেন। আমরা ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম। তার মধ্যে মনিকার গভীর মমতা, যত্ন-আত্তি আমাদের চোখে পড়ে।
দীর্ঘ সুন্দর সুখী দাম্পত্য জীবনের এক অসাধারণ অধ্যায় টমাস-মনিকার সংসার। এ দেশে যা সুলভ নয়, তা-ই লক্ষ করলাম_মনিকা যে শুধু টমাসের যত্ন-আত্তি করছেন, তা নয়, তাঁর হয়ে কথাও বলছেন। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অনুবাদ করছেন। প্রয়োজনে বিশেষ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অনির্বচনীয় এক মমতায় কবিকে আগলে রেখেছেন এই মহীয়সী নারী। শুধু সহধর্মিণী নন, বাৎসল্যে-ভালোবাসায় 'জননীর স্থান অধিকার' করে আছেন যেন।
৫. টমাসের জন্য আমরা যে পাটিসাপটা, পিঁয়াজু নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ধারণা ছিল, একটি মিষ্টি, একটি ঝাল_দুটোই তাঁর জন্য নিষিদ্ধ এবং অপ্রিয় হয় কি না। মনিকাকে বুঝিয়ে বলা হলো, কোন আইটেম কী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি প্রথমে একটু চেখে নিয়ে টমাসকে খেতে দেন। আমাদের জন্য কিছু কেক, বিস্কুট ও জুস দেওয়া হলো। দেওয়া হলো পিঁয়াজু ও পাটিসাপটা। টমাস মনিকার কাছে পুনরায় জানতে চাইলেন, আইটেমগুলোর নাম কী? জানানো হলো, পাটিসাপটা, পিঁয়াজু। টমাস অনেক কষ্টে উচ্চারণ করেন, 'পাতিসাপথা', 'ইয়াজো'।
কথায় কথায় মনিকা জানালেন, ভূপালে কবিতা উৎসবে তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিও ছিলেন সেখানে। নাম বলতে পারছিলেন না। বর্ণনা যা দিলেন, তাতে যা বোঝা গেল, তিনি কবি আল মাহমুদ। গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের বিষয়টি অনুসরণ না করলে মানুষটির বিবরণ তাঁর মনে থাকার কথা নয়।
টুকটাক কথাবার্তা হয়_স্টকহোম আমাদের কেমন লাগছে, কোথায় থাকি, কে কে আছেন আমাদের পরিবারে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়ের কথা বলি। আমার পিতা সঙ্গে আছেন, তাও জানাই। স্টকহোম সম্পর্কে বলি তাঁকে, সুন্দর।
পড়ন্ত বিকেলে এই আনন্দঘন মুহূর্ত পেছনে রেখে যখন ফিরতে শুরু করি, তখন মনেই হয় না, প্রথম পরিচয়ের মানুষের কাছ থেকে ফিরে আসছি। অসাধারণ আন্তরিকতায়, মমতায় টমাসের সঙ্গে আমাদের দেখা স্মরণীয় করে তোলেন মনিকা ট্রান্সট্রোমার।
৬. মনিকার পাঠানো টমাসের হাইকুগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে শুরু করি তখনই। অনুবাদ করতে গিয়ে আরো ভালো লাগতে শুরু করে। টমাসকে, মনিকাকে স্বজন মনে হতে থাকে; এবং একদিন আবিষ্কার করি, তাঁরা আমাদের হৃদয়ের প্রতিবেশী। ১৯৯৯ সালে স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগ দিই। ২০০২ সালে যথারীতি ফেরার সময় আসে। যে ডিসেম্বর মাসে আমি সেখানে গিয়েছিলাম, ঠিক সেই ডিসেম্বরেই ফেরে আমার দিন।
দূতাবাসে আমার কর্মকালের আনন্দ, বেদনা, বিস্ময় ও তিক্ততা_সব মিলিয়ে যেদিন বিকেলে আমার ফ্লাইট, সেদিন সকালে আমার কোনো প্রোগ্রাম রাখিনি। আগের দিন কথা হয় মনিকার সঙ্গে। এই সিজনে সকাল হওয়ার কথা অন্ধকার। কিন্তু অবাক করে দিয়ে অসাধারণ সোনালি রোদের দেখা মেলে। আগের দিন রাতে আমার গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছি অন্যের হাতে। আমার ছোট্ট কারটি বিক্রি করে দিয়েছি। আমাকে নিয়ে কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের বাসার দিকে রওনা হন লিয়াকত হোসেন। আমার মনে হচ্ছে, আর কখনো হয়তো দেখা হবে না টমাসের সঙ্গে, মনিকার সঙ্গে। আকাশের সোনালি রোদ দেখে আমরা অবাক। লিয়াকত সাহেব আর আমি পরস্পরের দিকে তাকাই। এই সুন্দর সোনালি রোদের আরো ব্যাখ্যা দেন লিয়াকত সাহেব।
দেখা হয় টমাসের সঙ্গে, মনিকার সঙ্গে। মনিকা যথারীতি যত্ন-আত্তি করেন, খুশি হন। আসার সময় আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য কিছু উপহার তুলে দেন। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল পিয়ানোবাদক টমাসের ডিভিডি। সুইডিশ ভাষায় টমাসের স্মৃতিকথা আমাদের সন্তানদের জন্য। মনিকা জানতেন, তারা সুইডিশ ভালোই রপ্ত করেছে।
৭. তিন বছরের সুইডেনে কিছু স্মৃতি তো আছেই, আনন্দ-বেদনার কাব্যও আছে। কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার-মনিকা ট্রান্সট্রোমারের আন্তরিকতা ভোলা যায়নি। দেশে ফিরে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা, দুঃখ-কষ্ট_সব মিলিয়ে দিনগুলো ভালো যায়নি।
প্রতিবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এলে টমাসের কথা মনে পড়ত। মনে হতো, টমাস সুইডিশ বলেই এখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। বিগত বছরে কবি শামীম রেজা এসে বলল, এবার টমাস নোবেল পুরস্কার পাবেনই। আমাকে একটা লেখা দেবেন। এবারও অনেকের নামের সঙ্গে টমাস ট্রান্সট্রোমারের নাম আসে। বৃহস্পতিবার ৬ অক্টোবর ২০১১ শামীম টেলিফোনের ওপার থেকে চিৎকার করে_আপনার টমাস নোবেল পেয়েছেন। টমাস আমার হবেন কেন, টমাস সারা পৃথিবীর। বিবিসিতে প্রথম সংবাদটা দেখি। বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায়। অনাবিল এক আনন্দ বয়ে যায় আমাদের ঘরে। যেন বিশ্বকাপ জিতেছে বাংলাদেশ। কত দূরদেশের কবি, কিন্তু কত কাছের, প্রতিবেশী যেন হৃদয়ের। (সংক্ষিপ্ত)
[শিলালিপি ১৪ অক্টোবর ২০১১]
৩. এই শহরের, এই দেশের এক কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার। সারা বছরই অনুষ্ঠান লেগে থাকে স্টকহোমে। বিচিত্র সব প্রদর্শনী, অপেরা, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান। শীতে ক্লোজডোর অডিটরিয়ামে আর গ্রীষ্মে ওপেন এয়ার প্রোগ্রাম। উৎসবমুখর স্টকহোম। কিন্তু এই শহরেও সব সময় থাকেন না টমাস। তাঁর স্ত্রী মনিকা ট্রান্সট্রোমারকে আমি যখন প্রথম ফোন করি, তখন তাঁরা স্টকহোমের বাইরে ছিলেন। বললেন, মাসখানেক পর স্টকহোমে ফিরবেন। আমি অপেক্ষা করি।
দূতাবাসের কাজ সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে। কূটনৈতিক যোগসূত্র তার প্রধান অংশ। কিন্তু একটি দূতাবাসে ওই কাজটি সম্পাদন করতে গিয়ে যা করতে হয়, তাতে সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগসূত্রের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় আসে অনেক পরে। তার পরও আজিজ রহমান যখন সুইডেনে কাউন্সেলর (ইকোনমিক) ছিলেন, তখন তিনি টমাসের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। পরবর্তীকালে টমাসের বাসায় মনিকা ট্রান্সট্রোমার বাংলাদেশের কবি কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদগ্রন্থটি দেখিয়েছিলেন।
৪. টমাস ট্রান্সট্রোমারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় নির্ধারিত হওয়ার পর খুবই চনমন করেছিল মন। তাঁর জন্য সামান্য স্যুভেনির ছাড়া আর কী নিয়ে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে অনেক ভাবা হলো। পরে আমি আর আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিই, কবির জন্য কিছু বাংলাদেশি খাবার নিয়ে যাওয়া যায় কি না। যথারীতি আমরা তাঁর জন্য ঘরে তৈরি রসগোল্লা ও পাটিসাপটা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কোনো কারণে মিষ্টির প্রতি বিরাগ থাকলে বিকল্প হিসেবে একদম সদ্য তৈরি করা একটি পিঁয়াজুর বাঙ্ও নেওয়া হলো।
এসব দেখা-সাক্ষাতে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যথাসময়ের বেশ আগেই আমরা রওনা হই। অধিকতর সতর্কতায় টমাসের এলাকায় একটু আগেই পেঁৗছে যাই। কূটনৈতিকপাড়ায় এ রকম রেওয়াজ আছে যে, কোনো নির্ধারিত সাক্ষাতের আগে পেঁৗছে গেলে নির্দিষ্ট জায়গার আশপাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়ানো এবং সঠিক সময়ে গন্তব্যের গেটে নক করা। কিছুটা থ্রিল বুকে নিয়ে সময় পার করছি। সুইডেনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি টমাসের সঙ্গে দেখা হবে, দেখা হবে তাঁর স্ত্রী মনিকা ট্রান্সট্রোমারের সঙ্গে। একটি অপূর্ব ভালো লাগা অনুভূতির সঙ্গে এসে জড়ো হচ্ছে আশঙ্কা_দেখা কেমন হবে।
দরজা খুলে দিলেন মনিকা। উজ্জ্বল হাসির আভা মুখজুড়ে। আমাদের নিয়ে ঘরের ভেতরে যান, একটি চেয়ারে বসে আছেন টমাস। ওঠার চেষ্টা করছিলেন, মনিকা তাঁকে বসিয়ে দেন। জানতাম তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা, তাই কাছে গিয়ে হাতে হাত রেখে তাঁকে আরাম করে বসার সুযোগ করে দিই। মনিকা তাঁকে সুইডিশ ভাষায় কিছু বলেন। বুঝতে পারি, আমাদের আসার আগ্রহ ও কারণ। এবং তাঁর বাংলাদেশ উচ্চারণে বুঝতে পারি, তিনি আমাদের দেশের কথা বলছেন।
টমাসকে দেখে অবাক হই। তাঁর কবিতা পড়ে বারবার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশকে আমার মনে পড়ে। কিন্তু তাঁর অবয়ব দেখে কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়ে যায়। ক্লিনশেভ্ড রাহমান ভাইয়ের বিচিত্রার টেবিলে আমার বহু প্রহর কেটেছে। টমাসকে হুবহু তাঁর মতো লাগছিল। ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করছেন। যখনই কিছু দরকার, মনিকার দিকে তাকালেই তিনি যেন বুঝতে পারেন। মনিকা বলেন, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুশি হয়েছেন টমাস। বাংলায় তাঁর কবিতার অনুবাদ হয়েছে। আমিও, উভয় বাংলায় তাঁর কবিতার অনেক অনুরাগী আছেন, তাঁকে জানাই। মনিকাও আমাকে সহযোগিতা করছিলেন। তিনি তাঁর বুকশেল্ফ থেকে কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদগ্রন্থটি এনে আমাকে দেখালেন। আমার খুব ভালো লাগল, বইটি যত্ন করে রাখছে টমাসের পরিবার। ১৯১৩ সালে যে কবি তাঁর কবিতার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই ভাষার মানুষ আমরা। ইতিমধ্যে মনিকা টমাসকে জানিয়েছিলেন, আমরা কবিতার অনুরাগী। আমি নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি_এটা তাঁকে জানানো হলো। টমাসের মুখে মৃদু হাসির রেখা, মনিকাকে কী যেন বলেন তিনি। মনিকা জানালেন, টমাস আমার কবিতা শুনতে চান। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে জানাই, সঙ্গে আমার কবিতার ইংরেজি বা সুইডিশ কোনো অনুবাদ নেই।
মনিকা আমাকে বাংলা কবিতা পড়তে বলেন। এও জানান, টমাস ট্রান্সট্রোমার বাংলায় কবিতা শুনতে চাইছেন। তিনি বাংলা কবিতার ধ্বনি শুনতে চান। স্যুভেনির হিসেবে আমি আমার একটি কবিতার বই নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে একটি কবিতা পাঠ করি। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে সুইডেনের স্টকহোমে এক মহান কবি গভীর মনোযোগ দিয়ে বাংলা কবিতার ধ্বনি শুনছেন। গালে হাত দিয়ে মনিকাও শুনছেন বাংলা কবিতা। সুইডেনে আমার স্মরণীয় মুহূর্ত। কবিতা শেষ হলে আমি মনিকাকে জিজ্ঞেস করি_বাংলা কবিতার ধ্বনি কেমন লাগল টমাসের। মনিকা কিছু বলার আগেই টমাসের মুখ মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মনিকার কাছে জানতে চাই, টমাস এখন কেমন আছেন? মনিকা তাঁর স্বাস্থ্যের যে বিবরণ দেন, তাতে খুব ভালো সময় যাচ্ছে বলা যায় না। সন্তানরা কাছে নেই, তারা দূরে থাকে। মনিকা এক গভীর মমতায় টমাসের সব কিছু দেখাশোনা করছেন। আমরা ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম। তার মধ্যে মনিকার গভীর মমতা, যত্ন-আত্তি আমাদের চোখে পড়ে।
দীর্ঘ সুন্দর সুখী দাম্পত্য জীবনের এক অসাধারণ অধ্যায় টমাস-মনিকার সংসার। এ দেশে যা সুলভ নয়, তা-ই লক্ষ করলাম_মনিকা যে শুধু টমাসের যত্ন-আত্তি করছেন, তা নয়, তাঁর হয়ে কথাও বলছেন। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অনুবাদ করছেন। প্রয়োজনে বিশেষ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অনির্বচনীয় এক মমতায় কবিকে আগলে রেখেছেন এই মহীয়সী নারী। শুধু সহধর্মিণী নন, বাৎসল্যে-ভালোবাসায় 'জননীর স্থান অধিকার' করে আছেন যেন।
৫. টমাসের জন্য আমরা যে পাটিসাপটা, পিঁয়াজু নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ধারণা ছিল, একটি মিষ্টি, একটি ঝাল_দুটোই তাঁর জন্য নিষিদ্ধ এবং অপ্রিয় হয় কি না। মনিকাকে বুঝিয়ে বলা হলো, কোন আইটেম কী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি প্রথমে একটু চেখে নিয়ে টমাসকে খেতে দেন। আমাদের জন্য কিছু কেক, বিস্কুট ও জুস দেওয়া হলো। দেওয়া হলো পিঁয়াজু ও পাটিসাপটা। টমাস মনিকার কাছে পুনরায় জানতে চাইলেন, আইটেমগুলোর নাম কী? জানানো হলো, পাটিসাপটা, পিঁয়াজু। টমাস অনেক কষ্টে উচ্চারণ করেন, 'পাতিসাপথা', 'ইয়াজো'।
কথায় কথায় মনিকা জানালেন, ভূপালে কবিতা উৎসবে তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিও ছিলেন সেখানে। নাম বলতে পারছিলেন না। বর্ণনা যা দিলেন, তাতে যা বোঝা গেল, তিনি কবি আল মাহমুদ। গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের বিষয়টি অনুসরণ না করলে মানুষটির বিবরণ তাঁর মনে থাকার কথা নয়।
টুকটাক কথাবার্তা হয়_স্টকহোম আমাদের কেমন লাগছে, কোথায় থাকি, কে কে আছেন আমাদের পরিবারে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়ের কথা বলি। আমার পিতা সঙ্গে আছেন, তাও জানাই। স্টকহোম সম্পর্কে বলি তাঁকে, সুন্দর।
পড়ন্ত বিকেলে এই আনন্দঘন মুহূর্ত পেছনে রেখে যখন ফিরতে শুরু করি, তখন মনেই হয় না, প্রথম পরিচয়ের মানুষের কাছ থেকে ফিরে আসছি। অসাধারণ আন্তরিকতায়, মমতায় টমাসের সঙ্গে আমাদের দেখা স্মরণীয় করে তোলেন মনিকা ট্রান্সট্রোমার।
৬. মনিকার পাঠানো টমাসের হাইকুগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে শুরু করি তখনই। অনুবাদ করতে গিয়ে আরো ভালো লাগতে শুরু করে। টমাসকে, মনিকাকে স্বজন মনে হতে থাকে; এবং একদিন আবিষ্কার করি, তাঁরা আমাদের হৃদয়ের প্রতিবেশী। ১৯৯৯ সালে স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগ দিই। ২০০২ সালে যথারীতি ফেরার সময় আসে। যে ডিসেম্বর মাসে আমি সেখানে গিয়েছিলাম, ঠিক সেই ডিসেম্বরেই ফেরে আমার দিন।
দূতাবাসে আমার কর্মকালের আনন্দ, বেদনা, বিস্ময় ও তিক্ততা_সব মিলিয়ে যেদিন বিকেলে আমার ফ্লাইট, সেদিন সকালে আমার কোনো প্রোগ্রাম রাখিনি। আগের দিন কথা হয় মনিকার সঙ্গে। এই সিজনে সকাল হওয়ার কথা অন্ধকার। কিন্তু অবাক করে দিয়ে অসাধারণ সোনালি রোদের দেখা মেলে। আগের দিন রাতে আমার গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছি অন্যের হাতে। আমার ছোট্ট কারটি বিক্রি করে দিয়েছি। আমাকে নিয়ে কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের বাসার দিকে রওনা হন লিয়াকত হোসেন। আমার মনে হচ্ছে, আর কখনো হয়তো দেখা হবে না টমাসের সঙ্গে, মনিকার সঙ্গে। আকাশের সোনালি রোদ দেখে আমরা অবাক। লিয়াকত সাহেব আর আমি পরস্পরের দিকে তাকাই। এই সুন্দর সোনালি রোদের আরো ব্যাখ্যা দেন লিয়াকত সাহেব।
দেখা হয় টমাসের সঙ্গে, মনিকার সঙ্গে। মনিকা যথারীতি যত্ন-আত্তি করেন, খুশি হন। আসার সময় আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য কিছু উপহার তুলে দেন। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল পিয়ানোবাদক টমাসের ডিভিডি। সুইডিশ ভাষায় টমাসের স্মৃতিকথা আমাদের সন্তানদের জন্য। মনিকা জানতেন, তারা সুইডিশ ভালোই রপ্ত করেছে।
৭. তিন বছরের সুইডেনে কিছু স্মৃতি তো আছেই, আনন্দ-বেদনার কাব্যও আছে। কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার-মনিকা ট্রান্সট্রোমারের আন্তরিকতা ভোলা যায়নি। দেশে ফিরে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা, দুঃখ-কষ্ট_সব মিলিয়ে দিনগুলো ভালো যায়নি।
প্রতিবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এলে টমাসের কথা মনে পড়ত। মনে হতো, টমাস সুইডিশ বলেই এখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। বিগত বছরে কবি শামীম রেজা এসে বলল, এবার টমাস নোবেল পুরস্কার পাবেনই। আমাকে একটা লেখা দেবেন। এবারও অনেকের নামের সঙ্গে টমাস ট্রান্সট্রোমারের নাম আসে। বৃহস্পতিবার ৬ অক্টোবর ২০১১ শামীম টেলিফোনের ওপার থেকে চিৎকার করে_আপনার টমাস নোবেল পেয়েছেন। টমাস আমার হবেন কেন, টমাস সারা পৃথিবীর। বিবিসিতে প্রথম সংবাদটা দেখি। বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায়। অনাবিল এক আনন্দ বয়ে যায় আমাদের ঘরে। যেন বিশ্বকাপ জিতেছে বাংলাদেশ। কত দূরদেশের কবি, কিন্তু কত কাছের, প্রতিবেশী যেন হৃদয়ের। (সংক্ষিপ্ত)
[শিলালিপি ১৪ অক্টোবর ২০১১]
No comments