স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হাবিবুর রহমান, বীর প্রতীক গ্রামবাসীদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে থানায় সফল আক্রমণ চালিয়ে হাবিবুর রহমান সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ফিরে গেলেন তাঁদের গোপন ঘাঁটিতে। পরদিন তাঁরা জানতে পারলেন, থানা আক্রমণের খবর পেয়ে ঝালকাঠি থেকে এক দল পাকিস্তানি সেনা এসে থানার পার্শ্ববর্তী দুটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। গ্রামবাসীর এই


বিপদের মুহূর্তে তিনি নীরব থাকতে পারলেন না। সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। তাঁদের বীরত্ব ও সাহসিকতায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। ১৩ বা ১৪ সেপ্টেম্বর। নলছিটিতে।
ঝালকাঠি জেলার অন্তর্গত নলছিটি থানা (বর্তমানে উপজেলা)। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন নলছিটি থানা আক্রমণের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ বা ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁরা থানা আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে অংশ নেন হাবিবুর রহমানসহ ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। সফল আক্রমণ শেষে তাঁরা ফিরে যান ক্যাম্পে। এদিকে থানা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পরদিন ঝালকাঠি থেকে এক দল পাকিস্তানি সেনা নলছিটি এসে থানার পার্শ্ববর্তী দেওপাশা ও পরমপাশা গ্রাম দুটি জ্বালিয়ে দেয়। নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে অকথ্য নির্যাতন করতে থাকে। গ্রামবাসীর ওই বিপদের সময় হাবিবুর রহমান নীরব না থেকে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। গ্রামবাসীদের রক্ষা করার জন্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখযুদ্ধে। তাঁরা পরমপাশা স্কুল, তালতলা ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ চালান। তাঁদের কাছে ভারী অস্ত্র বলতে ছিল একটি এলএমজি। এলএমজি ম্যান ছিলেন হাবিবুর রহমান। তিনি তখন এলএমজি হাবিব নামেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি বীরত্বের সঙ্গে বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ করেন। তাঁর দুঃসাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়। হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। সেদিন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুজন শহীদ হন।
হাবিবুর রহমান চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন খুলনার ৫ নম্বর ইপিআর উইংয়ের সাপোর্ট প্লাটুনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে যুদ্ধ করেন ৯ নম্বর সেক্টরের টাকি সাবসেক্টরে। রাজাপুর থানা, বাকেরগঞ্জ থানা, বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ, চাচৈর, গাবখান, বানারিপাড়া যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। চাচৈর যুদ্ধ ঝালকাঠি জেলায় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য এক যুদ্ধ। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন সেখানে। পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল ও ঝালকাঠি—দুই দিক থেকে সেখানে এসে তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। ১৪ নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হাবিবুর রহমান, মানিক, সেকেন্দার আলীসহ কয়েকজন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। এ সময় খাল পার হতে গিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। কয়েকজন পালাতে না পেরে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খুঁজে বের করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাবিবুর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২২৬।
হাবিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার (ডাক নতুন হাট) গাববাড়ী গ্রামে। সেখানে তিনি থাকেন না। বর্তমানে বসবাস করেন ঢাকার দনিয়া এলাকার নাসির উদ্দিন রোডের খান সাহেব লেনে। তাঁর বাবার নাম আবুল হাসেম হাওলাদার। মা মন্নুজান বেগম। স্ত্রী নূরজাহান বেগম। তাঁদের চার ছেলে, তিন মেয়ে। হাবিবুর বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা দেশের মাটি স্বাধীন করেছি। সত্যি কথা বলতে কি, দেশের মানুষের মানসিকতা স্বাধীন করতে পারিনি।’
সূত্র: হাবিবুর রহমান বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৯।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.