শেকড়ের ডাক-আরেকটা যুদ্ধ চাই by ফরহাদ মাহমুদ
দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। তারপর চার-চারটি দশক আমরা পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু দেশের দরিদ্র সাধারণ মানুষ সেই বিজয়ের স্বাদ কতটুকু পেয়েছে_এমনি প্রশ্ন আজও আমাদের অহরহ শুনতে হয়। প্রশ্নটির সঠিক উত্তর কী হবে_তা আমার জানা নেই। তবে সাধারণ বিবেচনায় বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা আমরা পাইনি। কিন্তু কেন পাইনি, প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায়
ছিল_স্বাধীনতার চার দশকেও আমরা সেই উত্তরগুলো খুঁজে বের করতে পারিনি, অথবা বের করার জন্য খুব একটা সচেষ্ট হইনি। ফলে এই ৪০ বছরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্র থেকে কেবল দরিদ্রতর হয়েছে, আর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। রাজনীতির বদলে অপরাজনীতি দেশকে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন থেকে কেবলই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের চিন্তা-চেতনা-মননে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করি, আমরা যদি স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন করতে চাই_তাহলে 'দেখে-শুনে চুপ করে থাকার' এই অভ্যাস আমাদের বদলাতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার যেমন আমরা চাই, একইভাবে স্বাধীনতার সুফল ছিনতাইকারীদেরও বিচার আমাদের চাইতে হবে। কিন্তু তার আগে, কারা কিভাবে স্বাধীনতার সুফল ছিনতাই করেছে এবং করছে তা আমাদের জানতে হবে। একাত্তরের অনেক আগে থেকেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বুঝে গিয়েছিল, স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে বাঙালিরা ক্রমেই সংগঠিত হচ্ছিল। ষাটের দশকের শুরু থেকেই সামরিক ও বেসামরিক দুই ভাবেই স্বাধীনতার পক্ষে সংগঠিত হওয়ার কাজ চলে আসছিল। জীবন বাজি রেখে সামরিক বাহিনীর ভেতরে বাঙালি কর্মকর্তারা সেদিন যেভাবে সংগঠিত হচ্ছিলেন_তাঁদের সে সাহস-মনোবলকে চিরদিনই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, 'আগরতলা' ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মোটেও বায়বীয় ছিল না। কেবল রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যই এর সঙ্গে 'আগরতলা' শব্দটি পরে যোগ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক গণ-আন্দোলনের কারণে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েছিল মামলা তুলে নিতে এবং মামলার আসামিদের মুক্তি দিতে। 'লৌহমানব' আইয়ুব খানও বাধ্য হয়েছিল ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকেই সমর্থন জানিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই ছয় দফাই হয়ে উঠেছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। কী ছিল সেই ছয় দফাতে? রাজনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন তারই ধারাবাহিকতা। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণে আমরা ব্যর্থ হলাম কেন? স্বাধীনতার প্রত্যাশিত সুফল না পাওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। মাত্র তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বাহাত্তর সাল থেকেই একের পর এক পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একের পর এক হত্যা, পুলিশ ফাঁড়ি লুটসহ বহু অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চালানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর চক্রান্তকেও ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু সর্বোপরি যেটি ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক, সেটি হলো দলের ভেতরে ও বাইরে লুটেরা মনোবৃত্তির ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু নিজেই বারবার ক্ষুব্ধ হয়েছেন এদের কর্মকাণ্ডে। হতাশা প্রকাশ করেছেন এই বলে যে 'আমি কী করব, আমার চারপাশে সব চাটার দল।' রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানাগুলোয় যাদের প্রশাসক বানিয়ে দেওয়া হলো, তাদের অধিকাংশই দুই হাতে লুটপাট শুরু করে। উন্নয়নকাজের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। এ দেশে আমলাতন্ত্র কখনোই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কিংবা জনপ্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে কাজ করেনি অথবা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিজেও বারবার 'লাল ফিতার দৌরা@ে@@@্য' ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফলে দেশ পরিচালনায় সৃষ্টি হয় এক নৈরাজ্যের। এর কিছু কারণও আছে। পাকিস্তান আমলে আমলাতন্ত্রে ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। স্বাধীনতার পর আমলাতন্ত্রের শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে বহু অযোগ্য লোককে অনেক উঁচু পদে বসাতে হয়েছিল এবং সেটিও প্রশাসনিক নৈরাজ্য তৈরিতে সহায়তা করেছিল। তখন থেকেই অফিস-আদালতে ঘুষ প্রথার ব্যাপক বিস্তার ঘটে, যেটি পরবর্তী অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে অনেক বেশি বিস্তার লাভ করে। পরিকল্পিতভাবে ঘুষ ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে দেশের ছাত্ররাজনীতিকে ধ্বংস করা হয়। সেসব ধারা এখনো প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুষ প্রথার বিস্তার নিয়ে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। আর তাতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ এক নম্বর স্থানটি দখল করে আছে। অনেক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণেও দেখা যায়, প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা এগোতে পারে না। আমাদের রাজনীতিবিদ, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইউনিয়নসহ নানা স্তরে এই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল, যার চরম বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল বিগত জোট সরকারের আমলে। আর দুর্নীতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দেয় সন্ত্রাস। টিআইয়ের জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থাটি হচ্ছে পুলিশ। শুধু এবারের জরিপে নয়, নিকট অতীতের প্রায় সব জরিপেই পুলিশ শীর্ষস্থান দখল করে আছে। আর যে দেশে পুলিশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়_তা সহজেই অনুমেয়। দ্বিতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হিসেবে দেখানো হয়েছে বিচার বিভাগকে। অর্থাৎ সেখানে কোনো প্রতিকার চাইতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। ফলে বাংলাদেশ ক্রমেই অন্যায়কারীদের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। অত্যাচারিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার পাওয়ার পথ থাকছে না। এর ফলে অন্যায়কারী আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, শোষণ, জুলুম, বঞ্চনা কেবলই বাড়ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি দেশের সামাজিক সাম্যও ব্যাহত হচ্ছে। সবল ও অন্যায়কারীরা ধনী থেকে আরো ধনী হয়ে যাচ্ছে। আর দুর্বল সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতরই হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল প্রাপ্তি থেকে কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা যদি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণকে স্বীকার করি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়াটা যদি আমাদের অন্তরের তাগিদ হয়, তাহলে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনটাকেও আমাদের কর্তব্য বলে গণ্য করতে হবে। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে যুদ্ধ ছিল, তাকে অসমাপ্ত বলেই ধরে নিতে হবে। আর সেই অসমাপ্ত পর্বটি সম্পন্ন করার জন্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। পাশাপাশি ৪০ বছরের লুটেরা দুর্নীতিবাজদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় আনতে হবে দেশকে যারা বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিল, সেই সেনা শাসকদের। আগের প্রজন্ম স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্বটা সমাপ্ত করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়টা সমাপ্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। নতুন প্রজন্মের সৈনিকদের প্রধান অস্ত্র হবে ঘৃণা। 'অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে' নতুন প্রজন্মের সৈনিকদের এই বাণীটি হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজ ও লুটপাটকারীদের নামে কুশপুত্তলিকা স্থাপন করে তাতে প্রতিদিন ঘৃণার থুথু ছিটাতে হবে। অমুক দল স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি, তাই তার অন্যায়ের সমালোচনা করা যাবে না, কিংবা বিচার দাবি করা যাবে না_যাঁরা এ ধরনের যুক্তি দেন, তাঁদের প্রতিও থাকবে আমাদের ঘৃণাবোধ। আমরা মনে করি, স্বাধীনতার সপক্ষের সরকারে কোনো লুটেরা, চাটার অবস্থান থাকতে পারে না। থাকলে তা হবে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
লেখক : সাংবাদিক
লেখক : সাংবাদিক
No comments